কেউ কেউ মনে করেন, বাঙলা ভাষার উদ্ভব ঘটেছে সপ্তম শতাব্দীতে। কিন্তু আজকাল আর বাঙলা ভাষাকে এতো প্রাচীন বলে মনে করা হয় না; মনে করা হয় ৯৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি কোনো সময়ে বাঙলা ভাষার জন্ম হয়েছিলো। প্রাচীন এ-বাঙলা ভাষার পরিচয় আছে চর্যাপদ নামক বইটির কবিতাগুলোতে। এর বাঙলা ভাষা প্রাচীন বাঙলা ভাষা, সদ্য জন্ম লাভ করেছে, তার আকৃতি পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে নি। এর ভাষা কেমন কেমন লাগে, এর শব্দগুলো আমাদের অপরিচিত, এর শব্দ ব্যবহারের রীতি আজকের রীতির থেকে ভিন্ন। এর কবিতাগুলো পড়ে অর্থ বুঝতে কষ্ট হয়। আলো অন্ধকারের রহস্য এর ভাষার মধ্যে জড়িয়ে আছে। এজন্যে এর ভাষাকে বলা হয় সন্ধ্যাভাষা’। সন্ধ্যার কুহেলিকা এর পংক্তিতে পংক্তিতে ছড়ানো।
জন্মের পর থেকে বাঙলা ভাষা পাথরের মতো এক স্থানে বসে থাকে নি। বাঙলা ভাষা পরিবর্তিত হয়েছে। মানুষের কণ্ঠে, কবিদের রচনায়। এ-বদলের প্রকৃতি অনুসারে বাঙলা ভাষাকে তিনটি স্তরে বিভক্ত করা হয়। প্রথম স্তরটি প্রাচীন বাঙলা ভাষা। এর প্রচলন ছিলো ৯৫০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তারপর দেড়শো বছর, ১২০০ থেকে ১৩৫০ পর্যন্ত বাঙলা ভাষার কোনো নমুনা পাওয়া যায় নি। দ্বিতীয় স্তরটি মধ্যযুগের বাঙলা ভাষা। ১৩৫০ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যে-ভাষা আমরা পাই, তাই মধ্যযুগের বাঙলা ভাষা। এ-ভাষাও আজকের বাঙলা ভাষার মতো নয়। তবে তা হয়ে উঠেছে আমাদের আজকের ভাষার অনেক কাছাকাছি। এ-ভাষায় লেখা সাহিত্য অনায়াসে পড়া যায়, বোঝা যায়। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু হয় আধুনিক বাঙলা ভাষা। আধুনিক বাঙলা ভাষাকেও ইচ্ছে করলে কয়েকটি ভাগে ভাগ করতে পারি।
আজ যে-দেশের নাম বাঙলাদেশ, তার আকৃতি কিন্তু চিরকাল এরকম ছিলো না। আগে বাঙলাদেশ বিভক্ত ছিলো নানা খণ্ডে; তাদের নামও ছিলো নানারকম। কিন্তু বাঙলা বা বঙ্গ’ অথবা বাঙ্গালা’ যে-নামেই একে ডাকি না কেনো, এর নামটি এসেছে কোথা থেকে? এ-দেশের নামের কাহিনী বলেছেন সম্রাট আকবরের সভার এক রত্ন আবুল ফজল। তিনি বলেছেন বঙ্গ’ শব্দের সাথে ‘আল’ শব্দটি মিলিত হয়ে এদেশের নাম হয়েছে বাঙ্গাল’ বা বাঙ্গালা’। আমরা আজ বলি বাঙলা। আল’ কাকে বলে? এদেশে আছে খেতের পরে খেত; এক খেতের সাথে অপর খেত যাতে মিলে না যায়, তার জন্যে থাকে আল। আল’ বলতে বাঁধও বোঝায়। এদেশ বৃষ্টির দেশ, বর্ষার দেশ, তাই এখানে দরকার হতো অসংখ্য বাঁধের। আল বা বাঁধ বেশি ছিলো বলেই এদেশের নাম হয়েছে বাঙ্গালা বা বাঙলা। বাঙলা নামের ব্যুৎপত্তিটি একটু কেমন কেমন। বাঙলাদেশ বহু বহু বছর আগে বিভক্ত ছিলো নানা জনপদ বা অংশে। একেকটি কোমের নরনারী নিয়ে গড়ে উঠেছিলো একেকটি জনপদ। ওই জনপদের নাম হতো যে-কোম সেখানে বাস করতো, তার নামে। কয়েকটি কোমের নাম : বঙ্গ, গৌড়, পুণ্ড, রাঢ়। এ-কোমগুলো যে-জনপদগুলোতে বাস করতো পরে সেজনপদগুলোর নাম হয় বঙ্গ, গৌড়, পুণ্ড ও রাঢ়। এগুলো ছিলো পৃথক রাষ্ট্র।
প্রাচীনতম কাল থেকে ষষ্ঠ-সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত বাংলাদেশ ছিলো এসব ভিন্ন ভিন্ন জনপদে বিভক্ত। একটি রাষ্ট্রে জমাট বাঁধতে এর অনেক সময় লেগেছে। সপ্তম শতাব্দীর আদিভাগে শশাঙ্ক গৌড়ের রাজা হন। তার সময়ে বর্তমানের পশ্চিম বাঙলা প্রথমবারের মতো ঐক্যবদ্ধ হয়। তারপর বাঙলাদেশে তিনটি জনপদ বড়ো হয়ে দেখা দেয়, অন্যান্য জনপদ সেগুলোর কাছে ম্লান হয়ে যায়। এ-জনপদ তিনটি হচ্ছে পুঞ, গৌড়, রাঢ়। শশাঙ্ক ও পালরাজারা অধিপতি ছিলেন রাঢ়ের অর্থাৎ পশ্চিম বঙ্গের। কিন্তু তাঁদের সময়ে একটি মজার কাণ্ড ঘটে। তাঁরা নিজেদের ‘রাঢ়াধিপতি’ বলে পরিচয় না দিয়ে নিজেদের পরিচয় দিতে থাকেন ‘গৌড়াধিপতি বলে। গৌড় নামে সমগ্র দেশকে সংহত করতে চেয়েছিলেন শশাঙ্ক, পালরাজারা, এবং সেনরাজারা। কিন্তু তাঁদের চেষ্টা সার্থক হয় নি। কেননা গৌড়ের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো বঙ্গ। পাঠান শাসনকালে জয় হয় বঙ্গের; পাঠান শাসকেরা বঙ্গ নামে একত্র করেন বাঙলার সমস্ত জনপদ। ইংরেজদের শাসনকালে বাঙলা নামটি আরো প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কিন্তু আকারে হয়ে পড়ে ছোটো।
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ত্রিখণ্ডিত হয়। বাঙলার একটি বড়ো অংশ হয়ে পড়ে পাকিস্তানের উপনিবেশ। তখন তার নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান। কিন্তু বাঙালিরা বাঙলার এনাম মনেপ্রাণে কখনো গ্রহণ করে নি। তাই ১৯৭১-এ জন্ম নেয় নতুন বাঙলাদেশ। বাঙলা সাহিত্য বাঙলাদেশ, এবং বর্তমানে যাকে পশ্চিম বাঙলা’ বলা হয়, তার মিলিত সম্পদ।
বাঙলা সাহিত্যের তিন যুগ
দশম শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে রচিত হচ্ছে বাঙলা সাহিত্য। তাই বাঙলা সাহিত্যের বয়স এক হাজার বছরেরও বেশি। এ-সময়ে সৃষ্টি হয়েছে সুবিশাল এক সাহিত্য। সাহিত্য নানা সময়ে নানা রূপ ধারণ করে। কালে কালে নতুন হয়ে সামনের দিকে এগোয় সাহিত্য। হাজার বছরে বাঙলা সাহিত্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক নিয়েছে, এ-বাঁকগুলো অত্যন্ত স্পষ্ট। হাজার বছরের বাঙলা সাহিত্যকে ভাগ করা হয় তিনটি যুগে। যুগ তিনটি হচ্ছে :
[কি] প্রাচীন যুগ : ৯৫০ থেকে ১২০০ পর্যন্ত।
[খ] মধ্যযুগ : ১৩৫০ থেকে ১৮০০ পর্যন্ত।
[গ] আধুনিক যুগ : ১৮০০ থেকে আজ পর্যন্ত, আরো বহুদিন পর্যন্ত।
এ-তিন যুগের সাহিত্যই বাঙলা সাহিত্য, কিন্তু তবু বিষয়বস্তুতে, রচনারীতিতে এ-তিন যুগের সাহিত্য তিন রকম। প্রাচীন যুগে পাওয়া যায় একটি মাত্র বই, যার নাম চর্যাপদ। এর ভাষা আজ দুর্বোধ্য, বিষয়বস্তু দুরূহ। এর কবিরা সকলের জন্যে সাহিত্য রচনা করেন। নি, করেছেন নিজেদের জন্যে। তাছাড়া সাহিত্য রচনার উদ্দেশ্যও হয়তো তাঁদের ছিলো না। তারা সবাই ছিলেন বৌদ্ধ সাধক; তারা এ-কবিতাগুলোতে নিজেদের সাধনার গোপন কথা বলেছেন। তবু মনের ছোঁয়ায় তাতে লেগেছে সাহিত্যের নানা রঙ ও সৌরভ। এর পরে দেড়শো বছর বাঙলা ভাষায় আর কিছু রচিত হয় নি। কালো, ফসলশূন্য এ-সময়টিকে [১২০০ থেকে ১৩৫০] বলা হয় অন্ধকার যুগ। কেননা এ-সময়ে আমরা কোনো সাহিত্য পাই নি। অন্ধকার যুগের পরে পুনরায় প্রদীপ জ্বলে, আসে মধ্যযুগ। এ-যুগটি সুদীর্ঘ। এসময়ে রচিত হয় অসংখ্য কাহিনীকাব্য, সংখ্যাহীন গীতিকবিতা; মানুষ আর দেবতার কথা গীত হয় একসাথে। আগের মতো সাহিত্য আর সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে নি, এর মধ্যে দেখা দেয় বিস্তার। এর ফলে সাহিত্যে স্থান পায় দেবতা ও দৈত্য, মানুষ ও অতিমানুষ; আসে গৃহের কথা, সিংহাসনের কাহিনী। এ-সময়ে যাঁরা মহৎ কবি, তাঁদের কিছু নাম : বড় চণ্ডীদাস, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, বিজয়গুপ্ত, চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, ভারতচন্দ্র, আলাওল, কাজী দৌলত। মধ্যযুগের একশ্রেণীর কাব্যকে বলা হয় মঙ্গলকাব্য। এগুলো বেশ দীর্ঘ কাব্য। কোনো দেবতার মর্ত্যলোকে প্রতিষ্ঠার কাহিনী এগুলোতে বলেন কবিরা। এজন্যে মঙ্গলকাব্য দেবতাদের কাব্য। মধ্যযুগের সকল সাহিত্যই দেবতাকেন্দ্রিক, মানুষ সে-সময়ে প্রাধান্য লাভ করে নি। মানুষের সুখদুঃখের কথা এসেছে দেবতার কথাপ্রসঙ্গে। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না, কেননা দেবতার ছদ্মবেশে এ-সব কাব্য জুড়ে আছে মানুষ।