প্রভু সভ্য মানুষেরা সোমরসকে অ্যাপেটাইজার বলে। আমি কলকাতায় গিয়ে এই শব্দটি শিখে এসেছি। সেবনে চনমনে খিদে হয়। মেজাজ শরিফ হয়। পার্বতীর ভাণ্ডারে কয়েক বোতল বিলাইতি আছে।।
সে আবার কী? আমাদের আবার দিশি-বিলিতি কী?
আছে প্রভু আছে। বিলেতে আপনি গড। দেশে আপনি ঈশ্বর। তা সেই গডের দেশের চোলাইটি বড় মধুর। সেবনে মনে হবে, জিভ ফুড়ে একটি ধারাল তলোয়ার চলে গেল পেটে। হয়ে যাক প্রভু। তারপর একটু চিকেন চাওমিন। চিলিচিকেন। মাটন আফগানি।
এসব বিজাতীয় বস্তু, এসব বিদঘুঁটে, বিকট বস্তু তুমি পাচ্ছ কোথা থেকে?
সবই আমার সুগৃহিণীর কল্যাণে। বারোয়ারি সেরে আসার সময়, কাস্টমসকে ফাঁকি দিয়ে কয়েক বোতল স্মাল করে এনেছে। আর এনেছে খানদুই রান্নার বই। ফাটাফাটি ব্যাপার। মানস সরোবরে হংস মেরে, সে যা বস্তু হচ্ছে। জিভে পড়া মাত্রই সমাধি।
পরমেশ্বর চমকে উঠলেন, সে কী হে! তোমরা মানস-সরোবরের হংস মেরে হাওচাও করে। পেটায় নমঃ করছ? ও যে পরমহংস।।
প্রভু হাওচাও নয়, চাওমিন। আমরা যে এখন মহাচিনের এলাকায় চলে গেছি। তারা আবার কমুনিস্ট। ধর্ম-টর্ম মানে না প্রভু। ওদের কাছে আপনার অস্তিত্ব নেই।
তাতে কী হয়েছে। তার মানে ওরা বৈদান্তিক। আমার প্রিয় পুত্র শঙ্করের অনুগামী।
না প্রভু। সোহহংবাদী নয়। পুরোপুরি মানুষ। অঙ্গুষ্ঠ প্রমাণ আত্মপুরুষের ধার ধারে না। তিনটি যন্ত্রের কারবারি। রাষ্ট্র যন্ত্র, উৎপাদন যন্ত্র এবং শ্রমিক। খাটো খাও বয়েস হলে ফুটে যাও।
অসহ্য তোমার ভাষা। আমার আর সহ্য হচ্ছে না।
প্রভু, মানুষের কবি লিখেছিলেন, জিভ দিয়েছেন যিনি, আহার দেবেন তিনি। তিনি মানে আপনি। আমি বলছি, বাড়ি দিলেন যিনি, রক বানালেন তিনি। প্রভু সেই রকের ভাষার আর রক কালচারের জয় জয়কার সর্বত্র। রক থেকে রাজনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতির রূপ-রেখা শিক্ষা-দীক্ষা সবই উঠছে। রক যেন বিষ্ণুর নাভীপদ্ম। ইংল্যান্ড, আমেরিকায় চলেছে রক-এন-রোল। সে কী ভীষণ সোরগোল। পার্বতী, তোমার ভিডিওতে সেইটা চাপাও না গো, রক, রক, রক।
পার্বতী রিমোট কন্ট্রোল ব্যবহার করলেন। শোলের জায়গায় শুরু হল প্রথমে ওসিবিসা। পরমেশ্বরের পিলে চমকে গেল। কৈলাসের গা বেয়ে হিমবাহ নেমে গেল, গুড়গুড় করে। বিদ্যুৎ চমকে উঠল খিলিখিলি করে। পরমেশ্বর চিৎপাত হয়ে পড়ে গেলেন বাঘছাল বিছানো শয্যার ওপর।
মহেশ্বর ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠলেন, দেখো-দেখো। প্রভুর থ্রম্বোসিস হল না তো?
পার্বতী বললেন, তোমার যে কবে বুদ্ধি পাকবে কত্তা! কত বেল পেকে গেল! সারা জীবন বেলতলায় বসে রইলে, তোমার বুদ্ধি কিন্তু পাকল না। মাথায় অত জটাজুট থাকলে বুদ্ধি কি আর পাকে! টাক তো আর পড়বে না? মাথাটা কামিয়ে ফেলো। যদি কিছু হয়?
আমি আবার কী করলুম?
বৃদ্ধ দেবতাকে কি এসব শোনাতে আছে! প্রভুর থ্রম্বোসিস হলে কী হবে?
তোমার যেমন বুদ্ধি গিন্নি! প্রভুর থ্রম্বোসিস হবে কী? ও তো হয়েই আছে। আমি বাঙাল হলে বলতুম।
কী বলতে?
যাক সে আর তোমার শুনে কাজ নেই। তুমি বরং মুখে একটু বিলিতি ব্র্যান্ডি ঢেলে দাও।
পার্বতী পরমেশ্বরের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়লেন। পরমেশ্বর মৃদু স্বরে বিড়বিড় করে বলছেন, জুজু, ওরে বাবা জুজু।
পার্বতী তাড়াতাড়ি ভিডিও বন্ধ করে দিলেন। কান ফাটানো শব্দ বন্ধ হয়ে সুন্দর এক নীরবতা নেমে এল। পরমেশ্বরের কপালে হাত বুলোতে-বুলোতে পার্বতী বলতে লাগলেন, প্রভু, ও জুজু নয়, ওর নাম ডাক পোট্যাটো। খুব ভালো ড্রাম বাজায়।
পরমেশ্বর চোখ খুললেন। ভীত কণ্ঠে জিগ্যেস করলেন, আমি কোথায়?
প্রভু আপনি কৈলাসে।
তুমি কে? তোমার ঠোঁট অত লাল কেন? তোমার চোখের পাতা অমন সোনালি কেন?
প্রভু, আমি পার্বতী। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়েছি। চোখের পাতায় আইল্যাশ রং। পৃথিবীর সেরা সুন্দরীরা এর চেয়ে কত সাজে। তাও তো আমি ভুরু প্লাক করিনি। চুল বয়-কাট করিনি। জিন্স পরিনি, গেঞ্জি চাপাইনি। বিশ্বসুন্দরীর পোশাকে দেখলে আপনি কী কলতেন প্রভু?
নির্ঘাত মরে যেতুম জননী।
আপনার যে মৃত্যু নেই প্রভু। অবুদ অবুদ অবুদ বছর আপনি শুধুই জীবিত থাকবেন। ছারপোকার মতো অসংখ্য মানুষ সৃষ্টি করে যাবেন আপন খেয়ালে। যে পিতার অসংখ্য সন্তান, সে পিতা কোনও সন্তানকেই মনে রাখে না। সন্তানও পিতাকে মনে রাখে না। নিজেদের মধ্যে চুলোচুলি খুনোখুনি হতে থাকে। বিষয় সম্পত্তি ভাগাভাগি হয়ে যায়। পাঁচিলের পর পাঁচিল ওঠে। বৃদ্ধ পিতা ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়ান। আর ওরাই বলে, ভাগের মা গঙ্গা পায় না।
ওরা কারা?
আপনার সন্তানেরা। সেই অমৃতের পুত্ররা।
পরমেশ্বর বড়-বড় চোখ মেলে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর চিৎকার করে বললেন, ওয়েটার হুইস্কি বোলাও।
মহেশ্বর বললেন, এ কী প্রভু! এ আপনি কী বলছেন? বাংলা ছবির নায়ক এই ডায়ালগ ছাড়ে।
মূর্খ মহেশ্বর, সে কে? সে তো আমিই।
এই তো। এই তো পথে আসুন প্রভু। এতক্ষণ তাহলে অভিনয় করছিলেন!
ধূর্ত মহেশ্বর, ধরেছ ঠিক। এই যে তুমি সংসারী হয়েও সংসার করো না, এও কি আধুনিক মানুষের লক্ষণ নয়!
হ্যাঁ প্রভু! আপনিও ঠিক ধরেছেন। একেই ওরা বলে, রতনে রতন চেনে, ভাল্লুকে চেনে শাঁকালু।
সবই তো আমার। আমিই তো সব। আমি সাধু, আমি শয়তান। আমি রাজ্য, আমিই প্রজা। আমি গণতন্ত্র, ধনতন্ত্র, আমি মিত্র, আমি অরীত্র, আমি সৎ, আমি অসৎ, আমি যুদ্ধ, আমি শান্তি।