১২০০ থেকে ১২০৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করে বাঙলায় আসে মুসলমানেরা। অনেকে মনে করেন মুসলমানেরা এতো অত্যাচার উৎপীড়ন চালিয়েছিলো যে কারো মনে সাহিত্যের কথা জাগে নি। তাই এ-সময়ে বাঙলা ভাষা সাহিত্যহীন মরুভূমি। কিন্তু এ-যুক্তি মানা যায় না। কেননা দেড়শো বছর ধরে রক্তপাত চলতে পারে না। তাহলে মানুষ রইলো কী করে? মুসলমানেরা তো বাঙালিদের মারার জন্যেই আসে নি, তারা এসেছিলো রাজত্ব করতে। এছাড়া পরবর্তীকালে দেখা গেছে মুসলমান রাজারা বাঙলা সাহিত্যকে বেশ উৎসাহ দিচ্ছে। যারা পরে সাহিত্য সৃষ্টিতে উৎসাহ দিলো, তারাই আগে সাহিত্যকে দমিয়ে দিয়েছিলো এরকম হতে পারে না। বাঙলা সাহিত্যকে ধ্বংস করার জন্যে তো আর তারা আসে নি। তাহলে সাহিত্য হলো না কেননা, কেননা আমরা পাই না একটিও কবিতা, একটিও কাহিনীকাব্য? আগে সাহিত্য লিখিত হতো না, মুখে মুখে গাওয়া হতো। তখন ছাপাখানা ছিলো না, পুথি লিখিয়ে নেয়ায় ছিলো অনেক অসুবিধা। তাই কবিরা মুখে মুখে রচনা করতেন তাঁদের কবিতা, কখনো তা হয়তো হতো ছোটো আয়তনের, কখনো বা হতো বিরাট আকারের। রচনা করে তা স্মরণে রেখে দিতেন, নানা জায়গায় গাইতেন। কবিতা যারা ভালোবাসতো তারাও মুখস্থ করে রাখতো কবিতা। এভাবে কবিতা বেঁচে থাকতো মানুষের স্মৃতিতে, কণ্ঠে। আজকের মতো ছাপাখানার সাহায্য সেকালের কবিরা লাভ করেন নি। তাই যে-কবিতা একদিন মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যেতো, সে-কবিতা হারিয়ে যেতো চিরকালের জন্যে।
তাহলে চর্যাপদকে লেখা অবস্থায় পাওয়া গেলো কেমনে? এ-বইটি কিন্তু বাঙলায় পাওয়া যায় নি, পাওয়া গেছে নেপালে। নেপালের ভাষা বাঙলা নয়। বাঙলা ভাষাকে ধরে রাখার জন্যে প্রয়োজন হয়েছিলো একে বর্ণমালায় লিখে রাখার। তাই অন্ধকার সময়ের রচনার সম্বন্ধে আমরা অনুমান করতে পারি যে এ-সময়ে যা রচিত হয়েছিলো, তা কেউ লিখে রাখে নি, তাই এতোদিনে তা মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে গেছে। তবু বিস্ময় থেকে যায়, কারণ দেড়শো বছর ধরে কোনোও কবিতা লিপিবদ্ধ হলো না, এ কেমন? এর পরে তো আমরা বাঙলা সাহিত্যের ধারাবাহিক ইতিহাস পাচ্ছি, আমাদের সামনে আসছে একটির পরে একটি মঙ্গলকাব্য, আসছে পদাবলির ধারা। ১৩৫০ সালের পরেই আসেন মহৎ মহৎ কবিরা; আসেন বড়ু চণ্ডীদাস তাঁর শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য নিয়ে, এবং আসর মাতিয়ে তুলেছেন আরো কতো কবি। অন্ধকার যুগ’ আমাদের কাছে এক বিস্ময়। এ-সময়টা বাঙলা সাহিত্যের কৃষ্ণগহ্বর।।
এ-বিস্ময় আর অন্ধকার থেকে উদ্ধার পাবার জন্যে কেউ কেউ অন্য রকম কথা বলেছেন। তাঁরা বলেন, চর্যাপদকে যদি আমরা বাঙলা না বলি, তাহলে অন্ধকার যুগ বলে কিছু থাকে না, বাঙলা সাহিত্য শুরু হয় চতুর্দশ শতক থেকে। কিন্তু চর্যাপদ যে বাঙলা, তা
কী করে ভুলে যাই! চর্যাপদ-এ বাঙলা ভাষার জন্মের পরিচয় পাই, মধ্যযুগের রচনায় পাই বাঙলা ভাষার বিকাশের পরিচয়। মাঝখানে থেকে যায় একটি অন্ধকারের পর্দা, জমাট অন্ধকার, যার আবির্ভাবের কোনো ঠিক কারণ কেউ দেখাতে পারবেন না।
প্রদীপ জ্বললো আবার : মঙ্গলকাব্য
এক সময় অন্ধকার যুগের অবসান হয়, আবার জ্বলে দীপশিখা বাঙলা সাহিত্যের আঙ্গিনায়। এবার যে-দীপ জ্বলে ওঠে, তা আর কোনো দিন নেভে নি, সে-শিখা ধারাবাহিক অবিরাম জ্বলে যেতে থাকে। অন্ধকার যুগের অবসানে নতুন নতুন সাহিত্য রচিত হতে থাকে বাঙলা ১৮ লাল নীল দীপাবলি ভাষায়; অসংখ্য কবি এসে হাজির হন বাঙলা সাহিত্যের সভায়। তাঁদের কণ্ঠে শুধু গান আর গান। কবিদের বীণা বেজে ওঠে নানা সুরে। শুরু হয় বাঙলা সাহিত্যে মধ্যযুগ; চতুর্দশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ থেকে। এ-মধ্যযুগের শুরুতেই রচিত হয় একটি দীর্ঘ অসাধারণ কাব্য, যার নাম শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। এ-কাব্যটি যিনি রচনা করেন, তাঁর নাম বড়ু চণ্ডীদাস। একাব্যটির সংবাদও আমাদের অনেক দিন জানা ছিলো না। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে কাব্যটি বাঁকুড়ার এক গৃহস্থের গোয়ালঘর থেকে উদ্ধার করেন শ্রীবসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ। কাব্যটির নায়কনায়িকা কৃষ্ণ ও রাধা। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর কবি বড় চণ্ডীদাস বাঙলা ভাষার প্রথম মহাকবি। তিনি আমাদের প্রথম রবীন্দ্রনাথ।
কিন্তু মধ্যযুগ যে-কাব্যগুলোর জন্যে বিখ্যাত, সেগুলোকে বলা হয় মঙ্গলকাব্য। মধ্যযুগের শুরু থেকে অসংখ্য কবি রচনা করতে থাকেন মঙ্গলকাব্য, আর এ-রচনা শেষ হয়। মধ্যযুগের শেষপ্রান্তে এসে। মঙ্গলকাব্য হচ্ছে মধ্যযুগের উপন্যাস; এ-কাব্যগুলোতে কবিরা অনেক বড় বড়ড়া কাহিনী বলেছেন। তবে এ-কাহিনী আমাদের মতো মানুষের কাহিনী নয়, এগুলো দেবতাদের কাহিনী। দেবতারা জুড়ে থাকে এ-কাব্যগুলোর অধিকাংশ, মানুষ আসে গৌণ হয়ে। এ-কাব্যগুলোকে কেনো বলা হয় মঙ্গলকাব্য? কেউ বলেন, দেবতাদের কাছে মঙ্গল কামনা করে এ-কাব্যগুলো রচিত হয়েছে বলে এগুলোর নাম মঙ্গলকাব্য। আবার কেউ বলেন, এ-কাব্যগুলো গাওয়া হতো এক মঙ্গলবার থেকে আরেক মঙ্গলবার পর্যন্ত, তাই এগুলোর পরিচয় মঙ্গলকাব্য বলে। আবার অনেকে বলেন, এগুলো গাওয়া হতো যে-সুরে, সে-সুরের নাম মঙ্গল; তাই এগুলোর নাম মঙ্গলকাব্য। এগুলোকে আমরা কাহিনীকাব্য বলতে পারি।
প্রায় পাঁচশো বছর ধরে মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছে। নানা শ্রেণীর মঙ্গলকাব্য রয়েছে বাঙলা সাহিত্যে। এ-কাব্যগুলোর রয়েছে অনেকগুলো সাধারণ রূপ। যেমন : প্রতিটি কাব্যেই দেখা যায় স্বর্গের কোনো এক দেবতা নিজের কোনো অপরাধের জন্যে শাপগ্রস্ত হয়। তখন তাকে স্বর্গে আর বসবাস করতে দেয়া হয় না। সে এসে জন্ম নেয় পৃথিবীতে কোনো সাধারণ মানুষের সাধারণ ঘরে। তার স্ত্রীও চলে আসে মাটির পৃথিবীতে, জন্ম নেয় কোনো সাধারণ মানুষের কন্যা হয়ে। এক সময় তাদের বিয়ে হয়। স্বর্গের কোনো দেবতা এসে হাজির হয় তাদের সামনে, বলে, আমার পুজো তোমরা প্রচার করো পৃথিবীতে। তারা সে-দেবতার পুজো প্রচার করে মানুষের মধ্যে, এবং এভাবে তারা কাটিয়ে ওঠে তাদের শাপ। অবশেষে একদিন মহাসমারোহে তারা আবার স্বর্গে ফিরে যায় দেবতার মতো।