একদা এমনই বাদলশেষের রাতে–
মনে হয় যেন শতজনমের আগে—
সে এসে, সহসা হাত রেখেছিল হাতে,
চেয়েছিল মুখে সহজিয়া অনুরাগে।
সে-দিনও এমনই ফসলবিলাসী হাওয়া
মেতেছিল তার চিকুরের পাকা ধানে;
অনাদি যুগের যত চাওয়া, যত পাওয়া
খুঁজেছিল তার আনত দিঠির মানে।
একটি কথার দ্বিধাথরথর চুড়ে
ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী;
একটি নিমেষ দাঁড়াল সরণী জুড়ে,
থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি;
একটি পণের অমিত প্রগল্ভতা
মর্ত্যে আনিল ধ্রুবতারকারে ধরে;
একটি স্মৃতির মানুষী দুর্বলতা
প্রলয়ের পথ ছেড়ে দিল অকাতরে।
কবিতাটির নাম শাশ্বতী’, রয়েছে অর্কেস্ট্রা কাব্যগ্রন্থে।
অমিয় চক্রবর্তীকে আধুনিকদের মধ্যে সবচেয়ে শান্ত, স্নিগ্ধ, ধ্যানী বলে মনে হয়। বিশ্বাসী বলেও মনে হয়। সরল বলেও মনে হয়। কিন্তু তাঁর কবিতায়ও রয়েছে গভীর অবিশ্বাস, জটিলতা। মানসভ্ৰমণ চলেছে তাঁর দেশেদেশে, ঘুরেছেন তিনি দর্শন থেকে দর্শনে। তাঁর কবিতার স্বাদ পাওয়ার জন্যে বাইরের তীব্র জগৎকে ভুলে ঢুকতে হয় ভেতরে নমিতভাবে। কবিতার সাথে কিছু প্রবন্ধও লিখেছেন অমিয় চক্রবর্তী। অমিয় চক্রবর্তীর কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে খসড়া (১৩৪৫), একমুঠো (১৩৪৬), মাটির দেয়াল (১৩৪৯), অভিজ্ঞানবসন্ত (১৩৫০), দূরযানী (১৩৫১), পারাপার (১৩৬০), ঘরে ফেরার দিন, হারানো অর্কিড। তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ হচ্ছে সাম্প্রতিক। যে-কবিতাটির জন্যে তিনি বিশ্বাসী বলে বিখ্যাত, তার অংশ :
মেলাবেন তিনি ঝোড়ো হাওয়া আর
পোভড়া বাড়িটার
ঐ ভাঙা দরজাটা
মেলাবেন।
পাগল ঝাপটে দেবে না গায়েতে কাঁটা।
আকালে আগুনে তৃষ্ণায় মাঠ ফাটা,
মারী-কুকুরের জিভ দিয়ে খেত চাটা,–
বন্যার জল, তবু ঝরে জল,
প্রলয় কাঁদনে ভাসে ধরাতল–
মেলাবেন।
আধুনিকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কবিতা লিখেছেন বিষ্ণু দে। তাঁর কবিতা কখনো আবেগঘন, কখনো তীব্র; কখনো মননশীলতায় গভীর, ও দুরূহ-জটিল। কবিতার পংক্তি থেকে পংক্তিতে, স্তবক থেকে স্তবকে এগোনোর সময় তিনি অনেক সময় যুক্তিকে করেছেন অস্বীকার, এবং রচনা করেছেন পাঠকের জন্যে বিহ্বলকর কবিতা। তবে যে-তিনজন কবি আধুনিক কালের অধিকাংশ শ্রেষ্ঠ কবিতা লিখেছেন, বিষ্ণু দে তাঁদের একজন। অন্য দুজন হচ্ছেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও জীবনানন্দ দাশ। আধুনিকদের মধ্যে একমাত্র তারই একটি স্পষ্ট রাজনীতিক দর্শন ছিলো, তা হচ্ছে সাম্যবাদ। রাজনীতিক আদর্শে বিশ্বাসী কবিরা সাধারণত হয়ে থাকেন সরল, উচ্চকণ্ঠ, আবেগপ্রবণ ও বাগ্মী; কিন্তু বিষ্ণু দে তাঁর বিপরীত। প্রচুর কবিতা লিখেছেন তিনি, প্রবন্ধও লিখেছেন বেশকিছু। তাঁর কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে উর্বশী ও আর্টেমিস (১৯৩২), চোরাবালি (১৯৩৮), পূর্বলেখ (১৯৪১), সন্দ্বীপের চর (১৯৪৭), সাত ভাই চম্পা (১৯৪১-৪৪), অন্বিষ্ট (১৯৫০), নাম রেখেছি কোমল গান্ধার (১৯৫০), তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ (১৯৫৮), স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ (১৯৬৩), সেই অন্ধকার চাই (১৩৭৩) ইতিহাসে ট্র্যাজিক উল্লাসে (১৩৭৭), উত্তরে থাকো মৌন (১৯৭৭), আমার হৃদয়ে বাঁচো (১৯৮২)। তার প্রবন্ধের বই হচ্ছে সাহিত্যের ভবিষ্যৎ (১৯৫২), এলোমেলো জীবন। শিল্পসাহিত্য (১৯৬৮), রবীন্দ্রনাথ ও শিল্পসাহিত্যের আধুনিকতার সমস্যা (১৯৬৬)। তাঁর অনুদিত গ্রন্থের নাম এলিঅটের কবিতা (১৯৫০)। তাঁর কবিতার কয়েকটি স্তবক :
সোনালি হাসির ঝরনা তোমার ওষ্ঠাধরে।
প্রাণকুরঙ্গ অঙ্গে ছড়ায় চপল মায়া।
মুখর সে-গান ভেঙে গেলো। আজ শুদ্ধ তমাল।
হালকা হাসির জীবনে কি এলো ফসলের কাল?
এই তবে ভোরবেলা
হে ভূমিশায়িনী শিউলি! আর কি
কোনো সান্ত্বনা নেই?
রজনীগন্ধা দিয়েছিলে সেই রাতে,
আজো তো সে ফোটে দেখি–
মদির অধীর রাতের তন্বী ফুল–
রজনীগন্ধা, বিরাগ জানে না সে কি?
এ-স্তবকগুচ্ছ নেয়া হয়েছে চোরাবালি কাব্যের ‘ক্রেসিডা’ নামক কবিতা থেকে। এটি এক অতুলনীয় জটিল-সুন্দর কবিতা।
আধুনিক কবিতার সূচনার পর কেটে গেছে ছ-দশক। প্রথম মহান আধুনিকদের পর দেখা দিয়েছেন দশকে দশকে নতুন নতুন আধুনিকেরা; এবং বাঙলা আধুনিক কবিতাকে করে তুলেছেন গভীর, ব্যাপক, বিচিত্র। প্রথম আধুনিকদের পরেই যিনি গুরুত্বপূর্ণ আধুনিক কবি, তাঁর নাম সমর সেন (১৯১৬-১৯৮৭)। তিনি লিখেছেন কম, কিন্তু কিছু গুরুত্বপূর্ণ কবিতা লিখেছেন তিনি। তাঁর কাব্যগ্রন্থ কয়েকটি কবিতা (১৯৩৭), গ্রহণ ও অন্যান্য কবিতা (১৯৪০), তিনপুরুষ (১৯৪৪)। সমর সেনের কবিতা নামক একটি সংগ্রহে তার প্রায় সব কবিতা পাওয়া যায়। আরেকজন কবির নাম বলা দরকার, তবে তিনি ঠিক আধুনিক নন। তাঁর নাম সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৯২৬-১৯৪৭]। মাত্র একুশ বছর বয়সে লোকান্তরিত হয়েছিলেন সুকান্ত। বাঙলার অকালমৃত কবিদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে প্রতিভাবান। বাঙলা ভাষায় মার্কসীয় ধারার শ্রেষ্ঠ কবি সুকান্ত। তাঁর কাব্যগ্রন্থ ছাড়পত্র (১৩৫৫), পূর্বাভাস (১৩৫৫), ঘুম নেই (১৩৫৫)। আধুনিক কবিতার এখন শেষ পর্যায় চলছে। এখন অনেক কবিই আবার হয়ে উঠছেন অনাধুনিক।
বিশশতকের কথাসাহিত্য-গল্প ও উপন্যাস-যে নতুন হবে, বিশশতকের বাস্তব ও স্বপ্নকে প্রকাশ করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ-শতকে ঔপন্যাসিকেরা, গল্পকারেরা নতুন নতুন প্রশ্ন তুলেছেন, জীবনকে দেখার চেষ্টা করেছেন নতুন চোখে। উপন্যাস তাই চলে গেছে রূঢ় অশীল বাস্তবে; আবার প্রবেশ করেছে অবচেতনে। ধরা পড়েছে বিচিত্র কামনা বাসনা; এবং অনেক নিষিদ্ধ কথা প্রকাশ করেছে অবলীলায়। বাঙলা উপন্যাসে ছজন শ্রেষ্ঠ পুরুষের মধ্যে রয়েছেন দু-জন চট্টোপাধ্যায় (বঙ্কিমচন্দ্র (১৮৩৮-১৮৯৪), শরৎচন্দ্র (১৮৭৬-১৯৩৮), তিনজন বন্দ্যোপাধ্যায় (তারাশঙ্কর (১৮৯৮-১৯৭১), বিভূতিভূষণ (১৮৯৪-১৯৫০), মানিক [১৯০৮-১৯৫৬) ও একজন ঠাকুর (রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১)। তাদের পাঁচজনই বিশশতকের। তাঁরা ছাড়াও রয়েছেন কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার। তারা সবাই মিলে বিশশতকের কথাসাহিত্যকে জীবনের মতো ব্যাপক করে তুলেছেন। ওপরের কয়েকজন ছাড়া উল্লেখযোগ্য যাদের নাম, তারা হচ্ছেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় (১৮৭৩-১৯৩২), নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত (১৮৮২-১৯৬৪), জগদীশচন্দ্র গুপ্ত (১৮৮৬-১৯৫৭), প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৪-১৯৮৭], বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪), অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত (১৯০৩-১৯০৬), ধূর্জটিপ্রসাদ মুখখাপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৬১), বনফুল (১৮৯৯-১৯৭৯), সতীনাথ ভাদুড়ী (১৯০৬-১৯৬৫), সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৯২২-১৯৭১)।