মহেশ্বর, পার্বতী দুজনেই স্তব্ধ। এ কী পরমেশ্বরের হেঁয়ালি, না সত্য? সত্য কোথায়? সৃষ্টি আর লয় দুটোই তো রহস্য! জানা, অজানা হয়ে যেতে কতক্ষণ।
আমি এবার বিদায় নেব।
মহেশ্বর বললেন, প্রভু, আপনি যদি শয়তানই হন, আমরা কিন্তু এতকাল আপনাকে পরমেশ্বর বলেই জেনে এসেছি। সে ভুল আর না-ই বা ভেঙে দিলেন।
গুহামুখ থেকে পরমেশ্বর অথবা শয়তান, যিনিই হোন না কেন গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, সে তোমাদের ব্যাপার! কী সত্য আর কী মিথ্যা, এ বিচারের ভার আমি তোমাদেরই দিয়ে গেলুম। আমার কাছে সত্যও নেই, মিথ্যাও নেই। মানুষকে আমি নিজে কোনওদিনই বলতে যাইনি, তোমরা ভগবানকে মানো, কি শয়তানের থেকে সাবধান হও। বিশ্বাস আপনিই জাগে। সন্দেহ আপনিই আসে।
মহেশ্বর আর পার্বতী গুহামুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। কেউ নেই। রাত নেমেছে কৈলাসে। তুষারধবল রাত। হুহু বাতাস বইছে। হিমবাহ নামার শব্দ। বরফে-বরফে ঘর্ষণে হিলহিলে বিদ্যুৎ খেলছে চারপাশে।
.
মহেশ্বর বললেন, পারু এতক্ষণ কি আমরা কোনও দুঃস্বপ্ন দেখছিলুম?
হতে পারে? ভদ্রলোক আবোল-তাবোল কী সব বকে গেলেন!
অতটা অশ্রদ্ধা প্রকাশ কোরো না।
দেবতা কখনও ভদ্রলোক হয় না। অমন কথা বলতে নেই, ছিঃ! তোমার বয়েস কয়েক কোটি আলোকবর্ষ হলেও, তোমার এখনও ভীমরতি হয়নি?
দেবতারা তাহলে কি ছোটলোক!
দেবতা-দেবতা। লোক কেন হতে যাবেন! লোক তো পোক!
সে আবার কী?
কেন? শোনোনি? অবতার পুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, তোক না পোক। পোক মানে পোকা। উনি তো সৃষ্টির আদি থেকেই উলটোপালটা কথা বলার জন্য বিখ্যাত। কী আর করা যাবে। অমন বলেন বলেই পৃথিবীতে একদল মানুষ করে কর্মে খাচ্ছে গো!
কথা বেচে? কথা সারা জীবন ওলোটপালোট করে!
যারা রাজনীতি করে, তারা ওইরকম কথা বলে। কারুর সঙ্গে কারুর মিল নেই। এখন একরকম পরমুহূর্তেই আর একরকম। আর একদল হল দার্শনিক পণ্ডিত। পিপে-পিপে নস্যি আর ঘাড় দুলিয়ে তর্ক, তৈলাধার পাত্র, না পাত্ৰাধার তৈল। বীজ আগে না গাছ আগে! ডিম আগে না ছানা আগে!
যাই, বৃদ্ধ মানুষটিকে ফিরিয়ে আনি। তুষার ঝড় শুরু হয়ে গেছে।
আবার মানুষ বলছ? ঈশ্বর বলল।
তাইতো বলতুম। এই যে বলে গেলেন, আমি ঈশ্বর নই, শয়তান।
আরে বোকা ঈশ্বর আর শয়তান আলাদা নাকি? একই টাকায় এ-পিঠ ওপিঠ। এই যে আমি বারে বারে পৃথিবীতে যাই, কী দেখে আসি! মানুষের মধ্যেই ঈশ্বর, মানুষের মধ্যেই শয়তান। বাইরেটা দেখে বোঝার উপায় নেই। একদিকে প্যাণ্ডেলে ধুনুচি-নৃত্য হচ্ছে, আর একদিকে পেট্রল বোমা চলেছে। বন্ধু বন্ধুর বুকে ছুরি চালিয়ে দিচ্ছে। তোমার মাথায় তো সারাদিন ঘড়া-ঘড়া দুধ ঢালছে। কেন ঢালছে? কী চায় তারা! ধর্ম? আত্মার উন্নতি?
না পারু। শুধু স্বার্থ। টাকা চাই টাকা। মুনাফা। মানি মানি মানি, সুইটার দ্যান হানি।
তবে? কে ঈশ্বর! আর কে শয়তান, তুমি বুঝবে কী করে!
বেশ আমি তাহলে শয়তানের সন্ধানে চলুম। যদি পাই, ধরে এনে পরমেশ্বরের পাশে দাঁড় করিয়ে দোব। তখনই ধরা পড়ে যাবে, এই জগৎ-সংসার দুইয়ের খেলা, না একের খেলা। গাছের ডালে দুটি পাখি, সু আর কু! না একটি পাখি সুকু। কী বলো গিন্নি!
তোমার তো ট্যাঙোস-ট্যাঙোস করে ঘুরে বেড়ানোই কাজ। সেই ছুতোয় বেরিয়ে পড়ো। ব্রহ্মাণ্ডটা একবার চক্কর মেরে এসো।
.
মহেশ্বর বার-গুহায় এসে হাঁফ পাড়লেন, নন্দে। এই ব্যাটা নন্দে।
নন্দী আপাদমস্তক চামরি-গাইয়ের লোমের কম্বল ঢাকা দিয়ে ঘুমোচ্ছিল। ধড়মড় করে উঠে বসল। ঘুমজড়ানো গলায় বললে, জি হাঁ। ছিলাম প্রস্তুত।
ধ্যার ব্যাটা ছিলাম। মাথাটা গুইলে দিয়ে গেল।
গুইলে নয় প্রভু গুলিয়ে। যাঃ বাবা, নিজেরই গুইলে যাচ্ছে।
অ্যাঁ সে কী রে! শব্দটা তাহলে কী? গুলিয়ে। নে ধরে থাক।
কী ধরব প্রভু?
হস্যইটাকে আগে আসতে দিবি না।
ঠিক আছে মহারাজ। চেপে ধরলুম। আগে আসতে দেব না।
কী হয়েছে বলুন তো, সব যেন কেমন এমোলেলো হয়ে যাচ্ছে।
কতটা টেনেছিস? এমোলেলো না এলোমেলো! ওঠ। ওঠ। উঠে দাঁড়া।
নন্দী উঠে দাঁড়াল। প্রভু আমার মনে হচ্ছে পৃথিবী যেন ধীরে ঘুরছে। ইসপিড কমে গেছে।
স্পিডোমিটারটা দ্যাখ। আস্তে ঘুরছে কী রে! তাহলে তো দিন রাত্রির মাপ ছোট-বড় হয়ে যাবে। ঋতু পালটে যাবে। বছর লম্বা হয়ে যাবে।
নন্দী স্পিডোমিটার দেখে বললে, হ্যাঁ প্রভু, ইসপিড কে কমিয়ে দিয়েছে।
সেরেছে।
তাতে আমাদের কী? আমাদের কাঁলকচা।
কাঁলকচা কী রে! বল কাঁচকলা। শুধু আমার-আমার করে মরছিস কেন? মানুষের কথা ভাব। সারা বছর চাল, কলা, মূলো কম দিচ্ছে! দুধ খাওয়াচ্ছে ঘড়া-ঘড়া।
আর বলবেন না। বোগড়া চাল, পচা কলা, জোলো দুধ।
তা আর কী হবে বল! রেশানের চাল জাঁকের কলা, ফুঁকো দেওয়া দুধ। বিজ্ঞানেই বারোটা বাজালে।
ক্যাঁচ করে ভীষণ একটা শব্দ হল। নন্দী আর মহেশ্বর দুজনেই দুম করে মাটিতে পড়ে গেলেন।
মহেশ্বর বললেন, নন্দে, এটা তোর কী কায়দা!
আমার কায়দা নয় প্রভু। ব্রেক কষেছে। পৃথিবী থেমে গেছে! আর ঘুরছে না।
কে কষলে?
মালুম শয়তানে। অনেক দিন ধরে চেষ্টা চালাচ্ছিল।
শয়তানের ঠিকানা জানিস? ফোন নম্বর?
সে যে পালিয়ে বেড়ায়, দৃষ্টি এড়ায়, যায় না তারে চেনা।
তোকে আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত করতে বলিনি। চল, আমি শয়তানকে ধরতে যাচ্ছি।