আমাদের শ্রেষ্ঠতম কবি রবীন্দ্রনাথ একজন শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিকও। ছোটগল্পে তো তিনি শ্রেষ্ঠতম। জীবনসম্ভারে ও শিল্পনিপুণতায় তাঁর ছোটগল্পের কোনো তুলনা নেই বাঙলায়। উপন্যাসেও তাঁর অসামান্যতা বিস্ময়কর। তিনি আমাদের জীবন ও চেতনার একটি বড় অংশ গভীরভাবে চিত্রিত করেছেন তাঁর উপন্যাসে। তাঁর উপন্যাসের ভাষাও অনবদ্য। তিনি জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক নন, পাঠকের চিত্তবিনোদনের জন্যে তিনি উপন্যাস রচনা করেন নি। তিনি দিয়েছেন জীবন ও চেতনার ভাষ্য। উপন্যাস লেখা শুরু করেছিলেন তিনি অনেকটা বঙ্কিমচন্দ্রের ধরনে। তার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর প্রথম পর্যায়ের উপন্যাস বৌঠাকুরাণীর হাট (১৮৮৩), রাজর্ষিতে (১৮৮৭)। নৌকাড়ুবি (১৯০৬) নামে তাঁর একটি উপন্যাস রয়েছে, তাতেও ঠিক রবীন্দ্রনাথকে পাওয়া যায় না। ঔপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথ বলতে যাকে বুঝি, তাঁর সূচনা হয় চোখের বালি (১৯০৩) উপন্যাসে। এ-উপন্যাসটিতেই সূচিত হয় বাঙলা উপন্যাসের আধুনিক যুগ। কয়েকটি নতুন জিনিশ দেখা দেয় এ-উপন্যাসে। বাস্তবের চিত্রণে রবীন্দ্রনাথ এ-উপন্যাসে গ্রহণ করেন আধুনিক ভঙ্গি। বিশ্লেষণ করেন পাত্রপাত্রীদের মনস্তত্ত্ব। পরিত্যাগ করেন প্রথাগত নীতিবোধ। এসব কারণে চোখের বালিকে বিশশতকি বাঙলা উপন্যাসের সূচনাগ্রন্থ হিশেবে গণ্য করা হয়। এরপর আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস রচনা করেন রবীন্দ্রনাথ। সেগুলো হচ্ছে গোরা (১৯১০), ঘরে বাইরে (১৯১৬), চতুরঙ্গ (১৯১৬), যোগাযোগ (১৯২৯), শেষের কবিতা (১৯২৯), দুইবোন (১৯৩৩), মালঞ্চ (১৯৩৪), চার অধ্যায় (১৯৩৪)। বাঙলার জীবন, রাজনীতি, ব্যক্তিমানুষের কামনাবাসনার অসামান্য চিত্রণ যেমন পাওয়া যায় তাঁর উপন্যাসে, তেমনি পাওয়া যায় বাঙলা গদ্যের অপূর্ব বিকাশ। আর কারো উপন্যাসে ভাষা এমন উজ্জ্বলতা লাভ করে নি।
রবীন্দ্রনাথের পর সাড়া জাগিয়ে দেখা দেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক ছিলেন, জনপ্রিয়তায় তাকে আর কেউ ছাড়িয়ে যেতে পারেন নি। ঔপন্যাসিক হিসেবে কয়েক দশক আগে তিনি যে-মর্যাদা পেতেন, এখন আর তাঁকে তা দেয়া হয় না; তবে তিনি আবার মর্যাদা পাবেন। তিনি শস্তা জনপ্রিয় ছিলেন না। তিনি বাঙলা ভাষার প্রধান ঔপন্যাসিকদের একজন। তিনি বাঙালির আবেগস্রোতকে খুলে দিয়েছিলেন; এবং আবেগে ভেসে গিয়েছিলো পাঠকেরা। তিনি সবকিছু দেখতেন হৃদয়ের যুক্তির সাহায্যে, মস্তিষ্কের সাহায্যে নয়। তিনি সামাজিকভাবে নিষিদ্ধ কিছু ব্যাপারকে নিয়ে এসেছিলেন সামনে, সেগুলোকে দিয়েছিলেন মহিমা। দাঁড়িয়েছিলেন সামাজিক অনেক রীতিনীতির বিরুদ্ধে। তাই তিনি ছিলেন একধরনের বিদ্রোহী। বাঙালির আবেগ ও ভাবাবেগের মুক্তিদাতা হিশেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন শরৎচন্দ্র। বহু উপন্যাস লিখেছিলেন তিনি, যেগুলো একসময় বাঙালির প্রাত্যহিক পাঠ্যপুস্তকে পরিণত হয়েছিলো। তাঁর প্রধান উপন্যাসগুলো হচ্ছে পল্লীসমাজ (১৯১৬), দেবদাস (১৯১৭), চরিত্রহীন (১৯১৭), শ্রীকান্ত (চারপর্ব, ১৯১৭, ১৯১৮, ১৯২৭, ১৯৩৩), দত্তা (১৯১৮), গৃহদাহ (১৯২০), পথের দাবী (১৯২৬)। এছাড়া আছে পরিণীতা (১৯১৪), বিরাজ বৌ (১৯১৪), চন্দ্রনাথ (১৯১৬), দেনা-পাওনা (১৯২৩), বিপ্রদাস (১৯৩৫), শেষ প্রশ্ন (১৯৩১)। শরৎচন্দ্রের থেকে বয়সে কম হলেও তাঁর এক দশক আগে থেকেই উপন্যাস-গল্প লিখে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। তাঁর উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থ ষোড়শী (১৯০৬), রমাসুন্দরী (১৯০৮), নবীন সন্ন্যাসী (১৯১২), গল্পাঞ্জলি (১৯১৩), রত্নদ্বীপ (১৯১৫), সিঁদুর-কৌটা (১৯১৯) প্রভৃতি।
সাহিত্যে রক্ষণশীল আর প্রগতিশীলদের মধ্যে মাঝেমাঝেই দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। রক্ষণশীলেরা সাধারণত হয়ে থাকে প্রতিভাহীন, ও একগুয়ে, এবং বেশ ভণ্ড। প্রগতিশীলেরা হয় সত্যসন্ধানী, প্রতিভাবান। তরুণ প্রগতিশীল প্রতিভা আক্রান্ত হয় বৃদ্ধ রক্ষণশীলদের দ্বারা। বাঙলা সাহিত্যে এটা ঘটেছে মাঝেমাঝেই। এ-শতকের দ্বিতীয় দশকের মাঝামাঝি দেখা দেয় প্রগতিশীলতা ও রক্ষণশীলতার বিবাদ। উপন্যাসের বিষয় সার্বিক জীবন। তার ভালো ও মন্দ, সুন্দর ও অসুন্দর, শ্লীল ও অশ্লীল, সিদ্ধ ও নিষিদ্ধ সবকিছুই উপন্যাসে স্থান পাওয়ার যোগ্য। উনিশশতকের ঔপন্যাসিকেরা সবকিছুকে স্থান দিতেন না উপন্যাসে। জীবনের ভালো দিকটাকেই তাঁরা তুলে ধরতেন। তাঁদের উপন্যাসে কোনো চরিত্র যদি সমাজঅসম্মত কাজ করতো, তাহলে তাদের দেয়া হতো মৃত্যুর মতো শাস্তি। এর বিখ্যাত উদাহরণ বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণকান্তের উইল-এর বিধবা রূপসী রোহিণী। রোহিণী বাল্যবিধবা। তাঁর স্বপ্নের জীবন শুরু হওয়ার আগেই সে বিধবা হয়ে গেছে। জীবনে তার কোনো অধিকার নেই। সমাজ তার সমস্ত স্বপ্ন ও বাসনাকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু সে জীবন উপভোগে ব্যগ্র। তাই বঙ্কিম তাকে শাস্তি দেন; বন্দুকের গুলিতে মরতে হয় রোহিণীকে। রোহিণীকে মেরে শান্তি পান বঙ্কিম ও স্থির থাকে হিন্দু সমাজ। কিন্তু আধুনিকেরা এটা মেনে নিতে পারেন নি। যেমন রবীন্দ্রনাথের চোখের বালির বিনোদিনীও বিধবা, ও জীবনের জন্যে ব্যাকুল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাকে কোনো শাস্তি দেন নি; বরং তার কামনাকে চিত্রিত করেছেন সহানুভূতির সাথে। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে তো দেখি নিষিদ্ধ কামনার জয়জয়কার। এতে বিচলিত হয়েছিলেন রক্ষণশীলেরা। যতীন্দ্রমোহন সিংহ নামে একজন রক্ষণশীল লেখক সাহিত্যে স্বাস্থ্যরক্ষা (১৯২২) নামে একটি বই লেখেন। আরো কেউ কেউ আধুনিক সাহিত্যকে বেশ অশালীন ভাষায় তিরস্কার করেন।