বাবা ফ্যালফ্যাল করে বিরাজকাকুর মুখের দিকে শিশুর মতো তাকিয়ে রইলেন। ষাট পাওয়ারের আলোতে বাবার মুখটা যতখানি দেখতে পাচ্ছি তাতে মনে হচ্ছে, একটি আপনভোলা শিশু যেন, মাঝরাতে খাটের ধারে বসে আছে। ঘুম ভেঙে দেখছে মা কি করছে। বাবার একবার অসুখ করেছিল। যেদিন জ্বর ছেড়ে গেল সেদিন মা বাবাকে খাটের ধারে বসিয়ে গেঞ্জির ওপর তোয়ালে রেখে ঠান্ডা জলে মাথা ধুইয়ে দিলেন। উশকোখুশকো চুলে বাবা বসে আছেন। কিছু দূরেই মা থালায় ঝোল আর রুটি সাজাচ্ছেন। বাবা কেমন খিদে-খিদে মুখে তাকিয়ে আছেন। সেদিনের সেই মুখ আর আজকের এই মুখ। মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল।
বাবা খুব ধীরে ধীরে জিগ্যেস করলেন, কটা বাজল?
বিরাজকাকু বললেন, প্রায় তিনটে।
রাত শেষ হয়ে এল। এখুনি সকাল হবে। তাই না? সকাল হবে না? বাবা জানালার দিকে তাকালেন। যেন আলো খুঁজছেন। আকাশ এখনও অন্ধকার। শেষরাতের তারা সোনার টাকার মতো আকাশে ছড়িয়ে আছে। বাবা বললেন, ঘরের আলো নিভিয়ে দাও। দিনের আলোর পথ করে দাও। কে সেই মূর্খ লণ্ঠন জ্বেলে সূর্য খুঁজছে।
বিরাজকাকু আলোটা তাড়াতাড়ি নিভিয়ে দিলেন।
সেই অন্ধকার ঘরে বাবার সুন্দর গলায় গান শোনা গেল—
আমি সারা সকালটি বসে বসে এই
সাধের মালাটি গেঁথেছি।
আমি, পরাব বলিয়ে তোমারি গলায়
মালাটি আমার গেঁথেছি।
আমি সারা সকালটি করি নাই কিছু,
করি নাই কিছু বঁধু আর
শুধু বকুলের তলে বসিয়ে বিরলে
মালাটি আমার গেঁথেছি।
আগেও দেখেছি আজও দেখলাম শেষরাতে একটা পেঁচা ডাকবেই ডাকবে। ডেকে জানিয়ে দেবে দিন আসছে। রাত যেন টান-টান সভা সাজিয়ে বসে থাকে। জলসাঘরে জাজিমের মতো। ক্রমশ জমতে জমতে একসময় হালকা থেকে হালকা হয়ে মিছিলের মতো সরে যেতে-যেতে একেবারে মুছে যায়। পেঁচার ডাক শুনে বাবা চমকে উঠলেন। গান থেমে গেল। ঘরের চারপাশে তাকালেন। রাত ফিকে হতে চলেছে। বাবার নেশাও ফিকে হচ্ছে। আমাদের দেখতে পেয়েছেন।
বিরাজ তোমার ঘরে এরা কারা। তুমি কি বিয়ে করেছ?
বিরাজকাকু সামান্য হেসে বললেন, এরা তোমারই ছেলে মেয়ে ঋভু। দীপাকে তো তুমি মেরে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছ।
বাবার মুখটা কেমন যেন বেঁকে গেল। কি যেন মনে করার চেষ্টা করছেন। সেই রাত। সিঁড়ির ধাপে মা পড়ে আছেন। অসম্ভব রক্ত ঝরছে। চারদিক নিস্তব্ধ। শুধু ঘরের দেওয়ালে একটা ঘড়ি টিকটিক করছে। দূরে কল থেকে বালতিতে জল পড়ছে টিপটিপ করে।
বাবার মুখ দেখে মনে হল, সেই রাত তার চোখের সামনে ফিরে আসছে। মুখটা ভাঙতে ভাঙতে কান্নায় ভেঙে পড়ল। দু-হাতে মুখ ঢেকে বাবা আকুল হয়ে কাঁদছেন। এভাবে আমি কখনও কাউকে কাঁদতে দেখিনি। কিছু ভেঙে ফেলে এ যেন শিশুর অসহায় কান্না।
একটা কাক ডাকছে। দিনের প্রথম কাক। কী তীক্ষ্ণ, কর্কশ আওয়াজ।
» ০৪. বাবা অপরাধীর মতো মুখ করে
বাবা অপরাধীর মতো মুখ করে বসে আছেন। বিরাজকাকুর আজ আর অফিস বেরোনো হল না। গোটা আষ্টেক খালি চায়ের কাপ সারা ঘরের এখানে-ওখানে ছড়ানো। কোনওটায় চায়ের তলানির সঙ্গে সিগারেটের টুকরো আর ছাই। কোনওটায় পোড়া দেশলাই কাঠি। কোনওটায় অ্যাসপিরিনের ফেলে দেওয়া সাদা কাগজ। বাবা সকাল থেকে কাপের-পর-কাপ চা খাচ্ছেন। সিগারেটের-পর সিগারেট। ধোঁয়ায়-ধোঁয়ায় ঘর ছেয়ে গেছে। আমার আর শিখার সঙ্গে একটাও কথা বলেননি।
আমার বাবা হলেন রাতের মানুষ। দিনের আলোর কেমন যেন অসহায়। রাতের প্রাণী দিনের আলোর যেমন অস্বস্তি বোধ করে, বাবার চোখে মুখে ঠিক সেই রকম এক ধরনের অস্বস্তি। বিরাজকাকু একবার সেই রাতের প্রসঙ্গ তুলতে চেয়েছিলেন, বাবা চোখের সামনে হাত আড়াল করে বললেন, আমাকে ভুলতে দাও, ভুলতে দাও।
বাবা যেন চোখের সামনে আমার রক্তাক্ত মাকে দেখে শিউরে উঠলেন।
বেলা তিনটের সময় বাবা বললেন, বিরাজ একটা ট্যাক্সি ডাক।
কোথায় যাবে?
হাসপাতালে।
খুব ভালো কথা।
বিরাজকাকু ট্যাক্সি ডাকতে গেলেন। আমরা তখন রাস্তার দিকের বারান্দায়। বাবাকে চিরকালই কেমন যেন অচেনা মনে হয়। সকাল থেকে আজ যেন আরও বেশি অচেনা মনে হচ্ছে। আমার মায়ের চেয়ে কত বেশি স্বাস্থ্যবান, বলিষ্ঠ। কত বেশি যুবক! চোখ-মুখ যেন বড় বেশি কঠোর আর নিষ্ঠুর।
বাবা ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন। কেন দিলেন? বোধহয় একটু একা থাকতে চান নির্জনে। বাইরে থেকে আমি শুধু একবার গেলাসের আওয়াজ পেলুম ঠুন করে। কি জানি, কোনও ওষুধ খাচ্ছেন হয়তো।
শিখা ফিশফিশ করে বলল, বাবা আমাদের সঙ্গে কোনও কথা বলছে না কেন রে দাদা?
আমি কী করে বলব! আমি বাবার মনের খবর কতটুকু জানি। সে জানেন আমার মা।
বারান্দা থেকেই দেখলাম ট্যাক্সি আসছে।
বিরাজকাকু ওপরে এসে দরজায় টোকা মারলেন। ভেতর থেকে গম্ভীর গলায় বাবা বললেন দাঁড়া খুলছি।
বেশ কিছুক্ষণ পরে বাবা বেরিয়ে এলেন। পরনে ধুতি, পাঞ্জাবি। চোখে সোনালি চশমা। চোখ দুটো গোলাপি লাল। পায়ে চকচকে জুতো। বাবাকে দেখে আমার ভীষণ হাসি পেল মনে মনে। বাবা যেন বিয়ে করতে যাচ্ছেন।
বিরাজকাকু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কি তোরা রেডি তো!
বাবা যেন কেমন কুঁকড়ে গেলেন, ওরাও যাবে নাকি!
যাবে না? মাকে দেখতে যাবে না?
বাবা হঠাৎ একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন। তোমরা কি পুলিশে ডায়েরি করিয়েছ?