বাঁদর থেকে ধাপে-ধাপে আমি মানুষ সৃষ্টি করেছিলুম, ধাপে-ধাপে আবার বাঁদর হয়ে যাচ্ছে তো মহেশ্বর?
কী জানি প্রভু। আমার তো সেই রকমই মনে হচ্ছে।
চলো না একবার দেখে আসি। আহা ওরা তো আমারই সন্তান।
প্রথমে কোন দেশে নামবেন?
কেন, ভারতে? ভারত হল পুণ্যভূমি। গঙ্গা, সিন্ধু, যমুনা যে দেশে প্রবাহিত। যার উত্তরে দেবতাদের আবাসস্থল, হিমালয়। যুগ-যুগ ধরে সংসারত্যাগী সন্ন্যাসীরা সেই গিরি করে বসে দিবা নিশি আমার নাম করে চলেছে। যে দেশের দক্ষিণ তটভাগে সমুদ্রের অবিরত চুম্বন। সেই তীর্থভূমি ভারতেই চলো আমরা অবতরণ করি। স্বাধীনতা সেখানে প্রবীণ হতে চলেছে। বয়েস হল সাঁইত্রিশ। চলো-চলো মহেশ্বর, গণতন্ত্রের সেই পীঠস্থানে চলো।
মহেশ্বর এই সেই হিমালয়?
হ্যাঁ প্রভু এই সেই গিরিরাজ।।
কিন্তু এ কী! সেই পুণ্যভূমির এ অবস্থা নে? এখানে, ওখানে, সেখানে ডাণ্ডা পোঁতা ঝাণ্ডা, হুহু বাতাসে উড়ছে। কারণটা কী মহেশ্বর?
প্রভু এক্সিপিডিশান। এদেশ, ওদেশ, সে-দেশ সারা বছরই, কোনও না কোনও সময়ে পর্বত অভিযানে আসছে। এদল এপাশ দিয়ে ওঠে তো ওদল ওপাশ দিয়ে। দেশে-দেশে প্রতিযোগিতা। মাউন্টেনিয়ারিং এখন একটা ফ্যাশান। মনে নেই প্রভু, এভারেস্টের মাথায় হিলারি আগে উঠেছিল, না তেনজিং আগে, এই নিয়ে কী ঝামেলা।
বেশ সে না হয় হল। ছেলেমানুষরা অমন করেই থাকে। আমরাও যখন ছোট ছিলুম তখন ঢিবি দেখলেই চড়ে বসতুম। কিন্তু এত আবর্জনা কেন চারপাশে! এ তোমার কলকাতা না করাচি!
ওই যে প্রভু, দলে-দলে যারা এক্সপিডিশানে আসে তারা ফিরে যাওয়ার সময় টন-টন মাল, কাগজ, কৌটো হ্যাঁনা-ত্যানা ফেলে রেখে যায়। কে আর পরিষ্কার করে প্রভু! ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে সবই।
মহেশ্বর, ভারতীয়রা দেবতাত্মা হিমালয়ের এইভাবে, এঁটো-কাঁটা ফেলে মাহাত্ম্য নষ্ট করছে? বেদ-বেদান্তের দেশের মানুষ কি শেষে ঈশ্বরে অবিশ্বাসী হয়ে গেল!
ঈশ্বর! কিছু মনে করবেন না প্রভু! আপনাকে, আপনার সন্তানরা কবর দিয়ে দিয়েছে। বেদ আছে বেদান্ত আছে। গীতা আছে। কয়েকশো ব্যাখ্যা আছে। মন্দির আছে, মসজিদ আছে, গীর্জা আছে, গুরু আছে, চ্যালা আছে, মেলা আছে, প্রণামী আছে, সব আছে, কেবল আপনিই অনুপস্থিত।
মহেশ্বর আমার এ দশা হল কেন?
মানুষকে অত পাওয়ার দিলে এইরকমই হবে প্রভু। পিতা হয়ে পিতার কর্তব্য করেননি। শাসনের অভাব। আদরে সব বাঁদর হয়ে গেছে। পায়ের জিনিস এখন মাথায় উঠে নাচছে। ধর্ম কর্ম সব গেছে। থাকার মধ্যে আছে রাজনীতি। আপনাকে ভজে-ভজে মানুষের খুব আক্কেল হয়ে গেছে। পায় তো ঘোড়ার ডিম! কেউ তারকেশ্বর, কেউ কাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। নিজের অন্ন না জুটলেও আপনার সেবা ঠিকই চড়ায়। পাণ্ডা আর সেবাইতদের পেট মোটা হয়। ঐশ্বর্য বাড়ে। নিজেরা পায় কঁচকলা। ছেলের চাকরি জোটে না। স্বামীর ক্যান্সার ভালো হয় না। কেউ দুর্ঘটনায় মরছে। কেউ ছুরি খাচ্ছে। সোনার সংসার এক কথায় ছারখার হয়ে যাচ্ছে। আপনার ওপর মানুষের আর আগের মতো বিশ্বাস নেই।
কেন মহেশ্বর, আমি তো বলেই দিয়েছি, কর্মফলেই এইসব হয়।
ওই পুরোনো যুক্তি মানুষ আর মানতে চাইছে না। সায়েবদের হাওয়া গায়ে লেগেছে। নিৎসে কী বলেছে জানেন, দি গড ইজ ডেড। আপনি মারা গেছেন।
সে আবার কে?
সে এক পাগল দার্শনিক। হিটলারের গুরু।
হিটলার? ও সেই পাগলাটা, যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধিয়েছিল। ওর দোষ নেই মহেশ্বর। যুদ্ধ, প্রাকৃতিক বিপর্যয় সব আমারই খেলা। মানুষকে শিক্ষা দেবার জন্য এসব আমারই ব্যবস্থা। নাও চলল, এই বরফের টঙে চড়ে আমার আর ভালো লাগছে না। শীত-শীত করছে। আমার স্বর্গে তো চির বসন্ত।
প্রভু এই হল আমাদের কাশ্মীর। যাকে ভূস্বর্গ বলে মানুষ নাচানাচি করে। সারা বছর ক্যামেরা কাঁধে ট্যুরিস্টরা এসে গুলমার্গ, সোনা মার্গে বরফের ওপর কাঠের জুতো পায়ে হড়কে-হড়কে বেড়ায়।
তাই না কী, এই তোমার সেই কাশ্মীর! এইখানেই তোমার সেই জাফরানের খেত। আহা কী শোভা!
আর এগোবেন না প্রভু। গুলি করে দেবে। শ্রীনগরে কার্ফু।
কার্ফু? সে আবার কী?
ও হল মানুষের জগতের নিয়ম। রাস্তায় বেরিয়েছ কী মরেছ।
তার মানে? ভূস্বর্গে লোকে বেড়াতে আসবে না?
এর নাম রাজনীতি মালিক। এটা তো বর্ডার স্টেট। সেই স্বাধীনতার পর থেকেই একটা -একটা ঝামেলা লেগেই আছে। ওপাশে পাকিস্তান, এপাশে হিন্দুস্তান। হাত ধরে টানাটানি। মা আমার ধর্ষিতা। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ।
আমার কৃষ্ণ কোথায়। সুদর্শন চক্র কি আর ঘোরে না।
প্রভু এক কুরুক্ষেত্রেই কৃষ্ণ কাত। গীতায় কিছু বাণী রেখে তিনি সরে পড়েছেন। চক্র এখন ছবি হয়ে আটকে আছে ভারতের তেরঙা জাতীয় পতাকায়।
তাহলে আমি আর একজন কৃষ্ণ তৈরি করি।
সে কৃষ্ণ শুধু বাঁশিই বাজাবে প্রভু। আর রাধার সঙ্গে প্রেম করবে। গণতন্ত্রে ভোট যুদ্ধই একমাত্র যুদ্ধ।
ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলো মহেশ্বর। পলিটিক্যাল সায়েন্সে আমার কোনও ডিগ্রি নেই।
ডিগ্রি, ডিপ্লোমার ব্যাপার এদেশ থেকেও ঘুচে গেছে প্রভু। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সব জায়গাতেই এখন পেটো-পটকার খেলা। দু-দলে কাজিয়া। ভিসিরা ঘেরাও হয়ে বসে থাকে মল মূত্র চেপে।