বাঙলা গদ্যের ভুবনে এক তুমুল বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র। তাঁর ছদ্মনাম ছিলো টেকচাঁদ ঠাকুর। তিনি হৈচৈ বাধিয়েছিলেন বেশ। এতোদিন আমরা যে-গদ্য দেখেছি, তা হচ্ছে সাধু গদ্য। তাতে সংস্কৃত শব্দের প্রাধান্য লক্ষ্য করার মতো। প্যারীচাঁদ ১৮৫৪ সালে তার এক বন্ধুর সাথে প্রতিষ্ঠা করেন একটি পত্রিকা; নাম মাসিক পত্রিকা। তিনি ঘোষণা করেন সাধু গদ্য চলবে না, চলবে না সংস্কৃত শব্দ। বাঙলা ভাষাকে করতে হবে সত্যিকারে বাঙলা ভাষা। তিনি সাহিত্য রচনা করতে শুরু করেন কথ্যরীতিতে, সাধুরীতিতে নয়। যে-ভাষায় আমরা কথা বলি, প্যারীচাদ সে-ভাষা ব্যবহার করতে চান সাহিত্যে। এ-ভাষা হবে মুখের ভাষার অনুরূপ। দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তিনি নিজেই। লেখেন একটি উপন্যাস, প্রকাশ করতে থাকেন সাহিত্য পত্রিকায়। তাঁর এ-বইটির নাম আলালের ঘরের দুলাল (১৮৫৮)। প্যারীচাঁদ মিত্র বাঙলা গদ্যের রূপ বদলাতে চেয়েছিলেন। সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন নতুন গদ্য। আজকাল আমরা যে-চলতি গদ্য লিখি, তাই চেয়েছিলেন প্যারীচাঁদ। তাই তাঁর লেখায়, আলালের ঘরের দুলাল-এ তিনি ব্যবহার করেন চলতি ক্রিয়াপদ, ব্যবহার করেন বেশি পরিমাণে খাঁটি বাঙলা শব্দ। তিনি ভাষাকে চলতি ভাষা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি পুরোপুরি সফল হন নি। তাঁর গদ্য না চলতি, না সাধু। সাধু-চলতি-আঞ্চলিক সব রকমের ভাষা মিশিয়ে এক নতুন গদ্য তৈরি করেন তিনি। এভাষারীতি তিনি কাজে লাগিয়েছেন মাত্র আলালের ঘরের দুলাল-এ। তিনি রচনা করেছিলেন আরো অনেক বই, সেগুলো সবই বিদ্যাসাগরের মতো সাধু গদ্যে রচিত। তার আলালের ঘরের দুলাল বই আকারে প্রথম বের হয় ১৮৫৮ অব্দে। তাঁর অন্যান্য বই হচ্ছে মদ খাওয়ার বড় দায় জাত থাকার কি উপায় (১৮৫৯), রামারঞ্জিকা (১৮৬০), যৎকিঞ্চিৎ (১৮৬৫), ডেবিড হেয়ারের জীবনচরিত (১৮৭৮), বামাতোষিণী (১৮৮১)। প্যারীচাঁদের বিদ্রোহের পথ ধরে বাঙলা গদ্যের জগতে আসেন আরেক বিপ্লবী কালীপ্রসন্ন সিংহ [১৮৪০-১৮৭০l। তিনি চলতি গদ্যে লেখেন একটি অনন্য বই, যার নাম হুতোম পাচার নকশা (১৮৬২)। তাঁর এ-বইটি আলোড়ন জাগিয়েছিলো নানা কারণে, এর একটি বড়ো কারণ এর চলতি গদ্য। তাঁরা দুজন বাঙলা ভাষায় চলতি গদ্যের অগ্রপথিক।
এরপর আসেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি প্রথম যথার্থ ঔপন্যাসিক আমাদের সাহিত্যের এবং শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিকের একজন। তিনি বাঙলা গদ্যকে বিভিন্ন ভাবে বিকশিত করেছিলেন। ১৮০১ থেকে ১৮৬০ পর্যন্ত সকল গদ্য লেখকদের সাধনা যেনো চরম সফলতা হয়ে দেখা দেয় তার মধ্যে। তাঁর সম্বন্ধে বেশি বলবো না। একটি পুরো বই তো লেখা দরকার তাঁকে নিয়ে। বঙ্কিম বাঙালির সৃষ্টিশীলতা ও মনীষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রকাশ।
গদ্য বিকশিত হয়, অভাবিত সৃষ্টিশীল হয় বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস ও প্রবন্ধে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সে-গদ্যকে উচ্ছ্বসিত করে তোলেন গল্পে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে, চিঠিপত্রে। রবীন্দ্রপ্রসঙ্গেও বেশি বলার দরকার নেই। তবে একটু বলা দরকার আরেকজন সম্বন্ধে; তাঁর নাম প্রমথ চৌধুরী [১৮৬৮-১৯৪৬]। আমরা আজ যে সব কাজে চলতি গদ্য ব্যবহার করি, তা প্রমথ চৌধুরীরই জন্যে। তিনি সাহিত্যে এসেছিলেন চলতি গদ্যরীতিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যেই। তাতে তিনি সার্থক হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথও অনেকদিন চলতি গদ্য লেখেন নি, শেষ জীবনে লেখা শুরু করেন। এর মূলে আছেন প্রমথ চৌধুরী।
কবিতা : অন্তর হতে আহরি বচন
উনিশশতকের প্রথমার্ধ ভরে চলে গদ্যের রাজত্ব; সবদিকে কেবল গদ্যের পতাকা উড়তে থাকে। সে-সময়ে গদ্যই সম্রাট। যেদিকে তাকাই গদ্য আর গদ্য; গদ্যের মহাসমুদ্রে অবিরাম ঢেউ উঠছে আর ভেঙে পড়ছে। এ-সময়ে চলছিলো কবিতার আকাল। কোনো ফসলই ফলছিলো না কবিতার। বাঙলাদেশে এমনটি আর দেখা যায় নি। যদি কবিতাই না থাকে, তবে থাকলে কী বাঙলা সাহিত্যের! বাঙলা সাহিত্যের দেবী চিরকাল কাব্যজীবী, কবিতার স্বাদ ছাড়া সে বাঁচতেই পারে না। কিন্তু উনিশশতকের প্রথমার্ধে সে-দেবীই হয়ে ওঠে গদ্যমুখর, যা বলে সব বলে গদ্যে। তার কণ্ঠে সুর নেই, গান নেই, ছন্দ নেই। ওই সময়টা কর্মীদের কাল। দশকেদশকে জন্ম নিচ্ছিলেন কর্মীরা; আর গদ্য ছিলো তাঁদের কর্মের হাতিয়ার। তখনো বাঙলার স্বাপ্লিকেরা জন্ম নেন নি। ওটা স্বপ্নের সময় ছিলো না। ওই স্বপ্নহীন সময়ের একমাত্র কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত [১৮২২-১৮৫৯]। তাঁর চোখেও স্বপ্ন ছিলো না; ছিলো বাস্তব জগৎ, আর বাস্তবের সংবাদ। তিনি ছিলেন “সম্বাদ প্রভাকর”-এর বিখ্যাত সম্পাদক। তিনি ছিলেন পুরোনো রীতির কবি। যাকে বলে আধুনিকতা, তা তাঁর কবিতায় ফোটে নি, কেবল আধুনিক বাতাস এসে লেগেছিলো তার কবিতার শরীরে ও মনে।
কবি ঈশ্বর গুপ্ত। তিনিই উনিশশতকের প্রথমার্ধের একমাত্র কবি আমাদের। তাঁর কবিতা ছিলো হাল্কা, ব্যঙ্গবিদ্রুপে ভরা। তাঁর কবিতায় কল্পনার স্থানও ছিলো না। ঈশ্বর গুপ্ত ছিলেন আধুনিক কালের মানুষ। কিন্তু তিনি আধুনিকতাকে পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করতে পারেন নি। এ-কবির দৃষ্টিও ছিলো একটু বাঁকা; তিনি সবকিছু দেখতেন বাঁকা চোখে, আর ব্যঙ্গবিদ্রুপে ভরে তুলতেন কবিতা। ঈশ্বর গুপ্তের কবিতার বিষয়ও ছিলো চমৎকার; – তপসে মাছ থেকে শুরু করে ইংরেজদের ককটেল পার্টি সবকিছু ছিলো তাঁর কবিতার বিষয়। বঙ্কিমচন্দ্র তাকে বলেছেন ‘খাঁটি বাঙালি। আধুনিক কালে অবশ্য ‘খাঁটি বাঙালি হওয়া খুব প্রশংসার ব্যাপার নয়। তাঁর কবিতায় আগের কালের কবিওয়ালাদের প্রভাব বেশ গভীর।