প্রভু, আপনি বাঁধাকপি, আপনিই ফুলকপি। আপনি আলু, আপনিই রাঙালু।
তুমি আবার কোথা থেকে, কোথায় চলে গেলে?
প্রভু, আমি শম্প জগতে ঢুকে গেলুম। মানে আপনাকে ঢুকিয়ে দিলুম।
তুমি আবার নতুন করে ঢোকাবে কী! আমি তো ঢুকেই আছি। আমি মহেশ্বর, আমিই পার্বতী।
অসম্ভব। অসম্ভব প্রভু। তা হতে পারে না। আমরা দুজন ছাড়া আপনি সব।
পাগলা, তা কি কখনও হয়! আমার প্রিয় পুত্র শ্রীরামকৃষ্ণ একেই বলেছিল, মতুয়ার বুদ্ধি। আমার ঋষিদের মুখ দিয়ে হাজার-হাজার বছর আগে যে বেদ-বেদান্ত রচনা করিয়ে গেছি, সময় করে সে সব একটু পড়ো না! সত্য জানতে পারবে।
পার্বতী বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, সারাদিন ট্যাঙোস-ট্যাঙোস করে না ঘুরে, একটু লেখা-পড়া করো। আজকাল বি-এ, এমএ পাশ কিছুই নয়। ঘরে-ঘরে। রিসার্চ করো, ডক্টরেট হও। রাজনীতিতে নেমো না বাপু। এই তো একটু আগে দুম করে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে মেরে দিলে।
মহেশ্বর বললেন, অ্যাঁ, সে কী গো, কে মারলে? তুমি কীভাবে খবর পেলে?
আমার যন্ত্রে। আমার টিভি যন্ত্রে।
পরমেশ্বর বললেন, তোমরা বেদজ্ঞ হলে এমন উতলা হতে না। আমি শ্রীকৃষ্ণ রূপে তোমাদের কী বলেছিলুম।
ন জায়তে বা স্রিয়তে কদাচিদ
ভূত্বা ন বায়ং ভবিতা ন ভূয়ঃ।
নিত্যঃ পুরাণোহয়মজোহব্যয়োহসৌ
ন হন্যমানে নিহতঃ শরীরে।।
জন্ম নাই, মৃত্যু নাই, পুনর্জন্ম নাই,
দেহের নাশেও দেহী থাকে সর্বদাই।
অজ্ঞাত, শাশ্বত, নিত্য, চির-পুরাতন।।
প্রভু, আপনার ওইসব হেঁয়ালি মানুষ বোঝে না বলেই, পৃথিবীতে ভণ্ডামি এত বেড়ে গেছে। মা মরছে, বাবা মরছে। ভাই ভাইকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। স্বামী সংসার ভাসিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। সন্তান মায়ের কোল খালি করে সরে পড়ছে। শ্মশানে চড়চড় করে মৃতদেহ পুড়ছে। আর আপনি বলে আসছেন, জন্ম নাই, মৃত্যু নাই, পুনর্জন্ম নাই। দেহের নাশেও দেহী থাকে সর্বদাই!
অ্যাটমের যুগে এসব চলে না মালিক। চিরকাল মানুষ আপনার ছায়াটাই দেখে এল। কায়াটা একবার দেখান।
পাগল হলে মহেশ্বর। সশরীরে পৃথিবীতে হাজির হলে আমাকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে।
জ্যোতির্ময় শরীর ধারণ করে পৃথিবীর আকাশে ভেসে বেড়ান।
ভূত ভেবে সব ভিরমি যাবে।
তাহলে এই চলবে! কল্প কল্পান্তর ধরে?
বোকা, সেই কারণেই তো আমি অবতার পাঠাই। কিছু শক্তি দিয়ে, কিছু বিভূতি দিয়ে।
বহু বছর তো কোনও অবতারও পাঠাননি।
সময় হয়নি এখনও। আমি তো বলেই রেখেছি, যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি।
গ্লানির আর কী বাকি আছে প্রভু। রক্ষক ভক্ষক হয়ে প্রাইম মিনিস্টারকে শেষ করে দিলে।
তুমি কেবল ভারতের কথাই ভাবছ। পক্ষপাতদুষ্ট ভাবনা। গোটা পৃথিবীর কথা ভাবো।
সারা পৃথিবী জুড়েই কেলোর কীর্তি হচ্ছে। ইরাক-ইরানে যুদ্ধ চলছে তো চলছেই। অ্যায়সা বায়োবোম ছেড়েছে, মানুষের কী দুর্গতি! গায়ে চাকা-চাকা ফোঁসকা। দগদগে ঘা। অন্ধ। চামড়া ফেটে রক্ত ঝরছে। আফগানিস্থানের ঘাড়ে রাশিয়া চড়ে বসে আছে। ইয়লো রেন কাকে বলে জানেন প্রভু?
বিষাক্ত গ্যাস।
কাম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, ফকল্যান্ড, আর্জেনটিনা। জার্মানি ফেঁড়ে দু-ভাগ। ভারত সীমান্তে পাকিস্তানের ঠুসঠাস। চিন আবার মাকর্সকে বাতিল করে দিলে। আমেরিকায় সঙ্গে দোস্তি। আপনার সাধের ইংরেজ, যাদের কিংডামে সূর্য অস্ত যেত না, সেখানে কী অবস্থা! থ্যাচারকে তো প্রায় শেষ করেই দিয়েছিল। মাইনাররা ধর্মঘট করে বসে আছে। আয়াল্যান্ড তেড়ে-তেড়ে আসছে। ডিকটেটাররা মানুষ ধরছে আর কোতল করে দিচ্ছে। আর আপনার প্রিয় আফ্রিকা।
আমার প্রিয়?
প্রভু, প্রথম মানুষকে তো আপনি আফ্রিকাতেই ফেলেছিলেন। মানুষের জন্মভূমি।
তা অবশ্য ঠিক। দুর্গম স্থানেই আমি বীজ বপন করেছিলুম। ইচ্ছে করেই। ধীরে, ধীরে, ধীরে, ধীরে, মরতে মরতে। মারতে মারতে, মানুষ অসভ্যতা থেকে সভ্যতার আলোতে আসুক। এই ছিল আমার প্ল্যান।
তা আফ্রিকার কী হয়েছে!
প্রভু, আপনার টেলিস্কোপে একবার ফোকাস করুন না, দেখুন না ইথিওপিয়ায় কী হচ্ছে।
জানি। জানি। জানি রে বাপু। বৃষ্টি নেই, দুর্ভিক্ষ, অনাহার, কঙ্কালসার মানুষ, ধুকছে, মরছে। মানুষের উদাসীনতায় মানুষ মরছে। জানি। আমি জানি সব।
পরমেশ্বর পায়চারি শুরু করলেন। হাত দুটো পেছন দিকে মোড়া। মাথায় একমাথা রূপালি চুল। গায়ের রং উত্তপ্ত তামার মতো। চোখের বর্ণ নীল। স্বর্ণ বর্ণ দন্তসারি। কী ভীষণ রূপ!
মহেশ্বর বললেন, কেন এমন করেন প্রভু? পৃথিবী তো কারুর বাপের সম্পত্তি নয়। কিছু মানুষ ভোগ করবে। আর কিছু মানুষ ভোগ্য হবে। কেন! কেন এই অবিচার?
পরমেশ্বর পায়চারি থামালেন। ঘন নীল দৃষ্টি মেলে মহেশ্বরের দিকে তাকিয়ে বললেন, কেন বলো তো! কেন এমন করি?
কী জানি প্রভু! মানুষ তো বলে, আপনি নাকি কবে কখন তাদের বলে এসেছেন, যে করে আমার আশ, আমি করি তার সর্বনাশ।
সে তো ওদের কথা। আসল রহস্যটা কী?
যদি বলি আমিই শয়তান। তোমরা এতকাল যাকে পরমেশ্বর ভেবে এসেছ, আসলে সে ছদ্মবেশী শয়তান। জীবিতের রাজত্বের মালিক হল শয়তান। মৃত্যুর রাজা ঈশ্বর। যোজন-যোজন ব্যাপী শূন্যতা। গ্রহ নেই, তারা নেই, অসীম অন্ধকার। সেখানে বসে আছেন তোমাদের ঈশ্বর। জীবন মানে কি মহেশ্বর? জন্ম আর মৃত্যু। ভোগ অথবা দুর্ভোগ। রোগ, শোক, জরা, ব্যাধি। জীবন মানে সংঘর্ষ। জীবন মানে বেঁচে থাকার শয়তানি কৌশল। আমার এই নীল চোখের দিকে তাকিয়ে দেখো। বিষাক্ত নীল। আমার বুকে হাত রেখে দেখো, হৃদয় নেই। আমার কোনও অনুভূতি নেই। মহেশ্বর, তোমাদের ঈশ্বর পরাভূত। তিনি শুধু কোলে তুলে নেন। কোল থেকে যেখানে নামান সে হল আমার এলাকা।