মঙ্গলকাব্যের কবিরা সাধারণত যে-দেবতার নামে কাব্য লিখেছেন, সে-দেবতার ভক্ত ছিলেন। তাই কাব্যের শুরুতে সবাই বর্ণনা করেছেন তাঁরা কেনো কাব্য রচনা করলেন, সেকথা। সব কবি বলছেন একই রকম কথা। তাঁরা বলেছেন, দেবতা স্বপ্নে আদেশ দিয়েছেন আমাকে কাব্য লিখতে, তাই আমি কাব্য লিখছি। একথা কি আজ বিশ্বাস হয়? বিশ্বাস হয়।
এ ছিলো তখনকার রীতি, দেবতার কথা না বললে মানুষ কাব্য শুনবে না ভেবেই বোধ হয় কবিরা একথা বলতেন। সেকালে কাব্যের উদ্দেশ্য আজকের মতো ছিলো না, কাব্যের জন্যে কাব্য লেখার প্রচলন তখন ছিলো না, ধর্ম প্রচারের জন্যে সবাই কাব্য রচনা করতেন। তাই মধ্যযুগের সমস্ত সাহিত্য ধর্মভিত্তিক, দেবতাকেন্দ্রিক। দেবতার কথার ফাঁকে ফাঁকে এসেছে মানুষ।
চণ্ডীমঙ্গলের সোনালি গল্প
চণ্ডীমঙ্গলের আছে দুটি বেশ চমৎকার গল্প : একটি কালকেতু-ফুল্লরার, অন্যটি ধনপতিলহনা-খুলনার। চণ্ডীমঙ্গলের গল্প মধুর আনন্দের, বেদনার বদলে এ-গল্পে আছে সুখের কথা। বেদনা যা আছে মাঝেমাঝে, তা শুধু সুখ বাড়িয়ে দেয়ার জন্যে। কালকেতু-ফুল্লরার গল্পটি আমি বলবো। স্বর্গে বেশ সুখে ছিলো নীলাম্বর। ফুল তুলে শিবপুজো করে, নিজের স্ত্রী ছায়াকে ভালোবেসে সুখে সময় কাটাচ্ছিলো নীলাম্বর। কিন্তু ক্রমশ তার ভাগ্যাকাশে দুঃখের মেঘ দেখা দিতে লাগলো। চণ্ডীর ইচ্ছে হয়েছে পৃথিবীতে তার পুজো প্রচারের। কিন্তু কে করবে তার পুজো প্রচার? চণ্ডী এ-কাজে নীলাম্বরকে মনে মনে মনোনীত করলো। চণ্ডী তার স্বামী শিবকে বললো, নীলাম্বরকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দাও, সে পৃথিবীতে আমার পুজো প্রচার করবে। শিব বললো, বিনা অপরাধে আমি তাকে কী করে স্বর্গ থেকে বিদায় দিই? চণ্ডী মনে মনে পরিকল্পনা আঁটলো, সে নীলাম্বরকে পাঠাবেই। একদিন শিবপুজোর জন্যে বাগানে ফুল তুলছিলো নীলাম্বর। চণ্ডী সেখানে গেলো, নিজেকে বিষাক্ত কীটে রূপান্তরিত করলো, এবং নীলাম্বরের তোলা ফুলে গোপনে লুকিয়ে রইলো। ঘনিয়ে এলো নীলাম্বরের স্বর্গ থেকে বিদায়ের দিন। নীলাম্বর ফুল দিয়ে শিবপুজো করতে গেলে ফুলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা কীট শিবকে দংশন করলো। কীটের কামড়ে শিউরে উঠলো শিব, অভিশাপ দিলো নীলাম্বরকে, যাও পৃথিবীতে গিয়ে জন্ম নাও ব্যাধ হয়ে। শিবের অভিশাপে দেবতা নীলাম্বরের সব দেবত্ব বিলীন হয়ে গেলো। বেচারির নিজের কোনো অপরাধ ছিলো না, তবু দৈব দয়ায় তাকে চলে আসতে হলো এ-কষ্টভরা পৃথিবীতে। সে জন্ম নিলো ধর্মকেতু নামক এক ব্যাধের পুত্র হয়ে। অন্যদিকে তার স্ত্রী ছায়াও চলে এলো পৃথিবীতে অন্য এক ব্যাধের কন্যা হয়ে। নীলাম্বরের নাম হলো কালকেতু, আর ছায়ার নাম হলো ফুল্লরা।
কালকেতু ব্যাধের ছেলে, সুন্দর স্বাস্থ্যবান। বনের ভয়ঙ্কর পশুরা তার জ্বালায় অস্থির হয়ে উঠলো। তার বিয়ে হলো এগারো বছর বয়সে ফুল্লরার সাথে। পৃথিবীতেও তারা বেশ সুখে দিন কাটাতে লাগলো। কালকেতু ছিলো অসাধারণ শিকারী, তার নিক্ষিপ্ত শরে প্রতিদিন প্রাণ হারাতে লাগলো সংখ্যাহীন বনচর পশু। ছোটোখাটো দুর্বল পশুদের তো কথাই নেই, এমনকি বাঘসিংহরাও ভীত হয়ে উঠলো। বনে পশুদের বাস করা হয়ে উঠলো অসাধ্য। পশুরা ভাবতে লাগলো কী করে রক্ষা পাওয়া যায় এ-শিকারীর শর থেকে। সব পশু একত্র হয়ে ধরলো তাদের দেবী চণ্ডীকে; বললো, বাঁচাও কালকেতুর শর থেকে। চণ্ডী বললো, বেশ। শুরু হলো চণ্ডীর চক্রান্ত। কালকেতুকে অস্থির করে তুললো সে নানাভাবে। কালকেতু জীবিকা নির্বাহ করে পশু মেরে। একদিন সে বনে গিয়ে দেখলো বনে কোনো পশু নেই। চণ্ডী সেদিন ছল করে বনের পশুদের লুকিয়ে রেখেছিলো। সেদিন কালকেতু কোনো শিকার পেলো না, না খেয়ে তাকে দিন কাটাতে হলো। পরদিন আবার সে তীরধনুক নিয়ে শিকারে গেলো। পথে দেখলো সে একটি স্বর্ণগোধিকা অর্থাৎ গুইসাপ। এজিনিশটি অলক্ষুণে; তাই কালকেতু চিন্তিত হয়ে পড়লো। রেগে উঠলো কালকেতু। সে গোধিকাটিকে বেঁধে নিলো। মনে মনে ভাবলো, আজ যদি কোনো শিকার না মেলে তবে এটিকেই খওয়া যাবে।
সেদিন কোনো শিকার মিললো না তার। সে গোধিকাটিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এসে দেখলো তার প্রতীক্ষায় বসে আছে ফুল্লরা। কিছু রান্না হয় নি। গতকাল তারা খেতে পায় নি, আজো খেতে পাবে না। কালকেতুকে শিকারহীন ফিরে আসতে দেখে প্রায় কেঁদে ফেললো ফুল্লরা। কালকেতু ফুল্লরাকে বললো, এ-গোধিকাটিকে আজ রান্না করো, পাশের বাড়ির বিমলাদের থেকে কিছু খুদ এনে রাঁধ, আমি হাটে যাচ্ছি। এ বলে কালকেতু চলে গেলো। তার পরেই এলো বিস্ময়, ঘটলো অভাবনীয় ঘটনা। গোধিকাটি আসলে ছিলো দেবী চণ্ডী। ফুল্লরা বিমলাদের বাড়িতে যেতেই সে এক অপরূপ সুন্দরী যুবতীর রূপ ধারণ করলো। বিমলাদের বাড়ি থেকে ফিরে এসে নিজের আঙ্গিনায় এক অপূর্ব সুন্দরী যুবতীকে দেখে অবাক হয়ে গেলো ফুল্লরা। সাথে সাথে হলো ভীতও। ফুল্লরা তাকে তার পরিচয় জিজ্ঞেস করলো। দেবী চণ্ডী ছলনাময়ী, শুরু করলো তার ছলনা। সরলভাবে বললো, কালকেতু আমাকে নিয়ে এসেছে।
একথা শুনে ভয় পেলো ফুল্লরা। এতোদিন সে স্বামীকে নিয়ে সুখে ছিলো, ভাবলো এবার বুঝি তার সুখের দিন ফুরোলো। ফুল্লরা অনেক বুঝালো যুবতীটিকে। বললো, তুমি খুব ভালো, তুমি খুব সুন্দরী। তুমি তোমার নিজের বাড়িতে ফিরে যাও, নইলে মানুষ নানা কথা বলবে। কিন্তু যুবতী ফুল্লরার কথায় কোনো কান দিলো না; বললো, আমি এখানে থাকবো। এতে কেঁদে ফেললো ফুল্লরা, দৌড়ে চলে গেলো হাটে কালকেতুর কাছে। বললো সব কথা। শুনে কালকেতুও অবাক। সে বাড়ি ফিরে এলো ফুল্লরার সাথে, এবং যুবতীকে দেখে অবাক হলো। কালকেতু বার বার তাকে বললো, তুমি চলে যাও। কিন্তু কোনো কথা বলে না যুবতী। তাতে রেগে গেলো কালকেতু, তীরধনুক জুড়লো, যুবতীকে সে হত্যা করবে। যখন কালকেতু তীর নিক্ষেপ করতে যাবে তখন ঘটলো আরো বিস্ময়কর এক ঘটনা। এবার দেবী চণ্ডী নিজের মূর্তিতে দেখা দিলো। সে-আশ্চর্য সুন্দরী মেয়ে পরিণত হলো দেবী চণ্ডীতে। চোখের সামনে এমন অলৌকিক ব্যাপার ঘটতে দেখে ব্যাধ কালকেতু মুগ্ধ হয়ে গেলো। চণ্ডী বললো, তোমরা আমার পুজো প্রচার করো, আমি তোমাদের অজস্র সম্পদ দেবো, রাজ্য দেবো। রাজি হলো কালকেতু-ফুল্লরা। অবশ্য দেবীর কথা প্রথমে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারে নি ফুল্লরা, কেননা এ ছিলো অভাবিত। দেবী সাথে সাথে সাত কলস ধন দান করলো। কালকেতু ছিলো একটু বোকাসোকা মানুষ। অভাবিত ধন পেয়ে কালকেতু বোকার মতো ব্যবহার করেছে, তার চমৎকার বিবরণ দিয়েছেন কবি মুকুন্দরাম। কিছু অংশ তুলে আনছি :