স্বর্ণকুমারী দেবী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বড়ো বোন। তাঁর উপন্যাসগুলো হচ্ছে দীপনির্বাণ (১৮৭৬), ছিন্নমুকুল (১৮৭৬), হুগলির ইমামবাড়ি (১৮৯৪), কাহাকে (১৮৭৮), বিদ্রোহ (১৮৯০), মিররাজ, ফুলের মালা (১৮৯৪), মিলন রাত্রি (১৯২৫)। মীর মশাররফ হোসেনের উপন্যাসের নাম বিষাদ সিন্ধু (১৮৮৫-৯০), উদাসীন পথিকের মনের কথা (১৮৯০), শিবনাথ শাস্ত্রীর উপন্যাসের নাম মেজ বৌ (১৮৭৯), যুগান্তর (১৮৯৫), নয়নতারা (১৮৯৯); শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের উপন্যাসের নাম শক্তিকানন (১৮৮৭), ফুলজানি (১৮৯৪), কৃতজ্ঞতা (১৮৯৬) ; ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের নাম কল্পতরু (১৮৭৪); ত্রৈলোক্যনাথের উপন্যাসের নাম কঙ্কাবতী (১২৯৯), ফোকলা দিগম্বর (১৯০১), মুক্তামালা (১৯০১)।
নাটক : জীবনের দ্বন্দ্ব
বাঙলাদেশের চিরকালের নাটক যাত্রা’। নাটক বলতে আজ যা বোঝায়, তা আধুনিক কালের সৃষ্টি। যাত্রার সাথে নাটকের পার্থক্য অনেক। যাত্রা পুরোনো কালের, নাটক নতুন কালের। বাঙলা নাটকের কথা বলতে গেলে প্রথমেই মনে পড়ে এক বিদেশিকে। সেবিদেশির দেশ রাশিয়া; নাম তার গেরাসিম লেবেদেফ [১৭৪৯-১৮১৮]। নাটক আর জ্ঞানপাগল এ-লোকটি কলকাতা আসেন আঠারোশতকের শেষদিকে। তিনিই কলকাতায় সবার আগে মঞ্চস্থ করেন নাটক। তিনি “ডিসগাইস” নামে একটি প্রহসনের অনুবাদ মঞ্চস্থ করেন ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে। তাঁকে অনুসরণ করে এরপর এ-দেশে গড়ে ওঠে মঞ্চ, এবং লিখিত ও অভিনীত হতে থাকে নাটক।
কিন্তু প্রথম বাঙলা মৌলিক নাটক লিখিত হ’তে লেগেছিলো আরো অর্ধেক শতাব্দীরও বেশি সময়। ১৮৫২ সাল বাঙলা নাটকের ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা। এ-বছরে লেখা হয় প্রথম বাঙলা মৌলিক নাটক। লেখা হয় কমেডি বা মিলনমধুর নাটক, লেখা হয় ট্র্যাজেডি বা বিয়োগান্ত নাটক। বাঙলা ভাষার প্রথম মৌলিক নাটকটির নাম ভদ্রার্জুন (১৮৫২), লিখেছিলেন তারাচরণ শিকদার। এটি একটি কমেডি। এ-নাটক প্রকাশের কিছুদিন পরে, এ-বছরই, প্রকাশিত হয় প্রথম ট্র্যাজেডি কীর্তিবিলাস (১৮৫২)। লিখেছিলেন যোগেন্দ্রচন্দ্র গুপ্ত। দ্রার্জুন নাটকের কাহিনী নেয়া হয়েছিল মহাভারত থেকে। মহাভারতের গল্পে আছে অর্জুন কৃষ্ণের বোন সুভদ্রাকে হরণ করে। সে-হরণের কাহিনী অবলম্বনে লেখা এটি। কীর্তিবিলাস-এর কাহিনী বেশ জটিল। পাঁচটি অঙ্কে নাট্যকার এক বেদনাঘন কাহিনী পরিবেশন করেছেন। ফরাশি ভাষায় একটি নাটক আছে, নাম তার ফায়েড্রা। এর কাহিনীর সাথে মিল আছে কীর্তিবিলাস নাটকের। এ-সময়ের আরেকজন নাট্যকার হরচন্দ্র ঘোষ (১৮১৭-১৮৮৪)। তিনি ইংরেজ নাট্যকার শেক্সপিয়রের কয়েকটি নাটকের কাহিনী অবলম্বনে বাঙলা ভাষায় লিখেছিলেন নাটক। তিনি মার্চেন্ট অফ ভেনিস-এর কাহিনী নিয়ে লেখেন ভানুমতী-চিত্তবিলাসনাটক (১৮৫৩), রোমিও-জুলিয়েট-এর গল্প নিয়ে লেখেন চারুমুখচিত্তহরা (১৮৬৪) নাটক। তাঁর আরো দুটি নাটক কৌরব বিয়োগ (১৮৫৮), রজতগিরিনন্দিনী (১৮৭৪)।
এ-সময় নাটক লিখে খুব নাম করেছিলেন রামনারায়ণ তর্করত্ন (১৮২২-১৮৮৬)। রামনারায়ণ বিদেশি সাহিত্যের সাথে বিশেষ পরিচিত ছিলেন না। চিন্তাভাবনায় ছিলেন একেবারে দেশি। তিনি লিখেছিলেন অনেকগুলো নাটক, সেগুলোতে নাটুকেপনা আছে ভীষণভাবে। তাই তখনকার লোকেরা রামায়ণকে বলতো নাটুকে রামনারায়ণ। তাঁর নাটকগুলো হচ্ছে কুলীনকুলসর্বস্ব (১৮৫৪), বেনীসংহার (১৮৫৬), রত্নাবলী (১৮৫৮), অভিজ্ঞানশকুন্তল (১৮৬০), মালতীমাধব (১৮৬৭), রুক্মিনীহরণ (১৮৭১), কংসবধ (১৮৭৫), ধর্মবিজয় (১৮৭৫), নবনাটক (১৮৬৬)। তার কয়েকটি প্রহসন হচ্ছে যেমন কর্ম তেমন ফল, উভয়সংকট, বুঝলে কিনা। কুলীনকুলসর্বস্ব তার শ্রেষ্ঠ নাটক। এ-নাটকটি রচনার এক চমৎকার ইতিহাস আছে। জমিদার কালীচন্দ্র রায়চৌধুরী পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন, কৌলীন্যপ্রথার অপকারিতা দেখিয়ে যিনি সবচেয়ে ভালো নাটক লিখতে পারবেন, তাঁকে তিনি পঞ্চাশ টাকা পুরস্কার দেবেন। কৌলীন্যপ্রথার অপকারিতা দেখিয়ে রামনারায়ণ রচনা করেন কুলীনকুলসর্বস্ব এবং পান পুরস্কার। তিনি নবনাটক রচনা করেছিলেন বহুবিবাহের দোষ দেখিয়ে। এটিও পেয়েছিলো পুরস্কার। এ-সময়ের আরো কয়েকজন নাট্যকার হচ্ছেন উমেশচন্দ্র মিত্র, নন্দকুমার রায়, কালীপ্রসন্ন সিংহ। উমেশ মিত্র বিধবাবিবাহের পক্ষে লেখেন বিধবাবিবাহনাটক (১৮৫৬), তাঁর অন্য নাটক হলো সীতার বনবাস নাটক (১২৭২)। নন্দকুমারের নাটকের নাম অভিজ্ঞানশকুন্তলা (১৮৫৫)। কালীপ্রসন্ন সিংহ ছিলেন সেকালের এক বিখ্যাত ব্যক্তি। তিনি বেঁচেছিলেন মাত্র তিরিশ বছর { ১৮৪০-১৮৭০)। তিনি রচনা করেছিলেন সাবিত্রী-সত্যবান (১৮৫৮), মালতীমাধব (১৮৫৯)। মাত্র তিরিশ বছর বয়সে মারা যান কালীপ্রসন্ন; আর বাঙলা সাহিত্য হারায় এক অসাধারণ প্রতিভাকে।
পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে আসেন বাঙলা নাটকের অমর পুরুষ মধুসূদন দত্ত। যেমন কবিতার ক্ষেত্রে তিনি এসেছিলেন সকলকে চমকিত করে এবং রাশিরাশি সোনার ফসল ফলিয়ে গিয়েছিলেন, নাটকের ক্ষেত্রেও তিনি আসেন তেমনি করে। আসেন আর নাটকের সোনার ফসল ফলান। মধুসূদন বাঙলা সাহিত্যে প্রবেশ করেছিলেন নাটক হাতে করেই। মধুসূদন অনেক কিছু করেছেন তীব্র ঝোঁকের বশে, অনেকটা বাজি ধরে। তার ছিলো অসামান্য প্রতিভা, তাই তিনি হঠাৎ করে দিগ্বিজয় করতে পেরেছেন। অন্যরা যা পারেন না অনেকদিন সাধনা করে, মধুসূদন তা করেন কলম হাতে নিয়েই। মধুসূদনের সময় নাটক লেখা হতো অনেক, এবং ভীষণ উৎসবের সাথে সেগুলো হতো অভিনীত। কিন্তু ও-সকল নাটককে তিনি মেনে নিতে পারেন নি নাটক বলে।