বুদ্ধদেব বসুর কথা ভাবলে রবীন্দ্রনাথকে মনে পড়ে। প্রতিভার বিচিত্রমুখিতায় রবীন্দ্রনাথই তাঁর তুলনা। তিনি কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, অনুবাদক, সমালোচক, ও সম্পাদক। সব এলাকায়ই গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নন তিনি, তবে প্রধান পুরোহিত। কবিতা সম্পাদনা করে, আধুনিক কবি ও কবিতার পক্ষে প্রবন্ধ লিখে, বিশ্বের আধুনিক কবিতা অনুবাদ করে তিনি আমাদের আধুনিকতার শিক্ষক হয়ে আছেন। তিনি আধুনিক কবিদের মধ্যে সবচেয়ে গীতিময় ও আবেগপ্রবণ; এবং তীব্রভাবে সংরক্ত। কামনাবাসনার রঙিন প্রকাশ ঘটেছে তাঁর কবিতায়। তাঁর কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে বন্দীর বন্দনা ও অন্যান্য কবিতা (১৯৩০), একটি কথা (১৯৩২), কঙ্কাবতী ও অন্যান্য কবিতা (১৯৩৭), দয়মন্তী (১৯৪৩), শীতের প্রার্থনা : বসন্তের উত্তর (১৯৫৫), যে-আঁধার আলোর অধিক (১৯৫৮), মরচে-পড়া পেরেকের গান (১৯৬৬), স্বাগতবিদায় ও অন্যান্য কবিতা (১৯৭১)। অনুবাদ করেছিলেন তিনি বোদলেয়ার, হ্যেল্ডার্লিন, রাইনের মারিয়া রিলকে ও আরো কয়েকজন কবির কবিতা। শার্ল বোদলেয়ার : তাঁর কবিতা (১৯৬১), অনুবাদ হিশেবে অসামান্য। এটি পরবর্তী আধুনিক কবিদের প্রভাবিত করেছে নানাভাবে। তপস্বী ও তরঙ্গিনী (১৯৬৬) অতুলনীয় নাটক। তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ কালের পুতুল (১৯৪৬) ও সাহিত্যচর্চা (১৩৬১) আধুনিক কবিতার চমৎকার ভাষ্য। বুদ্ধদেব বসু সাহিত্যকে, বিশেষ করে কবিতাকে, করে তুলেছিলেন নিজের জীবন। বুদ্ধদেব বসুর কবিতার একটি স্তবক :
দুঃখ আমাদের মুখরা ননদিনী, মৃত্যু আমাদের পূজ্য ব্রাহ্মণ,
তবু তো কিছু ভালো মেনেছি সংসারে, জেনেছি দেবতারা বন্ধু–
যেহেতু ফলে ওঠে সোনালি ধান আর সোনার সন্তান মায়ের কোলে,
এবং অগ্নি ও জলের মিতালিতে অমৃতস্বাদ পায় অন্ন।
বল তো, বোন, কবে আবার মধুমতী গাভীর বাঁট হবে উচ্ছল?
টেকির গম্ভীর শব্দ দিয়ে তাল জাগবে হাতে-পায় ভঙ্গি?
ব্যাঙের ছাতা কবে সাজাবে পৃথিবীরে? ডাকবে উল্লাসে দর্দুর?
শিশিরবিন্দুর আদরে ভরপুর ঝুলবে আঙিনায় কুমড়ো?
স্তবক দুটি নেয়া হয়েছে ‘গাঁয়ের মেয়েরা কবিতা থেকে। কবিতাটি আছে তপস্বী ও তরঙ্গিনী নাটকে।
আধুনিকদের মধ্যে এখন জীবনানন্দ দাশ সবচেয়ে জনপ্রিয়; এবং অনেকের মতে-শ্রেষ্ঠ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতাকে বলেছিলেন চিত্ররূপময়’; এবং বুদ্ধদেব বসু তাঁকে বলেছিলেন নির্জনতম কবি’। রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্ররূপময়’ কথাটি খুব প্রশংসার ছিলো না; কারণ চিত্রের মতো সুন্দর হওয়া রোম্যান্টিক দৃষ্টিতে খুব ভালো ব্যাপার নয়। তবে আজকাল রবীন্দ্রনাথের কথাটিকে প্রশংসা হিশেবেই ধরা হয়ে থাকে। আসলে জীবনানন্দের কবিতা চিত্রকল্পময়। আধুনিকদের মধ্যে ব্যক্তিগত জীবনে সবচেয়ে ব্যর্থ ছিলেন জীবনানন্দ। মৃত্যুও হয়েছিলো তার দুর্ঘটনায় ট্রামের নিচে পড়ে লোকান্তরিত হয়েছিলেন জীবনানন্দ। হয়তো আত্মহত্যা করেছিলেন। করুণ, বিন্ন, স্বপ্নময়, আর আশ্চর্য শোভাময় তাঁর কবিতা। ক্লান্তি, বিষাদ, হতাশা প্রভৃতি তাঁর কবিতায় সোনার টুকরোর মতো সুন্দর হয়ে আছে। তাঁর কবিতা অন্তর্গত আলোড়নের কবিতা। বাঙলার অতীত ও বর্তমান প্রাকৃতিক শোভা তাঁর কবিতায়ই অপরূপ হয়ে ফুটে উঠেছে। কোমলতা তাঁর কবিতার বড়ো বৈশিষ্ট্য; তবে শেষদিকে তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছিলো কিছুটা কর্কশ। আধুনিক কালের অধিকাংশ শ্রেষ্ঠ উপমা রচনা করেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। একসময় তাঁকে শুধু কবি, এবং শুধু কবিই ভাবা হততা। কিন্তু সম্প্রতি তাঁর কয়েকটি অপ্রকাশিত ও অজ্ঞাত উপন্যাস পাওয়া গেছে। ওইগুলোও রচনা হিশেবে অসামান্য। ত্রিশের দশকে এগুলো বেরোলে তিনি একজন প্রধান ঔপন্যাসিকের মর্যাদাও পেতেন। কিন্তু যখন বেঁচেছিলেন, তখন বেশি কিছু পান নি। জীবনানন্দ। এখন পাচ্ছেন শ্রেষ্ঠ আধুনিকের মর্যাদা। তাঁর কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে ঝরাপালক (১৩৩৪), ধূসর পাণ্ডুলিপি (১৩৪৩), বনলতা সেন (১৩৪৯), মহাপৃথিবী (১৩৫১), সাতটি তারার তিমির (১৩৫৫), রূপসী বাংলা (১৯৫৭), বেলা অবেলা কালবেলা (১৯৬১)। তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থের নাম কবিতার কথা, উপন্যাসের নাম মাল্যবান। জীবনানন্দের রূপভারাতুর একটি কবিতার অংশ :
চারিদিকে নুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল,
তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা-ফোটা পড়িতেছে শিশিরের জল;
প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে-থেকে আসিতেছে ভেসে
পেঁচা আর ইদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাঁড়ারের দেশে!
শরীর এলায়ে আসে এইখানে ফলন্ত ধানের মতো করে
যেই রোদ একবার এসে শুধু চলে যায় তাহার ঠোটের চুমো ধরে
আহ্লাদের অবসাদে ভরে আসে আমার শরীর,
চারিদিকে ছায়া-রোদ-খুদ-কুঁড়ো-কার্তিকের ভিড়;
চোখের সকল ক্ষুধা মিটে যায় এইখানে, এখানে হতেছে স্নিগ্ধ কান,
পাড়াগাঁর গায় আজ লেগে আছে রূপশালি-ধানভানা রূপসীর শরীরের ঘ্রাণ।
কবিতাটির নাম ‘অবসরের গান’। কবিতাটি আছে ধূসর পাণ্ডুলিপিতে। এটি একটি বিস্ময়কর কবিতা; কবিতাটি পড়ার সময় মনে হয় পৃথিবীতে এক পরম কাব্যিক সময় এসেছিলো, এবং সে-সময়টির খোঁজ পেয়ে জীবননান্দ তার সদ্ব্যবহার করেছিলেন প্রাণ ভরে।
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, কারো কারো মতে, আধুনিক কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। আবেগ ও মননশীলতার এক অসামান্য মিশ্রণ তাঁর কবিতা। আপাতদৃষ্টিতে সুধীন্দ্রনাথ আধুনিকদের মধ্যে সবচেয়ে দুরূহ কবি। অভিধান থেকে তিনি প্রচুর অপ্রচলিত শব্দ বেছে নিয়েছেন, এবং সেগুলোতে সঞ্চার করেছেন বিশশতকের উত্তাপ। সাধারণ পাঠকের পক্ষে অধিকাংশ শব্দের অর্থ বুঝে ওঠাই কঠিন তাঁর কবিতার; এবং সেগুলোতে তিনি প্রকাশ করেছেন যে-ভাব, তা বোঝাও সহজ নয়। দর্শন থেকে দর্শনে ফিরেছেন সুধীন্দ্রনাথ। তিনি বিশ্বাস করতে চেয়েছেন, কিন্তু অবিশ্বাসে তাঁর সমস্ত সত্তা ভরে গেছে। কিন্তু আবেগের মুহূর্তে তিনি দুলে উঠতে পারেন তীব্রভাবে। আধুনিক বাঙলা কবিতার কয়েকটি শ্রেষ্ঠ আবেগউদ্বেল প্রেমের কবিতা তিনিই লিখেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন শব্দই কবিতা; আর তিনি অবিশ্বাস করতেন অনুপ্রেরণায়। বাঙলার অধিকাংশ কবি সাধারণত স্বভাবকবি, সুধীন্দ্রনাথ পরিহার করেছিলেন স্বভাবকরিত্ব। তাই তাঁর কবিতা দুরূহ বলে মনে হয়। কবিতা ছাড়া তাঁর দুটি প্রবন্ধের বইও রয়েছে। তাঁর গদ্যও বাঙলা ভাষায় দুরূহতম। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে তন্বী (১৩৩৭), অর্কেস্ট্রা (১৯৩৫), ক্রন্দসী (১৩৪৪), উত্তরফাল্গনী (১৩৪৭), সংবর্ত (১৩৬০)। তাঁর অনূদিত কবিতাগ্রন্থের নাম প্রতিধ্বনি (১৩৬১)। তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ হচ্ছে স্বাগত (১৩৪৫), ও কুলায় ও কালপুরুষ (১৩৬৪)। তাঁর সমগ্র কবিতা এখন একসাথে পাওয়া যায় সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যসংগ্রহ -এ (১৯৬২); এবং সমস্ত প্রবন্ধ একসাথে পাওয়া যায় সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রবন্ধসংগ্রহ -এ (১৩৯০)। তাঁর একটি আবেগস্পন্দিত কবিতার অংশ :