[৮] রবীন্দ্ররচনাবলী। এ-রচনাবলীতে সংগ্রহ করা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের সব বই। এর প্রথম খণ্ড বের হয়েছিলো ১৯৩৯ অব্দে। তারপর প্রতি বছর বের হতে থাকে রবীন্দ্ররচনাবলীর একেকটি খণ্ড। প্রতিটি খণ্ডে থাকে তার কয়েকটি কবিতা গল্প প্রবন্ধের বই, থাকে উপন্যাস। আজ পর্যন্ত আটাশটি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের শেষ কবিতা
রবীন্দ্রনাথ অস্ত্রোপচারের ফলে মারা যান। অস্ত্রোপচার না হলে আরো কিছুদিন বাঁচতেন। অস্ত্রোপচারের কিছু আগে ১৯৪১-এর জুলাই মাসের ৩০ তারিখে সকাল সাড়ে নটায় লেখেন তিনি তাঁর শেষ কবিতা। কবিতাটির অংশ :
তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে হে ছলনাময়ী।
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে সরল জীবনে।
এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত,
তার তরে রাখ নি গোপন রাত্রি।
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাসী ছিলেন। তবে মৃত্যুর আগে টলে গিয়েছিলো কি তাঁর বিশ্বাস? বিশ্বাস রাখা খুবই কঠিন, এমনকি রবীন্দ্রনাথের পক্ষেও।
বিশশতকের আলো : আধুনিকতা
আমরা বিশশতকের অধিবাসী। আর একটি দশক কেটে গেলে আমরা পৌছোবো একুশশতকে। বাঙলা সাহিত্যের শুরু হয়েছিলো আজ থেকে হাজার বছরেরও বেশি আগে। শুরুর দিকে ছিলেন কাহ্নপাদ-লুইপাদেরা; আমরা আছি এ-প্রান্তে। তবে শেষ প্রান্তে নয়। আরো অনেক শতক টিকে থাকবে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য। রূপ নেবে নতুন নতুন, হয়তো এমন রূপ নেবে, এমন হবে তার শোভা, যা আজ ভাবতেও পারছি না। গত এক হাজার বছরেও নিয়েছে নতুন নতুন রূপ। ছড়িয়েছে অভাবিত শোভা আর সৌন্দর্য। এক হাজার বছরের দীর্ঘ যাত্রায় কতো রকমের পথ তৈরি করেছে, বাঁক নিয়েছে নানা ধরনের। উনিশশতকে বাঙলা সাহিত্য হয়ে উঠেছিলো একধরনের আধুনিক। উনিশশতকি আধুনিক। বিশশতকে বাঙলা সাহিত্য হয়ে ওঠে নতুন ধরনের আলোতে উজ্জ্বল। হয়ে ওঠে বিশশতকি আধুনিক। আধুনিকতা বলতে এখন আমরা বিশশতকের আধুনিকতাকেই বুঝে থাকি। কবিতা, উপন্যাস, গল্প, নাটক সব এলাকায়ই বিশশতকে দেখা দেয় নতুন চেতনা, নতুন সৌন্দর্য। বিশশতকের বাঙলা সাহিত্য থেকে বিচ্ছুরিত হয় দুরূহ জটিল অভিনব আলো।
প্রতিটি শতক বা শতাব্দীর থাকে নিজস্ব চেতনা। উনিশশতকের নিজস্ব ভালো লাগা মন্দ লাগা ছিলো, নিজস্ব আবেগঅনুভূতি, স্বপ্ন, চেতনা ছিলো। তার প্রকাশ ঘটেছে ওই শতকের সাহিত্যে। একটি শতক কেটে গিয়ে যখন আসে আরেকটি শতক, তখন নববর্ষের মতো রাতারাতি নতুন চেতনার উন্মেষ-বিকাশ ঘটে না। নতুন শতকের এক বা দু-দশক। ধরে জীবনে ও সাহিত্যে রাজত্ব করতে থাকে পুরোনো শতকেরই চেতনা। তারপর এক সময় প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় তার বিরুদ্ধে। হয়তোবা দেশে বা বিশ্বে ঘটে কোনো বড়ো ঘটনা, যা প্রবলভাবে আলোড়িত করে জীবনকে। তখন সাহিত্য ও শিল্পকলায় নতুন চেতনা অভিনব রূপ ধরে দেখা দেয়। ইউরোপে উনিশশতকের শেষ দিকেই উনিশশতকি চেতনার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিলো। কিন্তু আমাদের দেশ প্রথাগত; পুরোনোকে আঁকড়ে থাকতেই আমরা ভালোবাসি। নতুনকে আমরা খুব ভয় করি। তাই প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে সময় লাগে। এ-কারণেই বিশশতক আসার পরও দু-দশক ধরে বাঙলা সাহিত্যে উনিশশতকের চেতনাই প্রকাশ পেতে থাকে। কারণ রবীন্দ্রনাথ তখন লিখে চলছিলেন তাঁর অসামান্য কবিতাগুলো। তখনো ওই কবিতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার সময় আসে নি।
বিশশতকের দ্বিতীয় দশকে, ১৯১৪-১৯১৮তে, ঘটে মানুষের ইতিহাসের প্রথম সবচেয়ে বড় সংকট। ওই সংকটের নাম প্রথম মহাযুদ্ধ। ওই মহাযুদ্ধে আমাদের দেশ পশ্চিমের মতো জড়িয়ে পড়ে নি; কিন্তু তার উত্তাপ থেকে দূরেও থাকতে পারে নি আমাদের দেশ, জীবন ও সাহিত্য। প্রথম মহাযুদ্ধ ইউরোপকে বদলে দেয়। বদল ঘটে ইউরোপীয় চেতনার। অবিশ্বাস, ক্লান্তি, অমানবিকতা, নৈরাশ্য প্রভৃতি ইউরোপীয় সাহিত্যে নানাভাবে প্রকাশ পেয়ে সৃষ্টি করে নতুন সাহিত্য। আধুনিক সাহিত্য। বাঙলা সাহিত্যেও তার প্রভাব পড়ে; এবং বিকশিত হয় বিশশতকের আধুনিক সাহিত্য। তবে তার জন্যে আমাদের প্রায় আড়াই দশক অপেক্ষা করতে হয়েছিলো। বলা যায়, বাঙলা সাহিত্যে বিশশতক এসেছিলো বিশশতকের তৃতীয় দশকের মাঝামাঝি। প্রথমে এসেছিলো কবিতায়, যাকে বলি আধুনিক কবিতা। ওই আধুনিক কবিতাই বিশশতকের বাঙলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, উজ্জ্বলতম আলোকমালা।
বিশশতকের প্রথম দু-দশকে রবীন্দ্রনাথ লিখে চলছিলেন তাঁর চল্লিশোর বয়সের আশ্চর্য কবিতাবলি। তাঁর কবিতার রোম্যান্টিক বন্যায় তখন প্লাবিত পাঠকের চিত্ত। এ-সময় বের হয় তাঁর নৈবেদ্য (১৯০১), খেয়া (১৯০৬), শিশু (১৯০৯), গীতাঞ্জলি (১৯১০), বলাকা (১৯১৬)। তখন বাঙলা কবিতায় রবীন্দ্র-যুগ চলছে। তাঁর কবিতা অসামান্য কিন্তু চেতনায় তা উনিশশতকেরই। জীবনের প্রথমার্ধে যে-সব বোধবিশ্বাসআবেগ অঙ্কুরিত হয়েছিলো তার মনোলোকে, এ-সময়ে তাই পুষ্পিত হয়ে উঠছিলো তাঁর কবিতায়। ওই সব পুষ্পের মূল ছিলো উনিশশতকে। তখন দেখা দিয়েছিলেন একগোত্র তরুণ কবি, যাঁরা ছিলেন পুরোপুরি রবীন্দ্রানুসারী। ওই কবিদের কেউকেউ কিছুকিছু চমৎকার কবিতা লিখেছেন, কিন্তু তাতে বিশশতককে পাওয়া যায় না। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২)। তিনি প্রচুর লিখেছিলেন, হালকা ছন্দের যাদু সৃষ্টি করে ছন্দের যাদুকর’ উপাধিও পেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর কবিতার মূল্য কম। তিনি বেশিদিন বাঁচেন নি; বাঁচলেও যে খুব বড় কবি হয়ে উঠতেন, এমন মনে হয় না। তাঁর কয়েকটি কাব্য বেণু ও বীণা (১৯০৬), হোমশিখা (১৯০৭), কুহু ও কেকা (১৯১২), অভ্র-আবীর (১৯১৬)। এ-সময়ে যতীন্দ্রমোহন বাগচী (১৮৭৮-১৯৪৮] লিখেছিলেন গুটিকয় মনোরম কবিতা। কাজলা-দিদি’ নামের একটি বেদনাকাতর কবিতার জন্যে তিনি প্রিয় হয়ে আছেন। তাঁর কাব্য হচ্ছে রেখা (১৯১০), অপরাজিতা (১৯১৩), নাগকেশর (১৯১৭)। কুমুদরঞ্জন মল্লিক (১৮৮২-১৯৭০) লিখেছিলেন পল্লীপ্রেমের কবিতা। তাঁর কাব্য উজানী (১৯১১), বনতুলসী (১৯১১), বনমল্লিকা (১৯১৮), রজনীগন্ধা (১৯২১)। তাঁরা ছিলেন রবীন্দ্রপ্রভাবিত। বুদ্ধদেব বসু তাঁদের সম্বন্ধে বলেছেন যে তাঁদের পক্ষে অনিবার্য ছিলো রবীন্দ্রনাথের অনুকরণ, এবং অসম্ভব ছিলো রবীন্দ্রনাথের অনুকরণ। তাঁরা কবিতায় এমন কিছু করতে পারেন নি যাকে বলা যায় গুরুত্বপূর্ণ। বিশশতকের চেতনা তাঁদের কবিতায় নেই। এ-কবিরা পুড়েছেন রবীন্দ্রআগুনে।