এ-শতকে ফলেছে ছোটগল্পের অসাধারণ শস্য। বাঙলা ভাষায় ছোটগল্পের সূচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনিই ঘটিয়েছিলেন এর বিকাশ। মানুষের জীবন ও প্রকৃতি নিয়ে একরাশ অসামান্য গল্প রচনা করেন তিনি। তাঁর গল্পে ঘটে জীবন ও শিল্পের বিস্ময়কর সমন্বয়। উনিশশতকের শেষ দশকে প্রাণ ভরে গল্প লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, এবং তাতে ভরে ওঠে পাঠকদের প্রাণ। রবীন্দ্রনাথের গল্প সংগৃহীত হয়েছে গল্পগুচ্ছ-এর (১৯২৬) তিনটি খণ্ডে। বিশশতকের প্রধান ঔপন্যাসিকেরাও জীবনের বিচিত্র দিক নিয়ে লিখেছেন গল্প। এসব গল্পে টুকরোটুকরো হয়ে ধরা পড়েছে আমাদের জীবন। সম্ভবত বাঙলা উপন্যাসের চেয়ে বাঙলা ছোটগল্প অনেক বেশি শিল্পসফল। বাঙলি প্রতিভা উপন্যাসের বিশালতায় যতোটা বিচ্ছুরিত হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি বিচ্ছুরিত হয়েছে ছোটগল্পে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সাহিত্যজগতে প্রবেশ করেছিলেন ছোটগল্প নিয়ে। তাঁর প্রথম গল্প মন্দির’ সেকালের একটি গল্প-প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলো। পুরস্কারটির নাম কুন্তলীন-পুরস্কার। মন্দির’ বেরিয়েছিলো ১৯০৩-এ। তারপর বহু গল্প লিখেছেন শরৎচন্দ্র। তার গল্প ছোটগল্পের সংজ্ঞাটিকে ঠিক মেনে চলে নি; তবে আলোড়িত করার মতো উপাখ্যান উপহার দিয়েছে। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় প্রচুর গল্প লিখেছেন। তাঁর গল্পগ্রন্থ হচ্ছে সোড়শী (১৯০৬), গল্পাঞ্জলি (১৯১৩), গল্পবীথি (১৯১৬), জামাতা বাবাজী (১৯৩১)। নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত লিখেছেন প্রচুর গল্প। তাঁর প্রথম গল্পের নাম ঠানদিদি (১৯১৮)। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের খ্যাতির মূলে রয়েছে তাঁর ছোটগল্প। ১৩২৯-এ ‘রেজিং রিপোর্ট’ নামে তার একটি গল্প বেরোয়; এবং তীব্র সাড়া জাগায়। তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র ও বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন কিছু অসামান্য অবিনাশী গল্প। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পগ্রন্থ হচ্ছে জলসাঘর (১৯৩৭), রসকলি (১৯৩৮), বেদেনী (১৯৪০), নারী ও নাগিনী, ইমারত। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পগ্রন্থ অতসী মামী (১৯৩৫), প্রাগৈতিহাসিক (১৯৩৭), সরীসৃপ (১৯৩৯), আজ কাল পরশুর গল্প (১৯৪৬), ছোটবকুলপুরের যাত্রী (১৯৪৯)। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পগ্রন্থ মেঘমল্লার (১৩৩৮), মৌরীফুল (১৩৩৯), কিন্নর দল (১৩৪৫)। বুদ্ধদেব বসুর গল্পগ্রন্থ হচ্ছে অভিনয় অভিনয় নয় ও অন্যান্য গল্প (১৯৩০), এরা ওরা এবং আরো অনেকে (১৯৩২), ঘরেতে ভ্রমর এলো (১৯৩৫)। তাঁর গল্পের একটি চমৎকার সংকলনের নাম ভাসো আমার ভেলা। প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্পগ্রন্থ পঞ্চশর (১৩৩৬), বেনামী বন্দর (১৩৩৭), মৃত্তিকা (১৯৩২)।
বিশশতকের দুজন অতুলনীয় গদ্যশিল্পীর কথা মনে পড়ে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১-১৯৫১) ও প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৮-১৯৪৬)। দুজনই রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়; এবং বিশশতকের দুই প্রধান বাঙালি, ও প্রতিভা। তাঁরা কবিতা বা গল্প বা উপন্যাস সৃষ্টি করে প্রধান হন নি। তাঁরা গল্প লিখেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন। কিন্তু তাঁরা অমর হয়ে আছেন তাঁদের অনন্য গদ্যশিল্পের জন্যে। অবনীন্দ্রনাথ মানে গদ্য, প্রমথ চৌধুরী মানে গদ্য। বিস্ময়কর গদ্য। অবনীন্দ্রনাথ আধুনিক কালের একজন প্রধান চিত্রকর। ছবি আঁকতে আঁকতে তিনি প্রবেশ করেছিলেন সাহিত্যে; এবং সাহিত্যে একে গেছেন চিত্রের পর চিত্র। তাঁর গল্প, বক্তব্য ইত্যাদির প্রাণ যেনো তার ভাষা। ১৮৯৫-এ বেরোয় অবনীন্দ্রনাথের ক্ষীরের পুতুল ও শকুন্তলা। রূপকথার রূপে ভরে আছে বই দুটি। তাঁর অন্যান্য বই বাংলার ব্রত (১৯০৯), রাজকাহিনী (১৯০৯), ভূতপেত্নীর দেশ (১৩২২), খাতাঞ্চির খাতা (১৩২৩), আলোর ফুলকি (১৯৪৭), বুড়ো আংলা (১৩৪১), বাগেশ্বরী শিল্পপ্রবন্ধাবলী (১৯৪১), ঘরোয়া (১৩৪৮), জোড়াসাঁকোর ধারে (১৩৫১), আপন কথা (১৩৫৩)। বিস্ময়কর এসব বই। কৈশোরেই এগুলোর অধিকাংশ পড়ে ফেললে জীবন সোনায় ভরে উঠতে পারে। প্রমথ চৌধুরী বিখ্যাত হয়ে আছেন চলতি রীতির প্রধান প্রবক্তা হিশেবে। তার ছদ্মনাম ছিলো বীরবল। সবুজপত্র নামে একটি প্রভাবশালী পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন তিনি ১৯১৪ অব্দে। এটিতে তিনি চলতি ভাষাকে সাহিত্যের বাহন হিশেবে ব্যবহারের আন্দোলন শুরু করেন। সফল হন। তবে শুধু চলতিরীতির প্রবক্তা হিশেবে নয়, অনন্য গদ্যরীতির জন্যে অবিস্মরণীয় প্রমথ চৌধুরী। তিনি গল্প লিখেছেন, কবিতাও লিখেছেন; কিন্তু বাঙলা সাহিত্যে তাঁর অমূল্য অবদান তাঁর প্রবন্ধাবলি। সনেট-পঞ্চাশৎ(১৯১৩), ও পদ-চারণ (১৯১৯) তাঁর কাব্যগ্রন্থ। চার ইয়ারী কথা (১৯১৬) তাঁর গল্পগ্রন্থ। প্রবন্ধসংগ্রহ নামে দু-খণ্ডে সংগৃহীত হয়েছে তাঁর প্রবন্ধ। অনন্য তাঁর গদ্য।
নাটকে বাঙলা সাহিত্য গরিব। উনিশশতকের দ্বিতীয় অংশে বেশ কয়েকজন বেশ বড়ো নাট্যকার দেখা দিয়েছিলেন। বিশশতকে কি তেমন দেখা দিয়েছে? মনে হয় দেয় নি। মধুসূদন অলীক কুনাট্যের কথা বলেছিলেন। রাঢ়ের বঙ্গে এখনো লোকজন তাতে মজে। বাঙলার জীবনে বোধহয় নাট্যগুণ নেই, নাটকীয়তা থাকলেও। নাটক রচিত হয় মঞ্চস্থ হওয়ার জন্যে। মঞ্চে সফল হওয়া নাটকের একটা বড়ো গুণ। তবে মঞ্চে সফল হলেই নাটক উৎকৃষ্ট হয় না। বরং মঞ্চে সফল হতে গিয়েই ব্যর্থ হয় বাঙলার অধিকাংশ নাটক। বাঙলা ভাষায় লেখা অধিকাংশ মঞ্চসফল নাটক সাহিত্য হিশেবে নিকৃষ্ট। বিশশতকে নাটকের ক্ষেত্রে খুব বড়ো প্রতিভা বেশি চোখে পড়ে না। বিশশতকে রবীন্দ্রনাথই শ্রেষ্ঠ নাট্যকার। তাঁর নাটক অবশ্য জীবনচিত্রণ নয়, ভাবচিত্ৰণ। কিন্তু তাঁর নাটক সাহিত্যসৃষ্টি হিশেবে অসামান্য ব’লে উৎকৃষ্ট নাটক হিশেবে গণ্য। বেশ পরে বুদ্ধদেব বসু এমন উন্নত সাহিত্যিক নাটক লিখেছেন। এ ছাড়া সাহিত্যিক গুণে আর কারো নাটক বিশেষ সমৃদ্ধ নয়। ‘ রবীন্দ্রনাথ প্রচুর নাটক, কাব্যনাট্য ও নাট্যকাব্য লিখেছেন। এগুলোর সবই কবির হাতের লেখা। গীতিনাট্য, কাব্যনাট্য, সাংকেতিক-রূপক নাটকে তিনি অনন্য। তাঁর নাট্যসাহিত্যে রয়েছে বাল্মীকিপ্রতিভা (১২৮৭), কালমৃগয়া (১২৮৯), প্রকৃতির প্রতিশোধ (১২৯১), মায়ার খেলা (১২৯৫), বিসর্জন (১২৯৬), মালিনী (১৩০৩), রাজা (১৩১৭), অচলায়তন (১৩১৮), ডাকঘর (১৩১৮), মুক্তধারা (১৩২৯), রক্তকরবী (১৩৩১), চিরকুমার সভা (১৩৩২), বসন্ত (১৩৩৩), নটীর পূজা (১৩৩৩), কালের যাত্রা (১৩৩৯), তাসের দেশ (১৩৪০), চণ্ডালিকা (১৩৪০), বাঁশরী (১৩৪০), চিত্রাঙ্গদা (১৩৪২)। বিশশতকে আরো অনেকে নাটক লিখেছেন; কিন্তু তাঁদের বড়ো নাট্যকার বলা যায় না। তবে দু-একজনের দু-একটি নাটক উল্লেখযোগ্য। যেমন, মন্মথ রায়ের কারাগার, বিজন ভট্টাচার্যের নবান্ন (১৯৪৪)। ষাটের দশকে বুদ্ধদেব বসু লেখেন কয়েকটি অতুলনীয় কাব্যনাটক। তাঁর তপস্বী ও তরঙ্গিনী, কলকাতার ইলেকট্রা কাব্যগুণে অসামান্য।