ঈশ্বর গুপ্তের কবিতার একটি বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ার মতো। তা হলো কবির হাস্যরসিকতা। তিনি সবকিছু থেকে হাস্যরস আহরণ করেন, দুঃখের মধ্যেও তাঁর হাসি থামে না। তাঁর একটি বড়ো দুঃখের কবিতা থেকে কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি। কবিতাটির নাম “পৌষপার্বণ”। কবি বড়ো দুঃখের কথা বলেছেন :
এবার বছরকার দিন, কপালে ভাই,
জুটলো নাকো, পুলি পিঠে।
যে মাগগির বাজার, হাজার হাজার,
মোর্তেছে লোক, কপাল পিটে।।
কবি কিন্তু খুব চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর একটি কবিতায় এক ইংরেজ রমণীর। তিনি লিখেছেন :
বিড়ালাক্ষী বিধুমুখী মুখে গন্ধ ছোটে।
আহা তায় রোজ রোজ কতো রোজ ফোটে।।
উনিশশতকের প্রথমার্ধের শেষদিকে দেখা দেন আরেকজন কবি। তিনি ঈশ্বর গুপ্তের চেয়ে কিছুটা আধুনিক; কিছুটা নয়, অনেকটা। তবে তিনি খাটি কবি ছিলেন না। তাঁর নাম রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর পদ্মিনী-উপাখ্যান নামক একটি আখ্যায়িকা কাব্য বের হয় ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে। কাব্যটিতে আছে অনেক ঘটনা, অনেক উপমা। তিনি কাব্যের কাহিনী আহরণ করেছিলেন টডের রাজস্থান-কাহিনী নামক একটি বই থেকে। এ-কাব্যটিতেই আছে সেই বিখ্যাত চরণগুলো স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়? দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে, কে পরিবে পায়? তবে পদ্মিনী-উপাখ্যান আধুনিক কবিতাকে বেশিদূর এগিয়ে নিতে পারে নি। এ-কবির আরো কয়েকটি কাব্য হচ্ছে কর্মদেবী (১৮৬২), শূরসুন্দরী (১৮৬৮), কাঞ্চীকাবেরী (১৯৭৯)।
বাঙলা কবিতায় আধুনিকতা আনেন কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩]। শুধু কবিতায় নয়, তিনি আধুনিকতা আনেন নাটকে, প্রহসনে। তাঁর মতো প্রতিভাবান কবি বাঙলা সাহিত্যে আছেন মাত্র আর একজন, তিনি রবীন্দ্রনাথ। মধুসূদন মহাকাব্য রচনা করে বাঙলা কবিতার রূপ বদলে দিয়েছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বা রঙ্গলালের পর তার আগমন অনেকটা আকস্মিক। তিনি সাহিত্য সাধনা করেছেন মাত্র কয়েক বছর, ধূমকেতুর মতো তিনি চোখ ধাধিয়ে এসেছেন, কতোগুলো সোনার ফসল ফলিয়েছেন, এবং হঠাৎ বিদায় নিয়েছেন। বাল্যকালে তিনি বাঙলা সাহিত্যের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ অনুভব করেন নি। কবি মধুসূদনের জীবন একটি বিয়োগান্তক নাটকের চেয়েও বেশি শিহরণময়, বেশি করুণ। ছেলেবেলা থেকেই তাঁর সাধ ছিলো বড়ো কবি হওয়ার; তবে বাঙলা ভাষার নয়, ইংরেজি ভাষার। ইংরেজি তিনি শিখেছিলেন ইংরেজের মতো, কবিতাও লিখেছিলেন ইংরেজিতে। ধর্ম বদলে হয়েছিলেন খ্রিস্টান, নাম নিয়েছিলেন মাইকেল। বিয়ে করেছেন দুবার, দুবারই বিদেশিনী। আবাল্য তিনি ছিলেন উদ্ধৃঙ্খল, হিশেব করা কাকে বলে তা তিনি জানতেন না। জীবনে তিনি অর্জন করেছেন অনেক টাকা, কিন্তু তাঁর জীবন সমাপ্ত হয়েছে দারিদ্রে। সব মিলে মধুসূদন তুলনাহীন। বিলেত যাওয়ার জন্যে তিনি ছিলেন পাগল। একটি ইংরেজি কবিতায় তাঁর আবেগ তীব্রভাবে তিনি প্রকাশ করেছেন; বলেছেন, “আই শাই ফর অ্যালবিঅনস ডিসট্যান্ট শোর’, অর্থাৎ ‘শ্বেতদ্বীপ তরে পড়ে মোর আকুল নিশ্বাস। তিনি ইংরেজি ভাষায় লিখেছিলেন দুটি দীর্ঘ কাব্য; একটির নাম ক্যাপটিভ লেডি, অপরটির নাম ভিশনস অফ দি পাস্ট। কিন্তু মধুসূদন বুঝেছিলেন তিনি যে-অমরতা কামনা করেন, তা লাভ করা যাবে না ইংরেজিতে লিখে। তাই তিনি হঠাৎ আসেন বাঙলা কবিতার ভুবনে। তিনি আসেন, দেখেন, জয় করেন। একটি চতুর্দশপদী বা সনেটে মধুসূদন বাঙলা কবিতার রাজ্যে আসার কথা বলেছেন। তার কিছু অংশ :
হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন-–
তা সবে (অবোধ আমি) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহুদিন সুখ পরিহরি।
কবি মধুসূদন বাঙলা কবিতার ভুবনে আসেন ১৮৫৯ অব্দে তিলোত্তমাসম্ভবকাব্য নামে একটি চার-সর্গের আখ্যায়িকা কাব্য নিয়ে। কাব্যটি বাঙলা কবিতার রাজ্যে নতুন। ভাব ভাষা প্রকাশরীতি সবদিকেই। তবু এটি মধুসূদনের প্রতিভার পরিচায়ক নয়। তাঁর প্রধান এবং বাঙলা কবিতার অন্যতম প্রধান কাব্য মেঘনাদবধকাব্য। প্রকাশিত হয় ১৮৬১ অব্দে। এ-কাব্য প্রকাশের সাথেসাথে স্বীকার করে নিতে হয় যে তিনি বাঙলার মহাকবিদের একজন। এটি একটি মহাকাব্য। নয় সর্গে রচিত এ-কাব্যের নায়ক রাবণ। মধুসূদন নতুন কালের বিদ্রোহী; তিনি চিরকাল দণ্ডিত রাবণকে তাই করে তোলেন তাঁর নায়ক। রাম সেখানে সামান্য। রাবণের মধ্য দিয়ে মধুসূদন তোলেন তাঁর সমকালের বেদনা দুঃখ আর ট্র্যাজেডি। মধুসূদন তার কাব্যের কাহিনী নিয়েছিলেন রামায়ণ থেকে; সীতা হরণ এবং রাবণের পতন এ-কাব্যের বিষয়। কিন্তু তাঁর হাতে এ-কাহিনী লাভ করে নতুন তাৎপর্য। হয়ে ওঠে অভিনব মহাকাব্য, বাঙলা ভাষায় যার কোনো তুলনা নেই।
এ-কাব্যে তিনি আর যা মহৎ কাজ করেন, তা হচ্ছে ছন্দের বিস্তৃতি। তিনি চিরদিনের বাঙলা পয়ারকে নতুন রূপ দেন। আগে পয়ার ছিলো বহুব্যবহারক্লান্ত ছন্দোরীতি। মধুসূদন পয়ারকে প্রচলিত আকৃতি থেকে মুক্তি দিয়ে করে তোলেন প্রবহমাণ। একে অনেকে বলেন ‘অমিত্রাক্ষর ছন্দ’। পয়ার এমন :
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শশানে পুণ্যবান।।
আগে কবিরা চোদ্দ মাত্রার প্রতিটি চরণের শেষে এসে থেমে পড়তেন। প্রথম চরণের শেষে দিতেন এক দাঁড়ি, দ্বিতীয় চরণের শেষে দু-দাঁড়ি। এ-ভাবে শ্লথগতিতে কাব্য এগিয়ে চলতো। কবিরা তখন ছিলেন ছন্দের দাস, যা তারা বলতে চাইতেন পারতেন না বলতে; কেননা প্রতি চরণের শেষে তাঁদের জিরোতে হতো। কবি মধুসূদন ছন্দের এ-শৃঙ্খলটাকে ভেঙে ফেলেন। তিনি ছন্দকে করেন কবির বক্তব্যের অনুগামী। উদাহরণ দিলে বোঝা সহজ হবে :