ওই সময়ে রবীন্দ্রপ্রভাব থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন ছিলো। বেরিয়ে যে আসতে হবে, তাই মনে পড়ে নি অধিকাংশের। কারোকারো মনে পড়ছিলো; এবং খুঁজছিলেন নতুন কবিতার পথ। কিন্তু তাঁরা রবীন্দ্রনাথ থেকে কিছুটা বেরিয়ে এলেও সত্যিকারভাবে নতুন, আধুনিক কবিতার ধারা সৃষ্টি করতে পারেন নি। তাঁরা মোহিতলাল মজুমদার [১৮৮৮-১৯৫২], যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত [১৮৮৭-১৯৫৪], ও কাজী নজরুল ইসলাম [১৮৯৯-১৯৭৬]। মোহিতলালের কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে স্বপন-পসারী (১৯২২), বিস্মরণী (১৯২৭), স্মর-গরল (১৯৩৬)। যতীন্দ্রনাথের কাব্য হচ্ছে মরীচিকা (১৯২৩), মরুশিখা (১৯২৭), মরুমায়া (১৯৩০)।
কবি হিশেবে কাজী নজরুল ইসলাম অত্যন্ত বিখ্যাত। বিদ্রোহী কবি’ উপাধিটি তাঁর নামের সাথে জড়িয়ে গেছে। তবে তিনি শুধু বিদ্রোহী ছিলেন না। বিদ্রোহের বিপরীত আবেগও রয়েছে তাঁর কবিতায়। তাঁর কবিতায় তারুণ্যের আবেগ প্রকাশ পেয়েছে খুব; আর প্রেমের কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে কৈশোরিক কাতরতা। তাঁর খ্যাতির মূলে সামাজিকরাজনীতিক কারণ রয়েছে প্রবলভবে। তাঁর কাব্য হচ্ছে অগ্নিবীণা (১৯২২), দোলনচাঁপা (১৩৩০), ভাঙ্গার গান (১৩৩১), পুবের হাওয়া (১৩৩২), বিষের বাঁশী (১৩৩১), ছায়ানট (১৩৩০)। নজরুল একজন মহাপদ্যকার।
জসীমউদদীনও (১৯০৩-১৯৭৬) ভিন্ন ধরনের কবিতা লিখেছিলেন। পল্লীর জীবন ও কিংবদন্তি অবলম্বন করে কবিতা লিখে বিখ্যাত হয়েছিলেন তিনি পল্লীকবি’ নামে। কুমুদরঞ্জন মল্লিকের প্রভাব আছে তার ওপর। তাঁর কাব্য হচ্ছে রাখালী (১৯২৭), নকসী কাথার মাঠ (১৩৩৬), বালুচর (১৩৩৭), সোজনবাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩)।
বিশশতকের তৃতীয় দশকের মাঝামাঝি দেখা দেয় আধুনিক কবিতা। এ-কবিতার মধ্যদিয়েই বিশশতক প্রবেশ করে বাঙলা সাহিত্যে। রবীন্দ্রনাথের কবিতার পর আধুনিক কবিতায়ই প্রকৃত অভিনব সৃষ্টি বাঙলা সাহিত্যে। মূল্যবানও বটে। এরচেয়ে মূল্যবান আর কিছু সৃষ্টি হয় নি বিশশতকের বাঙলা সাহিত্যে। আধুনিক কবিতা ও এর আগের কবিতার মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। এ-কবিতায় বদলে যায় বাঙালির চেতনা। দেখা দেয় নতুন জটিল বিস্ময়কর শোভা। বিশশতকের প্রাণ ধরা পড়েছে এ-কবিতায়। এর আগের কবিতা পড়ে বুঝতে, অন্তত তার অর্থ বুঝে উঠতে পারে যে-কোনো সাধারণ শিক্ষিত বাঙালি। কিন্তু একবিতা তাঁদের কাছে মনে হবে দুরূহ-দুর্বোধ্য। এর আগের কবিতা প্রধানত রোম্যান্টিক কারণ তখন প্রাধান্য বিস্তার করে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ওই কবিতায় শব্দগুলো কঠিন নয়, ভাবও দুরূহ নয়। অধিকাংশ কবিতায়ই প্রকাশ পেয়েছে এমন বক্তব্য, যার মোটামুটি সারাংশ করা কঠিন নয়। ওই সমস্ত কবিতায় বাঙালির প্রথাগত আবেগ, স্বপ্ন, সুখদুঃখ, কাতরতা ও বিশ্বাস প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু আধুনিক কবিতা তার পুরোপুরি বিপরীত। একবিতায় বদলে যায় ভাব, বদলে যায় ভাষা। বিশ্বাস, শান্তি, সুন্দর, কল্যাণ প্রভৃতির কথা বাঙলা কবিতায় বড়ো বেশি বলা হয়েছে। আধুনিক কবিরা বাদ দেন সে-সব জিনিশ। আগের কবিতার বাঙলা ছিলো পল্লীবাঙলা। আধুনিক কবিরা বেছে নেন নগরকে; রচনা করেন তার সুন্দর-অসুন্দর চিত্র। তাঁরা ক্লান্তির কথা বলেন, অবিশ্বাসের কথা বলেন, নিরাশার কথা বলেন। তাঁরা বলেন ব্যক্তিগত যন্ত্রণা ও নৈঃসঙ্গের কথা, প্রকাশ করেন বিভিন্ন রকমের কামনাবাসনা। এসব কথা বলেন এক ভিন্ন ধরনের বাঙলা ভাষায়। সে-ভাষা জটিল, দুরূহ। ছন্দ বদলে দেন এবং ছন্দের বদলে কবিতা লেখেন গদ্যে। কবিতায় তারা খচিত করেন মননশীলতা। বাঙলা ভাষার আগের কবিরা আবেগকেই কবিতা ভাবতেন। আধুনিক কবিরা আবেগকে শশাধিত করেন মননশীলতা দিয়ে। তাঁরা সবাই অসামান্য শিক্ষিত কবি। নতুন কবিতা সৃষ্টির জন্যে তাঁরা ছুটেছেন বিদেশি কবিতা থেকে কবিতায়। ইংরেজি, ফরাশি, জর্মন কবিতা থেকে তাঁরা সংগ্রহ করেছেন প্রেরণা; এবং জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা থেকে শিখেছেন তাঁরা অনেক কিছু। স্বাভাবিক প্রতিভা ও অধীত জ্ঞানের মিলনে সৃষ্টি হয়েছে তাদের কবিতা।
বাঙলা ভাষায় যাঁরা আধুনিক কবিতা সৃষ্টি করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে পাঁচজন প্রধান। রবীন্দ্রনাথের পর তাঁরাই বাঙলা ভাষার প্রধান কবি। তাঁরা হচ্ছেন বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪), জীবনানন্দ দাশ [১৯৯৯-১৯৫৪), সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-১৯৬০], বিষ্ণু দে [১৯০৯-১৯৮২) ও অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-১৯৮৬]। এ-পাঁচজন কবি মিলে সৃষ্টি করেন বাঙলা ভাষায় আধুনিক কবিতা। প্রেমেন্দ্র মিত্রও (১৯০৪-১৯৮৭) সাহায্য করেছিলেন আধুনিক কবিতার বিকাশে; কিন্তু তিনি চেতনার দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়েন। তাই পুরোপুরি আধুনিক ও গুরুত্বপূর্ণ কবি হয়ে উঠতে পারেন নি। আধুনিক কবিতার উদ্ভবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো কয়েকটি সাহিত্যপত্রিকা। এর মাঝে দুটি – কল্লোল (১৯২৩), ও কালি-কলম (১৯২৬), বেরোতে কলকাতা থেকে; এবং একটি – প্রগতি (১৯২৭)—বেরোত ঢাকা থেকে। আধুনিক কবিতার বিকাশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো একটি কবিতাপত্রিকা। নাম কবিতা (১৯৩৫)। বুদ্ধদেব বসু ছিলেন কবিতার সম্পাদক। আধুনিক কবিতা কিন্তু শুরুতেই সাদর অভ্যর্থনা পায় নি; বরং বিরূপতার মুখখামুখি হয়েছিলো বেশ। এমনকি রবীন্দ্রনাথও ছিলেন আধুনিকদের বিরোধী। কারণ আধুনিকেরা ছিলেন রবীন্দ্রবিরোধী। আধুনিকেরা এমন কবিতা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, যা রবীন্দ্রনাথের কবিতার সম্পূর্ণ বিপরীত। তাঁরা ছেড়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস ও আবেগ; ত্যাগ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের ভাষা ও ছন্দ। নতুনের বিকাশ হয় পুরোনো প্রধানের সাথে সংঘর্ষে। আগের রাজাকে হটাতে না পারলে সিংহাসন অধিকার করা যায় না। আধুনিকেরা বাঙলা কবিতার সিংহাসন অধিকার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে সিংহাসনচ্যুত করে। আধুনিক কবিতার সূচনা-বছর হিশেবে ১৯২৫কে চিহ্নিত করা যায়। বিশের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে হয়েছে আধুনিক বাঙলা কবিতার সূচনা; আর ত্রিশের দশকে ঘটেছে তার বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা।