বুঝলে, গতবার ভীষণ মশা কামড়েছে। এক-একটার সাইজ কী, যেন টুনটুনির বাচ্চা। কামড়ে কামড়ে বাপের নাম ভুলিয়ে দিয়েছে।
কার নাম? শ্বশুরমশাইয়ের? বেশ করেছে। ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার চির অবনিবনা। হিংসে বুঝলে হিংসে। আমার পপুলারিটি ভদ্রলোক সহ্য করতে পারেন না। এবারে প্যাণ্ডেলে সিংহের পিঠে উঠে পোজ দেওয়ার আগে বড়বাজার থেকে বেশ বড় সাইজের একটা নাইলনের মশারি কিনে নিও। ম্যালিরিয়া ফ্লু আর ডেঙ্গু একসঙ্গে ধরলে ধন্বন্তরির বাবার ক্ষমতা নেই সারায়।
কী হবে গো?
আবার কী হল?
গতবারে পুলিশ নাকি খুব বেঁকে বসেছিল। যেখানে-সেখানে প্যাণ্ডেল বাঁধতে দেবে না। চাদা নিয়ে জুলুম করলে চ্যাংদোলা করে তুলে আনবে।
তাতে তোমার পুজোর কোনও অসুবিধে হয়েছিল? প্যান্ডেলের চেকনাই কি কিছু কম ছিল?
তা ছিল না অবশ্য।।
তবে এবারেও ঠিক তাই হবে। পুলিশ যেমন শাসায় তেমনি শাসাবে। চাদা যা ওঠে তার চেয়ে বেশিই উঠবে। ভুলে যেও না গিন্নি দেশের নাম পশ্চিমবাংলা। তাই তো কবি গাহিয়াছেন;
এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ/তবু রঙ্গে ভরা।
সব হবে। সব এক মঞ্চে পাশাপাশি হবে। পাতালরেল, চক্ররেল, বাহাত্তর ইঞ্চি পাইপ, দাবি মিছিল, ধর্ম মিছিল, বিয়ের মিছিল, ফুটবল, বাস্কেটবল, হকি, ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, যাত্রা-উৎসব, বাংলা বন্ধ, বোম, ছোরাছুরি, ভোট, ব্যালে নাচ, ম্যাজিক, সার্কাস, বন্যা, খরা, বনমহোৎসব, বননিধন, সব পাশাপাশি চলবে। বাপের শ্রাদ্ধ। ছেলের বিয়ে। তুমি কিস্যু ভেবো না।
সরস্বতীটা একটু বেঁকে বসেছে। বলছে রাজ্যপাল রাজভবন থেকে না নড়লে ও যাবে না।
সেরেছে। ও আবার রাজনীতিতে নাক গলিয়েছে! মাথায় ঘোল ঢেলে ছেড়ে দেবে। ওকে বলো এ পুজোয় ওর তো বীণা হাতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া কোনও ভূমিকা নেই। এ তো তোমার পুজো। সেই মাঘে ওকে যখন একা যেতে হবে তখন যেন নিজের মত খাটায়। বিশ্বকর্মাকে দেখে শিখতে বলো। কল নেই, কারখানা নেই। শিল্পের সমাধিতে কেমন হাতি চেপে ঘুরে এল। চলছে-চলবে-র দেশ। ওখানে সবই তো খেলা গো!
পুজোও খেলা?
আলবাত। পুতুল খেলা। মা-মা করে চেল্লায়, তুমি ভাবো খুব ভক্তি! গিন্নি, তুমি হলে বেওসা। মা আসছেন, মা আসছেন, ঘোড়ার ডিম, আসলে পুজোর বাজার আসছে। বাবুদের বোনাস আসছে। যাদের ভাড়ে মা ভবানী তাদের আতঙ্ক আসছে। দোকানে ঝুলছে শাড়ি। সিল্ক, জর্জেট, পলিয়েস্টার, পিওর সিল্ক, অরগ্যাঞ্জা। ঝুলেছে পোশাক। টপলেস, বটমলেস।
সে আবার কী?
দেবী হয়ে বসে আছ, চিরকাল চেয়ে রইলে পায়ের তলায় হামাগুড়ি অসুরটির দিকে। ক্যাপ্টেন কার্তিককে শুধিয়ো, সে-ছোঁড়া সব জানে। পোশাকের চেয়ে স্টাইল বড়। সিথু, কী বস্তু জানো গিন্নি? বলতে শরম লাগে। তোমার বয়েস না হলে পরাতুম। শাড়ি পরেছ কী পরনি। তোমার কাঠামোটি পুরো দেখা যাবে। যেন একসরের চোখে তোমাকে জগদবাসী জুলজুল করে দেখছে। তোমার ডায়গ্রাম নয় স্কায়াগ্রাম।
মরণ আর কী! ফ্যাশানের মুখে ঝাড়ু মারো। আর বটমলেস, টপলেস কী জানো? বাক্স আছে, মাল নেই। খুলে পরো। কী পরো? মায়া কাঁচুলি। সব খোলা। উদোম। সি সি সিটি। সাধে আমি একটি পাথরের লিঙ্গ হয়ে মন্দিরে-মন্দিরে বসে আছি! চোখ, নাক, কান, মুখ, হাত, পা, দেহ কিছুই নেই।
হ্যাঁ গো, এবার কী রঙের শাড়ি পরে যাব? টকটকে লাল? না ফিকে লাল? নির্বাচনের ফলাফল তো ফিকের দিকে!
গিন্নি, তোমার মাথাটিও গেছে। শাড়ির সঙ্গে রাজনীতি জুড়ছ। চিরকাল তুমি তো খড়ের পোশাক পরেই যাও, তারপর যে বারোয়ারি তোমাকে যেমন সাজায়।
দেব, রাজনীতি ছাড়া ওদেশে আর কী আছে! আর, পুজোর প্রাক্কালে ঘরে-ঘরে গৃহিণীদের শাড়ি পলিটিক্স। মনের মতো দিতে পারলে ভোলেবাবা জিন্দাবাদ। নইলে মুর্দাবাদ। কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও।
০২. এই যে ঠাকুর সাতশোবার ডায়াল করলুম
এই যে ঠাকুর সাতশোবার ডায়াল করলুম কানেকশন পেলুম না। কেন চিন্তা করছেন? মা ঠাকরুণ ভালোই আছেন। ভালোই থাকবেন। বারোয়ারীবাবুরা আর যাই করুন, যত্নের ত্রুটি করেন না। প্যান্ডেলটি ভালোই বাঁধেন। আজকাল আবার ফ্যান ফিট করেন। খুব বাহারও দেন। কোনওটা দক্ষিণ ভারতের মন্দিরের মতো। কোনওটা লাট ভবনের মতো। কোনওটা যাদুঘরের মতো। কেন আপনি দুশ্চিন্তা করে মৌতাত নষ্ট করছেন? মা আমাদের ভালোই আছেন।
কেন ফ্যাচর-ফ্যাচর করছ। বাঙালিবাবুদের হাওয়া গায়ে লেগেছে? তেনাদের স্লোগান হয়েছে, আসি যাই মাইনে পাই, কাজের জন্য ওভারটাইম। সাতশোবার করেছ, আরও সাতশোবার করো। মায়ের কি আর যৌবন আছে? বেচারার বয়সও হয়েছে, তার ওপর ভক্তদের টানা হ্যাঁচড়া। যে দেশে গেছে সে দেশের খবর কিছু রাখো? রাস্তায় বড়-বড় গর্ত। ম্যানহোলের মুখ খোলা। রাস্তার দুপাশে ড্রেনের পাঁক তোলা। তার ওপর পৌর ধর্মঘটে টন টন আবর্জনা জমে আছে। তার ওপর শহর পাতালে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সে এক সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার। তোমার কোনও ধারণা নেই। ওখানে আমার চ্যালারা লড়ে যেতে পারে। ছিলিমের জোরে আমি পার লাগাতে পারি। আমার বউ কি তা পারবে। বছরের পর বছর এক ঠ্যাঙে দাঁড়াতে-দাঁড়াতে পায়ে ভেরিকোস ভেন হয়ে গেছে। আমার স্ত্রীকে কি তুমি ট্রাফিক পুলিশ ভেবেছ? যাও আবার ডায়াল করো।