সম্মুখ সমরে পড়ি, বীর-চূড়ামণি
বীরবাহু, চলি যবে গেলা যমপুরে
অকালে, কহ, হে দেবি অমৃতভাষিণি,
কোন বীরবরে বরি সেনাপতি-পদে,
পাঠাইলা রণে পুনঃ রক্ষঃকুলনিধি
রাঘবারি?
পংক্তিগুলো পাওয়া যাবে মেঘনাদবধকাব্য-এর শুরুতেই। এখানে প্রতি চরণে চোদ্দ মাত্রা ঠিকই আছে, কিন্তু প্রতি চরণে বক্তব্য না থেমে থেমেছে সেখানে, যেখানে শেষ হয়েছে বক্তব্য। এটি ছন্দের ক্ষেত্রে একটি বিশাল ঘটনা। মধুসূদন মুক্তি দেন বাঙলা ছন্দকে; পয়ারকে করে তোলেন প্রবহমাণ। একে নির্ভর করে অনেক বিবর্তন ঘটেছে বাঙলা ছন্দের।
তিলোত্তমাসম্ভবকাব্য এবং মেঘনাদবধকাব্য ছাড়া মধুসূদন আরো লিখেছেন ব্রজাঙ্গনাকাব্য (১৮৬১), বীরাঙ্গনাকাব্য (১৮৬২), এবং চতুর্দশপদী কবিতাবলী (১৮৬৬)। “ব্রজাঙ্গনা” রাধার বিরহ নিয়ে রচিত কাব্য। এ-কাব্যে আছে কিছু চমৎকার লিরিক বা গীতিকবিতা। তার একটি অংশ :
কেন এতো ফুল তুলিলি, সজনি–
ভরিয়া ডালা?
মেঘাবৃত হলে পরে কি রজনী
তারার মালা?
আর কি যতনে কুসুম রতনে
ব্রজের বালা?
মধুসূদনের বীরাঙ্গণা এক অসাধারণ অভিনব কাব্য। বাঙলা ভাষায় মধুসূদন সর্বপ্রথম রচনা করেন সনেট, তিনি যার নাম দিয়েছিলেন “চতুর্দশপদী কবিতা”। ১৮৬০ সালে তিনি প্রথম সনেট লেখার কথা ভাবেন, এবং একটি সনেট রচনাও করেন। এটিই পুরে পুনর্লিখিত হয়ে নাম পায় বঙ্গভাষা’। মধুসূদন সনেট লিখেছিলেন ফ্রান্সের ভার্সাই শহরে বসে। তখন তিনি ছিলেন পরবাসী, দারিদ্রপীড়িত। তাই এ-সনেটগুলোতে তাঁর মনের আবেগ, অনুভূতি, বেদনা থরেথরে প্রকাশিত হয়েছে। মধুসূদনকে আমরা জানি অলঙ্কারশোভিত ঘনঘটাময় মহাকাব্যের নৈব্যক্তিক কবি বলে। তাঁর ছিলো একটি অতি সকাতর চিত্ত, যা সাধারণত থাকে রোমান্টিক কবিদের। মধুসূদন বাঙলা কবিতাকে মধ্যযুগ থেকে নিয়ে আসেন আধুনিক কালে। সৃষ্টি করেন অমর কবিতা।
মধুসূদনের পরে বাঙলা কবিতায় দেখা দেয় অনুকৃতি, বৈচিত্র্যহীনতা। মধুসূদন মহাকাব্য রচনা করেছেন, তাই তাঁর পরে অনেকে চেষ্টা করেন মহাকাব্য লিখে মহাকবি হ’তে। এর ফলে বাঙলা কবিতায় দেখা দেয় এক শ্রেণীর দীর্ঘ আখ্যায়িকা কাব্য, যেগুলো দেখতে মহাকাব্যের মতো, কিন্তু মহাকাব্য নয়। মহাকাব্য প্রতিবছর রচনা করা যায় না; মহাকাব্য রচিত হতে পারে কয়েকশো বছরে একটি। এছাড়া আধুনিক কাল মহাকাব্যের কালও নয়। মধুসূদনপরবর্তী কবিরা এ-কথাটি বুঝতে পারেন নি। বা পারলেও তাদের ক্ষমতা ছিলো না কবিতার দিক বদল করতে। তাই তাঁরা আপ্রাণ অনুসরণ করেন মধুসূদনকে। দেখতে মহাকাব্যের মততা, কিন্তু আসলে তা নয়, এরকম কাব্য লেখেন হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৯০৩), নবীনচন্দ্র সেন (১৮৪৭-১৯০৯), কায়কোবাদ [১৮৫৭-১৯৫১), এবং আরো অনেকে। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেন বীরবাহুকাব্য (১৮৬৪), বৃত্রসংহার (১৮৭৫-১৮৭৭)। তাঁর কিছু খণ্ডকবিতাও আছে। নবীনচন্দ্র সেন লেখেন পলাশির যুদ্ধ (১৮৬৬), ক্লিওপেট্রা (১৮৭৭), রঙ্গমতী (১৮৮০) এবং রৈবতক (১৮৮৬), কুরুক্ষেত্র (১৮৯৩), প্রভাস (১৮৯৬)। তিনি কিছু ক্ষুদ্র কবিতাও রচনা করেছিলেন, সেগুলো সংগৃহীত হয়েছিলো অবকাশরঞ্জিনী (১৮৭১) নামক কাব্যে। কায়কোবাদ মহাকবি হওয়ার জন্যে লিখেছিলেন মহাকাব্য, যদিও তাঁর মনটি ছিলো গীতিকবির। তিনি ছিলেন আবেগী, গীতিকবিতার চর্চা করলে তিনি আরো কবি হ’তে পারতেন। তিনি পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ অবলম্বনে রচনা করেন মহাশ্মশান কাব্য (১৯০৪)। তাঁর অন্যান্য কাহিনীকাব্য হচ্ছে মহররমশরিফ কাব্য (১৯৩২), শিবমন্দির (১৯৩৮)। তাঁর খণ্ডকবিতার বই বিরহবিলাপ (১৮৭০), অশ্রুমালা (১৮৯৫)। এ-সময়ে আর যারা কবিতা লিখেছেন তাঁদের মধ্যে আছেন শিবনাথ শাস্ত্রী, অক্ষয় চৌধুরী, ঈশানচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।
বাঙলা কবিতায় যখন মহাকাব্যের ঘনঘটা চলছিলো, তখন এক লাজুক নির্জন কবি নিজের মনের কথা নিজের সুরে ধ্বনিত করেন। কবি নিজের আবেগে বিভোর, তাঁর চারদিকে কী আছে সেদিকে খেয়াল নেই। তিনি বাস করছেন নিজের অন্তরঙ্গলোকে; তিনি কারা উদ্দেশে কিছু বলেন না, শুধু গুণগুণ করেন নিজেকে নিজের কাছে। এ-কবির মধ্যে সর্বপ্রথম দেখা দেয় রোম্যান্টিকতা, যা একদিন বাঙলা কবিতাকে অধিকার করে নেয়। একবির নাম বিহারীলাল চক্রবর্তী (১৮৩৫-১৮৯৪)। যে-কবি নিজের মনের কথা বলেন, যেকবি অদ্ভুতকে, সুন্দরকে, রহস্যকে আহ্বান করেন, যে-কবি যা পান না বা পাবেন না, তা চেয়েচেয়ে জীবন কাটান, তিনি রোম্যান্টিক কবি। বিহারীলাল বাঙলা কবিতার প্রথম রোম্যান্টিক কবি, প্রথম খাঁটি আধুনিক কবি। তার পথ ধরে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বিহারীলালকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন বাঙলা কাব্যের ‘ভোরের পাখি’। ভোরের পাখি সূর্যোদয়ের আগে একাকী জাগে, মনের আনন্দে গান গায়, সূর্য ওঠার পর সে আর থাকে না। বিহারীলালও তেমনি, একাকী নিজের মনের গীতিকা সুরে বেঁধেছিলেন তিনি; তবে ভোর হওয়ার পরও তিনি আছেন। বিহারীলালের কবিতা পড়লে মনে হয় কবি বাস করছেন দিগদিগন্তব্যাপী। আবেগের কাতরতার মধ্যে, স্বপ্নের মধ্যে। ওই তাঁর বিশেষত্ব। তিনি স্বপ্নলোকের অধিবাসী, বাস্তবতা তাঁর অচেনা। তিনি বাঙলা কবিতার প্রথম ধাপ-না-খাওয়া কবি। তিনি একটি নতুন রোম্যান্টিকধারার প্রবর্তক হিশেবে চিরস্মরণীয়। বিহারীলালের মধ্যে রোমান্টিক আবেগের প্রাচুর্য রয়েছে, কিন্তু নেই সে আবেগকে রূপ দেয়ার শক্তি। এ-আবেগকে পরে রূপ দিয়েছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ, বিহারীলালের শিষ্য। বিহারীলাল এমন কিছু স্তবক ও পংক্তি লিখে গেছেন, যেগুলো বাঙলা কবিতার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।