বিরাজকাকুকে দেখাশোনা করার জন্যে একজন রাঁধুনি আছেন। সেই ভরসাতেই আমাদের তুলে এনেছেন। বয়েস বেশি নয়। বিরাজকাকুর সঙ্গে সম্পর্কটা যেন আপনার লোকের মতো। তাল ঠুকে বললেন, রাতকা খানা লে আও।
আমার বাবাকে আমি কখনও এমন হাসিখুশি দেখিনি। সকালে বিরক্ত বিষণ্ণ। রাতে মাতাল।
বুঝলি বিনু। বিরাজকাকুর হাতে সিগারেট, তোর বাবাকে বুঝতে শেখ।
তার মানে?
শিল্পী মাত্রেই বড় একা।
আমরা তাহলে কী জন্যে আছি কাকু।
তোরা থেকেও নেই। তোরা অন্য গ্রহের মানুষ। জানিস কি?
কি জানিস?
আগামী রবিবার সাজাহানের শেষ অভিনয়। বই উঠে যাচ্ছে। ঐতিহাসিক নাটক আর পাবলিক স্টেজে চলবে না। এখন এসেছে আধুনিক নাটক। জোতদার মারা রাজনৈতিক নাটক। প্যানপ্যানে সামাজিক নাটক। আর এসেছে ড্যান্স। অভিনেতাদের যুগ শেষ। স্টেজ, লাইট, নাচ, কায়দা। তোর বাবার হতাশাটা কোথায় বুঝেছিস? যে লোকটা রাতের-পর-রাত পাদপ্রদীপের সামনে দাঁড়িয়ে দর্শকদের চমকে দিয়েছে, চোখের জলে ভাসিয়ে দিয়েছে, সেই লোকটি আর কয়েকদিনের পরেই শূন্যতার জগতে ফিরে আসবে। রাত আসবে, চোখের সামনে দর্শক থাকবে না, হাততালি থাকবে না, এনকোর, এনকোর চিৎকার থাকবে না। পরচুল, মেকআপ, গ্রিনরুম, আলো ঝলসানো আয়না, রং-তুলি কিছুই থাকবে না। নিঝুমরাত, চারটে দেওয়াল, একটা খাট, কয়েকটা চেয়ার, একফালি রাস্তা, ঝাঁপসা আলো, ছায়া ছায়া মানুষ, রিকশার ঠুনঠুন, সাজাহান তখন সত্যি-সত্যিই আগ্রার দুর্গে বন্দি! কে তখন ঔরংজীব? এই সমাজ, তোদের এই আধুনিক রুচি। তাই তো লোকটা মাঝে-মাঝেই খেপে উঠছে পাগলের মতো।
বাবা তো আধুনিক নাটকেও অভিনয় করতে পারে কাকু?
দূর পাগল, ক্ল্যাসিকাল গাইয়ের মেজাজে কি আধুনিক আসে রে পাগল।
তাহলে কী হবে?
তোর বাবা অতীতের স্মৃতি নিয়ে নাড়াচাড়া করবে আর তোরা মানুষ হয়ে উঠে সংসারের হাল ধরবি। তবে জানিস তো শিল্পীর ছেলেরা মানুষ হয় না।
কেন হয় না?
সংসার জ্বলতে থাকে, চরিত্ররা পুড়তে থাকে। শিল্পীর সংসার এক জতুগৃহ। তবু চেষ্টা করতে হবে। জয়ে, পরাজয়ে, জয়ে দুলতে-দুলতে ফঁক খুঁজতে হবে, পথ করে নিতে হবে। সাজাহান তো পড়েছিস। মনে পড়ে সেই অংশটা যেখানে মহামায়া যশোবন্তকে বলছে, চেয়ে দেখ ওই রৌদ্রদীপ্ত গিরিশ্রেণি দূরে ওই ধূসর বালুস্থূপ। চেয়ে দেখ ওই পর্বতস্রোতস্বতী যেন সৌন্দর্যে কাঁপছে। চেয়ে দেখ ওই নীল আকাশ যেন সে নীলিমা নিংড়ে বার কচ্ছে। তোকে চেয়ে-চেয়ে দেখতে হবে। দেখতে হবে ছায়ার দিকে নয়, রোদের দিকে। জীবন থেকে নিংড়ে বের করতে হবে আকাশের নীলিমা। নে ওঠ। খেয়ে আসি।
০৩. রাত তখন কটা হবে
রাত তখন কটা হবে, বলতে পারব না। মনে হয় মাঝ রাত। আমি মাকে স্বপ্ন দেখছিলাম। বিশাল চওড়া, একেবারে ফাঁকা একটা রাস্তায়, আমি আর আমার মা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছি। ভীষণ হাওয়া দিচ্ছে। মায়ের বয়েস যেন অনেকটা কমে গেছে। যেমন ছিল মায়ের প্রথম বয়েসের ছবিতে। মাথায় অনেক চুল ছিল। হাওয়ায় চুল উড়ছে। নীল শাড়ির আঁচল উড়ছে। আমার হাতে একটা সুটকেস। সামনের আকাশে সারি-সারি পাহাড়। পাহাড়ের কোলে ঘন সবুজ বন। কী সুন্দর যে জায়গাটা। পাশে মা। মায়ের মুখে সেই হারিয়ে যাওয়া হাসি।
ঘুম ভেঙে গেল। স্বপ্ন হারিয়ে গেল। কে যেন ভারী গলায় ডাকছেন, বিরাজ, বিরাজ। বিরাজকাকুর একটাই ঘর। খাটে শুয়ে আছি আমি আর শিখা। সোফা কাম বেডে কাকু শুয়ে আছেন চিত হয়ে। ঘুমের ঘোরেই শুনছি, কাকু দরজা খুলছেন। ঘরের আলো জ্বেলেছেন। চোখে আলো লাগছে। দরজা খুলতেই, গলাটা খুব চেনা মনে হল। বিরাজ বিরাজ।
বাবা। বাবার গলা। এত রাতে বাবা এখানে? বাবার কি তাহলে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই! সারারাত কলকাতার নির্জন পথে-পথে ঘুরতে-ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে, কুকুরের তাড়া খেয়ে, পুলিশের খোঁচা খেয়ে আশ্রয় খুঁজতে এখানে এসেছেন। নাকি সাজাহান এসেছেন ঔরংজীবকে মাঝরাতে খুন করতে। ভয়ে কাঠ হয়ে শুনছি, বিরাজকাকুর গলা,–আয়, আয় ভেতরে।
ভেতরে আসতে গিয়ে বাবার পা টলে গেল। দরজাটা ধরে সামলে নিলেন। ভীষণ একটা শব্দ হল। দরজার সঙ্গে দেওয়ালের ধাক্কা। শিখা ঘুমের ঘোরে চমকে উঠল। বাবা ঘরে ঢুকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সাজাহান নাটকের পঞ্চম দৃশ্যের সেই সংলাপ বলে উঠলেন, পৃথিবীর কি অন্তিম সময় ঘনিয়ে এসেছে জাহানারা? জাহানারা তো এখন বাড়ি গিয়ে মেক-আপ তুলে ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়েছে। জাহানারার সংলাপ কে বলবে? ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুহাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে বাবা সেই বিখ্যাত অভিনয়টা আর একবার দেখালেন, সত্যই তো, আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি নাকি? না-না-না। জানি পাগল হব না। ঈশ্বর! এই শীর্ণ দুর্বল, জরাজীর্ণ নেহাতই অসহায় সাজাহানকে দ্যাখো ঈশ্বর! তোমার দয়া হচ্ছে না? দয়া হচ্ছে না? আমি এমন কী পাপ করেছিলাম খোদা। মাথার দুপাশ থেকে হাত দুটো নামিয়ে হাঁটুর সামনে নামাজের ভঙ্গিতে উপুড় করে বাবা ধীরে ধীরে পেছোতে-পেছোতে সোফা কাম বেডে ধপাস করে শরীরটা ফেলে দিলেন। শরীরের ভারে স্প্রিং নেচে উঠল শব্দ করে।
আমার বাবার নামটা ভারী অদ্ভুত ঋভু। বিরাজকাকু খুব ধীরে-ধীরে বাবার নাম ধরে ডাকলেন, ঋভু।