এ-শতকের তৃতীয় দশকে সাহিত্যে বাস্তবতার স্থান আর সীমা নিয়ে কলহ ঘন হয়ে দেখা দেয়। তাতে জড়িয়ে পড়েন রবীন্দ্রনাথও। এ-সময়ে তরুণ লেখকেরা চাইছিলেন নতুন সাহিত্য, নতুন বাস্তবতা, যা নেই আগের উপন্যাসে। ওই বাস্তবতা বেশ নির্মম, বেশ অশালীন, ও শিউরে ওঠার মতো। উনিশশতকের শেষদিকে এমন বাস্তবের ছবি এঁকেছিলেন ইউরোপের অনেক ঔপন্যাসিক; এবং বিশশতকেও তারা জীবনের তলদেশ খুঁড়েখুঁড়ে উদঘাটন করছিলেন অনেক নির্মম, পীড়াদায়ক ব্যাপার। তৃতীয় দশকের বাঙালি লেখকেরাও তাই করতে চাইলেন। তাঁরা সুন্দর জীবন থেকে চলে যেতে চাইলেন বস্তিতে, তাঁরা উঁচু জীবন থেকে ঢুকতে চাইলেন নিচু জীবনে। জীবনের পাতালে, যেখানে জমে আছে জীবনের সমস্ত নোংরা। রবীন্দ্রনাথও শিউরে উঠলেন এতে। এর ফলে শুরু হলো বাস্তবতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও তরুণ লেখকদের কলহ। রবীন্দ্রনাথেরও সীমাবদ্ধতা ছিলো। এতে উপকৃত হয় বাঙলা উপন্যাস। নতুন ধারার ঔপন্যাসিক ও উপন্যাসে ঋদ্ধ হয়ে ওঠে বাঙলা সাহিত্য।
যেমন আধুনিক কবিতা সৃষ্টিতে, তেমনি আধুনিক উপন্যাস সৃষ্টিতে তীব্র ভূমিকা নিয়েছিলো কয়েকটি পত্রিকা। প্রথম নাম করতে হয় কল্লোল-এর (১৯২৩)। এ-পত্রিকাটি আধুনিক বাঙলা সাহিত্যের জননীর মতো। এর নাম অনুসারে একটি যুগকে এখন কল্লোল যুগই বলা হয়। আধুনিকতার পক্ষে ছিলো আরো দুটি পত্রিকা : ঢাকার প্রগতি (১৯২৭), আর কলকাতার কালি-কলম (১৯২৬)। এ-পত্রিকাগুলো, বিশেষ করে কল্লোল ছিলো বিদ্রোহী। তরুণ লেখকেরা এসব পত্রিকায় প্রকাশ করতে লাগলেন নতুন অভিজ্ঞতা। ওই অভিজ্ঞতা পুরোনোদের কাছে মর্মান্তিক। বস্তির সত্য তাঁরা প্রকাশ করতে শুরু করলেন, যখন পুরোনোরা ব্যস্ত গৃহের সাজানো সত্য নিয়ে। লেখকদের অভিজ্ঞতা এ-সাহিত্য সৃষ্টিতে সাহায্য করেছিলো সন্দেহ নেই। কিন্তু তারা অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন পশ্চিম থেকে। পশ্চিমে ফ্রয়েড-এর তত্ত্ব মানুষকে দেখছে নতুনভাবে। জোলা, গোর্কি, হামসুন, বোয়ার, আরো অনেক ঔপন্যাসিক উদঘাটন করেছেন জীবনের অবস্তর। সে-স্তর সুন্দর নয়, শোভন নয়, স্বস্তিকর নয়। আমাদের তরুণ ঔপন্যাসিকেরাও সাধনা শুরু করলেন অবস্তর উপস্থাপনের। বদলে গেলো উপন্যাস।
নতুনদের পুরোধা হয়ে দেখা দেন নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত। তিনি ছিলেন এক সাড়াজাগানো মানুষ। যে-দিকেই গেছেন, সে-দিকেই ভূমিকম্প দেখা দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক ছিলেন, ডক্টরেট উপাধি ছিলো; কিন্তু প্রথাগত ছিলেন না তিনি। ছিলেন প্রথাবিরোধী। আজকাল তিনি অনেকটা বিস্মৃত। তিনি কামনা ও অপরাধকে তাঁর উপন্যাসের প্রধান বিষয় করে তুলেছিলেন। তাঁর উপন্যাস হচ্ছে শুভা (১৯২০), অগ্নিসংস্কার (১৯২০), শান্তি (১৯২১), সর্বহারা (১৯২৯), অভয়ের বিয়ে (১৯৩১), বিপর্যয়। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় (১৯০০-১৯৭৬) সাড়া জাগিয়েছিলেন তাঁর উপন্যাসে, বিশেষ করে গল্পে, অবস্তরের জীবনের ছবি এঁকে। কয়লাকুঠির জীবনের নির্মম চিত্র পাওয়া যায় তাঁর গল্পে। লেখক হিশেবে তিনি অত্যন্ত গৌণ; তবে বাঙলা গল্পের বাস্তবতার সীমাকে তিনি বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বলে স্মরণীয়। তাঁর উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ঝড়ো হাওয়া (১৩৩০), ষোলআনা (১৩৩২), মহাযুদ্ধের ইতিহাস (১৩৩৩), পূর্ণচ্ছেদ (১৩৩৬)। বাস্তবের নির্মম-নির্মোহ চিত্রণের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছেন জগদীশ গুপ্ত। তাঁর উপন্যাসে মানুষ ইতরপ্রাণীমাত্র। তাঁর উপন্যাস অসাধু সিদ্ধার্থ (১৯২৯), লঘুগুরু (১৯৩১), গতিহারা জাহ্নবী (১৯৩৫), দুলালের দোলা (১৯৩১)।
বিশশতকের বিখ্যাত ঔপন্যাসিকদের একজন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি যেনো পল্লীবাঙলার গদ্য-মহাকাব্যরচয়িতা। পথের পাঁচালী তাঁকে অমরত্ব এনে দিয়েছে। মানুষ ও নিসর্গ তাঁর উপন্যাসে পরস্পরের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হয়ে আছে। তাঁর উপন্যাস হচ্ছে পথের পাঁচালী (১৯২৯), অপরাজিত (১৯৩২), আরণ্যক (১৩৪৫), বিপিনের সংসার (১৩৪৮), আদর্শ হিন্দু হোটেল (১৩৪৭), দেবযান (১৩৫১)। অনেকের মতে আধুনিক ঔপন্যাসিকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। বীরভূমের সাধারণ জীবন ও ক্ষয়িষ্ণু জমিদারেরা স্থান পেয়েছে তাঁর উপন্যাসে। তাঁর উপন্যাসেও চোখে পড়ে মহাকাব্যিক বিস্তৃতি। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস হচ্ছে ধাত্রীদেবতা (১৯৩৯), গণদেবতা (১৯৪২), পঞ্চগ্রাম (১৯৪৩), হাসুলী বাঁকের উপকথা (১৯৪৭), কবি (১৯৪৭), নাগিনীকন্যার কাহিনী (১৯৫১)। আমাদের অতি-প্রশংসিত ঔপন্যাসিকদের একজন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর আসল নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। বিভিন্ন রকম তত্ত্ব অবলম্বন করেছেন তিনি উপন্যাসে। তাই তাঁর উপন্যাস অন্যান্যের থেকে কিছুটা জটিলও। মনের গোপন কামনাবাসনা থেকে শ্রেণীসংগ্রাম রূপ পেয়েছে তাঁর উপন্যাসে। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস হচ্ছে দিবারাত্রির কাব্য (১৯৩৫), পুতুলনাচের ইতিকথা (১৯৩৬), পদ্মানদীর মাঝি (১৯৩৬), শহরতলী (১৯৪০), চতুষ্কোণ (১৯৪৮)।
আধুনিক গুরুত্বপূর্ণ ঔপন্যাসিকদের মধ্যে দু-জন কবি। একজন প্রেমেন্দ্র মিত্র, অন্যজন বুদ্ধদেব বসু। প্রেমেন্দ্র মিত্র বস্তির জীবনের কাহিনী লিখে সাড়া জাগিয়েছিলেন। পাক (১৯২৬) তাঁর সাড়াজাগানো উপন্যাস। তার আরো উপন্যাস হচ্ছে মিছিল (১৯৩৩), উপনয়ন (১৯৩৩), আগামীকাল (১৩৪১) কুয়াশা (১৯৪৬)। কবি ও ঔপন্যাসিক হিশেবে অনেক বড়ো বুদ্ধদেব বসু প্রেমেন্দ্র মিত্রের থেকে। বুদ্ধদেব বসু উপন্যাসে বাহ্যিক ঘটনার থেকে বেশি জোর দিয়েছেন মনোঘটনার ওপর। তিনি অন্তর্জগতের ঔপন্যাসিক। তাঁর উপন্যাস হচ্ছে সাড়া (১৯৩০), যেদিন ফুটল কমল (১৯৩৩), ধূসর গোধূলি (১৯৩৩), তিথিডোর (১৯৪৯), মৌলিনাথ (১৯৫২), রাতভর বৃষ্টি (১৯৬১)। বনফুল ছিলেন শেষপ্রবণ। তাঁর উপন্যাস হচ্ছে মৃগয়া (১৯৪০), জঙ্গম (১৩৫০), স্থাবর (১৩৫৮)। ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস আন্তর চেতনার। তাঁর উপন্যাস হচ্ছে অন্তঃশীলা (১৯৩৫), আবর্ত (১৯৩৭), মোহনা (১৯৩৭)। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত প্রচুর লিখেছেন। যতোটা সাড়া জাগিয়েছিলেন তিনি, ততোটা গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস অবশ্য তিনি লিখতে পারেন নি। তাঁর উপন্যাস হচ্ছে বিবাহের চেয়ে বড়ো (১৯৩১), বেদে (১৩৩৫), আকস্মিক (১৯৩০), নবনীতা (১৩৪৩), প্রথম কদম ফুল (১৯৬৩)।