বিহারীলালের কবিতার বই আছে অনেকগুলো : সঙ্গীতশতক (১৮৬২), প্রেমপ্রবাহিণী (১৮৭০), বঙ্গসুন্দরী (১৮৭০), নিসর্গ সন্দর্শন (১৮৭০), সারদামঙ্গল (১২৮৬), সাধের আসন। এর মধ্যে যে-দুটি বই বিহারীলালের খ্যাতির কারণ, সেদুটি বঙ্গসুন্দরী এবং সারদামঙ্গল। বঙ্গসুন্দরী কাব্যে বিহারীলাল সর্বপ্রথম রোম্যান্টিক হাহাকার নিয়ে সবার সামনে উপস্থিত হন। এ-হাহাকার তীব্র, কবির আবেগে পাঠকও ভেসে যায়। অকারণ বেদনা হচ্ছে রোম্যান্টিক কবিতার একটি বড়ো লক্ষণ। কবি বেশ সুখে আছেন তবু সুখ পাচ্ছেন না, কেননা তিনি অসুখী তা তিনি নিজেও জানেন না। বিহারীলালের কবিতা থেকে তেমন চরণ তুলে আনি :
সর্বদাই হুহু করে মন,
বিশ্ব যেন মরুর মতন,
চারিদিকে ঝালাপালা,
উঃ কি জ্বলন্ত জ্বালা!
অগ্নিকুণ্ডে পতঙ্গ পতন।
কবির এ-জ্বালার কোনো কারণ নেই, তাইতো এ-জ্বালা অসহ্য। কবি বিহারীলালের শ্রেষ্ঠ কাব্যের নাম সারদামঙ্গল। এ-কাব্যে তাঁর রোম্যান্টিক আকুলতা চরণেচরণে প্রকাশ পেয়েছে, যদিও সর্বত্র তা রূপ পায় নি। কবি এ-কাব্যে এতো রকমের স্বপ্ন দেখেছেন, এতো রকমের আবেগ প্রকাশ করেছেন যে কাব্যটি পড়ে বুঝতে কষ্ট হয় কবি কী বললেন। মনের আবেগে তিনি চরণের পরে চরণ রচনা করেছেন, একবারও ভাবেন নি পাঠকদের কথা। তবে কাব্যটির আছে ভালোভালো গীতিকবিতা, পাঠকের জন্যে ওইটুকু কম লাভ নয়। বিহারীলালের মধ্যে একজন বড়ো কবি বাস করতেন, কিন্তু সে-কবি আত্মপ্রকাশ করতে পারেন নি। আবেগের ঘনমেঘে সে চিরদিন অদৃশ্য রয়েছে। বিহারীলাল বাঙলা ভাষার বিশুদ্ধ কবিদের একজন।
বিহারীলালের অন্তরঙ্গ কবিতার পথ ধরে এসেছিলেন অনেক কবি। তাঁদের কয়েকজন : সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার (১৮৩৮-১৮৭৮), দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪০-১৯২৬), দেবেন্দ্রনাথ সেন (১৮৫৮-১৯২০), গোবিন্দচন্দ্র দাস (১৮৫৫-১৯১৮), অক্ষয়কুমার বড়াল (১৮৬০-১৯১৯), দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩), এবং রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১)। সুরেন্দ্রনাথের কাব্যের নাম মহিলা, দ্বিজেন্দ্রনাথের কাব্যের নাম স্বল্পপ্রয়াণ, গোবিন্দচন্দ্র দাসের কাব্যের নাম প্রেম ও ফুল, শোকোচ্ছাস, মগের মুলুক। তিনি প্রতিবাদী কবি ছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ সেনের কাব্যের নাম ফুলবালা, অশোকগুচ্ছ গোলাপগুচ্ছ, পারিজাতগুচ্ছ, শেফালিগুচ্ছ। অক্ষয়কুমার বড়ালের কাব্যের নাম এষা। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কাব্যের নাম আর্যগাথা, আষাঢ়ে, হাসির গান, মন্দ্র, আলেখ্য।
উপন্যাস : মানুষের মহাকাব্য
উপন্যাস মানুষের কাহিনী; সাধারণ মানুষের কাহিনী। চারপাশের বাস্তব মানুষের গল্প। আগে সাহিত্য রচিত হতো দেবতাদের নিয়ে, পরীদের নিয়ে, তাদের নিয়ে যারা অসাধারণ। মানুষের জীবনে গল্প আছে, এবং তা শোনার মতো, একথা মনে হয় নি মানুষের শতোশতো বছরে। আধুনিককালে এক সময় মানুষ আবিষ্কার করে যে তারই মধ্যে রয়েছে সবচেয়ে বেশি গল্প। তার ঘরে, তার মনে, তার চারদিকে, তাকে ঘিরে আছে গল্প, এবং তা শোনার মতো, বলার মতো। এ-চেতনা থেকে সৃষ্টি হয় উপন্যাস আধুনিক কালে। উপন্যাস তাই আধুনিক কালের ফসল। মানুষ সহজে মানুষকে চিনতে পারে না, তাই উপন্যাস নিয়ে বিপদ অনেক। মানুষ প্রথম উপন্যাস রচনা করতে এসে বেছে নেয় মানুষের মধ্যে যারা বড়ো, তাদের। আজকাল এ-বিষয়েও বদল ঘটেছে। আজ উপন্যাসে অতি সাধারণ মানুষের আধিপত্য। উপন্যাস সাধারণ মানুষের মহাকাব্য।
উপন্যাস একদিকে বেশ সহজ শিল্পকর্ম, আবার অন্যদিকে বেশ জটিল। একজন মানুষের জীবনের সব ঘটনা লিখে ফেললে তা উপন্যাস হবে। কিন্তু উপন্যাসকে এতো সহজ ভাবলে বিপদ অনেক। উপন্যাস হয় আকারে বড়ড়া, আর সাদরে গ্রহণ করে জীবনের সবকিছু। কিছুই পরিত্যাগ করে না, কাউকে বলে না আমার মধ্যে তোমার স্থান নেই। তাই উপন্যাসের লেখকের জানতে হয় তিনি জীবনের এতো ধনের মধ্যে কোনটুকু নেবেন বেছে আর কোনটুকু করবেন পরিত্যাগ।
বাঙলা সাহিত্যে, পৃথিবীর অন্যান্য সাহিত্যের মতোই, উপন্যাস এসেছে বেশ পরে; উনিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে। প্যারীচাঁদ মিত্রের আলালের ঘরের দুলালকে (১৮৫৮) বাঙলা ভাষার প্রথম উপন্যাস বলা হয়। আবার কেউ বলেন, এটি প্রথম উপন্যাস নয়, প্রথম উপন্যাস এক বিদেশিনীর লেখা। তাঁর নাম হেনা ক্যাথেরিন অ্যালেনস। তার বইয়ের নাম ফুলমণি ও করুণার বিবরণ। বইটি বেরিয়েছিলো ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে। বইটিতে কিন্তু লেখিকা মানুষের গল্প শোনাতে চান নি, চেয়েছিলেন খ্রিস্টধর্ম প্রচার করতে। তিনি খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত এক বাঙালি পরিবারের ছবি এঁকেছেন এ-বইতে, দেখাতে চেয়েছেন জিতে যার আস্থা গভীর, সে সুখে থাকে এবং যার আস্থা নেই, সে থাকে কষ্টে। বইটিতে উপন্যাসের গুণ নেই বললেই চলে, তাই এটিকে প্রথম উপন্যাস বলা যায় না। অনেক ত্রুটি সত্ত্বেও প্যারীচাঁদ মিত্রের “আলালের ঘরের দুলালই বাঙলা ভাষার প্রথম উপন্যাস।
প্যারীচাঁদ তার মাসিক পত্রিকায় আলালের ঘরের দুলাল ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেন। বই আকারে এটি মুদ্রিত হয় ১৮৫৮ অব্দে। এ-কাহিনীর নায়ক মতিলাল। সে এক ধনী পিতার সন্তান, আদরে আদরে সে যায় নষ্ট হয়ে। এ-হচ্ছে আলাল-এর কাহিনী। তবে এটিকে নির্দোষ উপন্যাস বলা যায় না। উপন্যাসে আমরা যে-নিটোল কাহিনী, চিন্তার গভীরতা আশা করি তা এটিতে নেই। উপন্যাসের চরিত্রগুলোও ভালোভাবে ফোটে নি। এটিকে বলা যায় উপন্যাসের খসড়া। এ-উপন্যাসে একটি মজার চরিত্র আছে, তার নাম ঠকচাচা। ঠকচাচার ক্রিয়াকলাপ বেশ উপভোগ্য।