ঘুমটা ছাঁত করে ভেঙে গেল। সকাল হয়ে গেছে। বেশ সকাল। এখনও কারোর ঘুম ভাঙেনি। মা শুয়ে, পাশে শিখা। মেঝেতে আদুরি। ওপাশের ঘরে বিরাজকাকু। আমি দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালুম। আকাশে সামান্য ভেঁড়া-ঘেঁড়া মেঘ। শরৎ এসে গেছে। মনে হল নীচের রাস্তায় অনেক লোক। আমাকে দেখতে পেয়ে কে একজন বলে উঠলেন–
ওই যে, ওই যে।
আমি অবাক হয়ে রাস্তার দিকে তাকালাম। বেশ কিছু মানুষ। কারুর বগলে ভাঁজ করা বাজারের ব্যাগ। কারুর হাতে খালি দুধের বোতল। আমাকে তাকাতে দেখে একজন প্রশ্ন করলেন কোনও খবর পেলে?
কী খবর?
কখন আসছেন?
কে আসছেন? আমি খুবই অবাক হয়ে গেছি।
কেন তোমরা শোনোনি! ভোরের খবরে রেডিয়োতে বলেছে তো।
কী বলেছে?
জনতা স্তব্ধ হয়ে গেছে। বিরাজকাকু আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, রেলিঙে কনুইয়ের ভর রেখে। বিরাজকাকু জিগ্যেস করলেন, কী খবর? আমরা তো শুনিনি।
সকলেই তখন সমস্বরে বলে উঠলেন, প্রখ্যাত নট চন্দ্রকুমার ও চন্দ্রকুমারী দার্জিলিঙের কাছে পথদুর্ঘটনায় নিহত। আমরা গভীর বেদনার সঙ্গে জানাচ্ছি…।
আর কোনও কথাই আমার কানে এল না। খুব একটা দুঃখ নয়, কেমন একটা বিস্ময়ে মন ছেলে গেল। কী আশ্চর্য স্বপ্ন। কত স্পষ্ট! দিঘির জলে ঢেউ মিলিয়ে আসছে। রাজার পোশাক গাছের ডাল থেকে বাতাসে উড়ে-উড়ে জলে পড়ছে। সাদা একটা সিগারেট লাইটার, লাল একটা সিগারেটের প্যাকেট। কানে ভেসে আসছে, মাঝরাতের স্তব্ধ প্রেক্ষাগৃহ থেকে বাবার কণ্ঠস্বরে সাজাহানের সেই বিখ্যাত সংলাপ–
চেয়ে দেখ এই সন্ধ্যাকালে ওই যমুনার দিকে, দেখ সে কী স্বচ্ছ! চেয়ে দেখ ওই আকাশের দিকে–দেখ সে কী গাঢ়! চেয়ে দেখ ওই কুঞ্জবনের দিকে–দেখ সে কী সুন্দর!
আর চেয়ে দেখ, ওই প্রস্তরীভূত প্রেমা, ওই অনন্ত আক্ষেপের আপ্লুত বিয়োগের অমর কাহিনি আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। এখন দিন, তবু মনে হচ্ছে গভীর রাত। আমার কাঁদতে ইচ্ছে করছে না, বাবারই এক বন্ধু, এক গুণমুগ্ধের মতো বলতে ইচ্ছে করছে–
হিরণ নদীর বিজন উপকূলে
আচম্বিতে পথের অবসান,
পরপারে নাম না-জানা গ্রাম।