প্রভু এ সবই তো আপনার ইচ্ছায় হয়েছে! মানুষকে একটু সুখ দিলে কী এমন ক্ষতি হত আপনার!
খুব ক্ষতি হত। মানুষ আমাকে ভুলে মেরে দিত।
এখনই বা কী এমন মনে রেখেছে! খাচ্ছেদাচ্ছে আর বংশবৃদ্ধি করে পৃথিবীর অ্যায়সা হাল করেছে, একপাশে কাত হয়ে ঘুরছে। টলটলায়মান।
এত মন্দির, মসজিদ, চার্চ, কাবা, সকাল-বিকেল আরতি, ঘণ্টাধ্বনি, আজান, আহ্বান, কেন মহেশ্বর! আমাকে মনে না রাখলে এসব হত কি?
আমার কিছু বলার নেই প্রভু। কে যে কীসের ধান্দায় ঘুরছে আমার চেয়ে আপনি ভালোই জানেন।
তা অবশ্য জানি। কেবল দেহি, দেহি করছে। গাড়ি দাও, বাড়ি দাও, চাকরি দাও, বেহিসেবি টাকা দাও, যশ দাও, খ্যাতি দাও, মৃত্যুর পরে স্ট্যাচু দাও। এত দাও-দাও–বিরক্ত হয়ে আমি আর কিছু দিই না। সৃষ্টি সেই একবারই করেছিলুম। যা বাবা, এবার তোরা লুটেপুটে খা।
প্রভু পাঁচজনে খাচ্ছে আর পঁচানব্বইজন টেরিয়ে-টেরিয়ে দেখছে।
মরুক গে। যা পারে করুক। তোমার আমার কাঁচকলা। তা যাই বলো বাপু, এবার একটু শীত-শীত করছে।
শীত করছে প্রভু! চলুন তাহলে। পারুর হাতে এক কাপ করে গরমাগরম চা খাওয়া যাক।
আবার ওই মর্তের নেশাটা ধরাবে!
আপনাকে আর কে ধরাবে মালিক! আপনিই তো নেশা, কারুর কারুর আপনিই তো নেশা। নিন উঠুন। চলুন। খুব ঝাল চানাচুর দিয়ে চা খাওয়া যাক। হিমালয়ের শীত। হাড় কাঁপয়ে দিলে।
মহেশ্বরের ডেরায় এসে পরমেশ্বরের চোখ কপালে উঠে গেল। প্রশ্ন করলেন, ভোলা মহেশ্বর, এ কী করে ফেলেছ! তোমার ভক্তরা গায়, বাবা শ্মশানে থাকে ছাই ভষ্ম মাখে, তোমার এই ঐশ্বর্য দেখলে তারা কী বলবে? ভাগ্যিস এখানে ইনকামট্যাক্স নেই। থাকলে তোমার এই দুনম্বরি কারবার ধরে ফেলত। কোথা থেকে আমদানি করলে!
মহেশ্বর লাজুক লাজুক মুখে হাসলেন। ত্রিশূল দিয়ে জটা চুলকোতে-চুলকোতে বললেন, প্রভু, ঐশ্বর্য আর আব একই জিনিস। একবার বাড়তে শুরু করলে আর থামানো যায় না। ওই ফিল্ম স্টার হয়ে যাওয়ার পর থেকে মর্তে আমার পপুলারিটি এত বেড়ে গেছে! কী করব প্রভু! এসব পাপের পাষাণ। ওদিকে হেরেরেরে করে পাপ বাড়ছে, এদিকে আমার জেল্লা বাড়ছে। বিশ্বনাথে রোজ মন-মন দুধ ঢালছে আমার মাথায়, চতুর্দিকে পুজো চড়াচ্ছে। মিষ্টির দোকানে আজকাল খুব লাভ। রমরমা কারবার। দুধ ধরে ক্ষীর, ক্ষীর চটকে পাড়া। পারুরও সময়টা ভালো যাচ্ছে। এক কলকাতাতেই ছহাজার বারোয়ারি। বরাত খুলে গেছে প্রভু। শ্মশানে আমার আসন কেড়ে নিয়েছে কলকেবিহারি দেশি-বিদেশি হিপির দল। মারছে টান আর ব্যোম ভোলে বলে চোখ উলটে চিৎপাত। কারবার ভালোই চলেছে।
আমি জানি, হিংসে হচ্ছে প্রভু। হিংসে, এই-ই হয়। জমিদার ফুটে যায়, নায়েব নবাবি করে। এই স্বর্গে উর্বশী একটু নাচ দেখাবে। দু-চার পাত্র সোমরস চলবে। দেবাসুরে মাঝে-মাঝে লড়াই হবে। সবই একঘেঁয়ে প্রভু। আপনার জীবনও জীবন। মানুষের জীবনও জীবন। মানুষের জীবনে যে কী মজা! এই দেখুন প্রভু, একে বলে টিভি। এর নাম ভিডিও। একে বলে স্টিরিও।
রাখো-রাখো, ওসব তোমার ছেলেমানুষি খেলনা। ও দিয়ে তুমি তোমার পারুর মন ভোলাও। আমি পরমেশ্বর। ইংরেজরা আমাকে লর্ড বলে। জানো কি তা! আমি অলমাইটি।
প্রভু জীবন যদি খেলা হয়, তাহলে মানুষ কিন্তু জীবন নিয়ে আজকাল খুব ভালোই খেলতে শিখেছে। আকাশে উড়ছে। মাটিতে ছুটছে। চাঁদে এসে মাটি কোপাচ্ছে। আপনার বড়-বড় গ্রহের পাশ দিয়ে রকেট ছোটাচ্ছে। কেলোর কীর্তি করে ফেলছে। দিনকতক পরে আপনাকেই গদি থেকে ফেলে দেবে!
মামার বাড়ি আর কী! আমার রাজত্বে আমারই সৃষ্টি আমাকে ফেলে দেবে! কছিলিম চড়িয়েছ আজ মহেশ্বর? তোমার পারু কি তোমাকে একেবারেই ছাড়া-গরু করে দিয়েছে। কলকাতার বড়বাজারের বেওয়ারিশ ষাঁড়ের মতো।
আজ বিনা ছিলিমেই চলছে প্রভু। যা বলেছি তা আমার জগৎঘোরা অভিজ্ঞতার কথা। পৃথিবীতে গিয়ে বেশি না দিনকতক থাকলেই আপনার জ্ঞানচক্ষু খুলে যাবে।
আমার আবার জ্ঞানচক্ষু কী হে। আমি নিজেই তো জ্ঞান।
সে হল পরমজ্ঞান। ও আপনার কেতাবে থাকে। সেই জ্ঞানে জগৎ-সংসার চলে না। পৃথিবীতে গেলে দেখবেন, পিতাদের কী অবস্থা? ভারত-পিতা গান্ধীমহারাজ যিনি আপনার নীতি অনুসরণ করেছিলেন–ন্যায়, সত্য, অহিংসা, সদাচার, জাতি-বর্ণের বিভেদ দূর। কী হল তাঁর? আপনি কিছু করতে পারলেন? একটা বুলেট? হায় রাম। সব শেষ।
আমি ওর শেষটা ওই ভাবেই করতে চেয়েছিলুম।
কী কারণে প্রভু?
চিরকাল মানুষ মনে রাখবে বলে। সত্য আর অহিংসার বাণী রক্তের অক্ষরে জাতির জীবনে দগদগ করবে।
হায় মূর্খ।
কাকে মূর্খ বলছ হে। আমাকে, না আমার আশীর্বাদ ধন্য গান্ধীমহারাজকে।
আপনাকে প্রভু। সারাজীবন যিনি শুধুই জ্ঞানের ভাণ্ডারা দিয়ে গেলেন।
তোমার সাহস দিন-দিন বাড়ছে। বেড়েই চলেছে অ্যাঁ।
বাড়বেই যে প্রভু। দেবতারা প্রথমত অমর। তা ছাড়া স্বর্গে পুলিশ নেই যে ধরে রুলের গুতো মারবে। আদালত নেই যে মানহানির মামলা ঠুকে দেবে!
তা বলে তুমি আমাকে জগৎ-পিতা, পরম-পিতাকে মূর্খ বলবে?
কেন বলব না প্রভু! সত্য আর অহিংসার বাণী রক্ত দিয়ে লিখতে চেয়েছিলেন। বাণী মুছে গেছে, রক্তটাই দগদগ করছে। জাতির সর্বাঙ্গ দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। ভারত-পিতার গোটাকতক কিম্ভুতকিমাকার মূর্তি এখানে ওখানে খাড়া করা আছে। বছরে একদিন জাতীয় ছুটি। মূর্তির গলায় গোটাকতক মালা। সারা বছর কাক-পক্ষীর পেছনের ব্যবস্থাপনায় চুণকাম। তার বাণী ভেসে চলে গেছে। তার জীবন লোকে ভুলে মেরে দিয়েছে। ছোরাছুরি ছাড়া আদান-প্রদান নেই। বোমা ছাড়া শব্দ নেই। সব সময় মারমার, কাটকাট চলেছে। গদি ছাড়া লক্ষ্য নেই। ভোট দাও ছাড়া বাণী নেই।