বিদ্যাসাগরের মৌলিক রচনা হচ্ছে বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৫), বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার (১৮৫৫), অতি অল্প হইল (১৮৭৩), আবার অতি অল্প হইল (১৮৭৩), ব্রজবিলাস (১৮৮৫), প্রভাবতী সম্ভাষণ (১৮৯২), স্বরচিত জীবনচরিত (১৮৯১)। মৌলিক রচনায় বিদ্যাসাগরকে পাওয়া যায় জীবন্তভাবে; তাঁর নিশ্বাসের প্রবাহ যেনো বোধ করা যায় এগুলোতে। প্রথম পাঁচটি বই তিনি রচনা করেন তাঁর প্রতিপক্ষের লোকদের আক্রমণ করে। বিদ্যাসাগর জড়িত ছিলেন নানা সংস্কার আন্দোলনে। তিনি বিধবাদের বিবাহ আইনসঙ্গত করার চেষ্টা করেছিলেন, এবং রহিত করতে চেয়েছিলেন বহুবিবাহ। তাই তাঁর জুটেছিলো অনেক বিরোধী। এদের সাথে তাঁকে নামতে হয়েছিলো নানা তর্কে; বিদ্যাসাগরের এ-পাঁচটি বই তাই তর্কযুদ্ধ। তাঁর যুক্তিগুলো শাণিত, বিদ্রুপভরা। বিদ্যাসাগরের বিদ্রুপ ছিলো রুচিশীল, তাতে বুদ্ধির ধার ছিলো তীক্ষ। তিনি এগুলো রচনা করেছিলেন ছদ্মনামে। তিনি অতি অল্প হইল এবং আবার অতি অল্প হইল রচনা করেছিলেন কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য’ নামে।
প্রভাবতীসম্ভাষণ এবং স্বরচিত জীবনচরিত তাঁর মৌলিক রচনা। এখানে জীবনের শান্ত গম্ভীর দিকটি প্রকাশিত হয়েছে। প্রভাবতীসম্ভাষণ একটি শোকগাথা। ছোটো রচনা। এরচনায় বিদ্যাসাগরের হৃদয়টি অনাবৃত হয়ে দেখা দিয়েছে। বিদ্যাসাগর সারাজীবন মানুষকে ভালোবেসেছেন, কিন্তু শেষ জীবনে তিনি মানুষের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি জীবনের প্রথম থেকে ছিলেন নাস্তিক; কিন্তু বিশ্বাস করতেন মানুষকে। শেষ জীবনে সেই মানুষের ওপরও তাঁর বিশ্বাস ছিলো না। বাঙলায় মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখা ভীষণ কঠিন! তিনি সঙ্গীহীন হয়ে পড়েছিলেন। তখন তাঁর প্রিয় হয়ে উঠেছিলো রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রভাবতী নামে আড়াই বছরের একটি শিশুকন্যা। বিদ্যাসাগর এ-শিশুকেই করে নিয়েছিলেন নিজের বন্ধু। কিন্তু প্রভাবতীর মৃত্যু হয় শিশুকালেই। বিদ্যাসাগর শোকে ভেঙে পড়েন। প্রভাবতীকে স্মরণ করে তিনি রচনা করেন বাঙলা ভাষার এক অসাধারণ অকাতর রচনা প্রভাবতী সম্ভাষণ। সে-করুণ রচনা থেকে বিদ্যাসাগরের বেদনার একটুখানি তুলে আনি :
বৎসে! তোমায় আর অধিক বিরক্ত করিব না, একমাত্র বাসনা ব্যক্ত করিয়া বিরত হই যদি তুমি পুনরায় নরলোকে আবির্ভূত হও, দোহাই ধর্মের এটি করিও, যাঁহারা তোমার স্নেহপাশে আবদ্ধ হইবেন, যেন তাহাদিগকে, আমাদের মত, অবিরত, দুঃসহ শোকদহনে দগ্ধ হইয়া, যাবজ্জীবন যাতনাভোগ করিতে না হয়।
স্বরচিত জীবনচরিত তাঁর আত্মজীবনী। এটি তিনি শেষ করে যান নি। এটিও অমূল্য গ্রন্থ।
বিদ্যাসাগরের সমকালে এবং একটু পরে যাঁরা উৎকৃষ্ট গদ্য লিখেছিলেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪-১৮৮৩), দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫), অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০-১৮৮৬), রাজেন্দ্রলাল মিত্র (১৮২২-১৮৯১), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮১৮৯৪], এবং আরো অনেকে। এর আরো পরে আসেন আধুনিক কালে রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথ চৌধুরী।
অক্ষয়কুমার দত্ত লিখেছিলেন বেশ কয়েকটি বই। বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর ছিলো গভীর অনুরাগ, ত্যাগ করেছিলেন আস্তিকতা। তিনি ধর্মের নিষ্ফলতা দেখিয়ে লিখেছিলেন একটি বিখ্যাত সমীকরণ। অক্ষয়কুমারের সমীকরণটি হচ্ছে : শ্রম + প্রার্থনা = শস্য, শ্রম = শস্য, সুতরাং প্রার্থনা = ০। শ্রম ছাড়া ধর্মকর্মের ফল শূন্য। সারাদিন ধর্মকর্মেও একটি ধান জন্মানো অসম্ভব। তাঁর গদ্যও ভালো। তাঁর খুব নামকরা বই বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধবিচার। বইটি একটি অনুবাদ বই, এর প্রথমাংশ বের হয় ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে; দ্বিতীয়াংশ বের হয় ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে। অক্ষয়কুমার ছিলেন সে-সময়ের বিখ্যাত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক। তাঁর রচিত পাঠ্যপুস্তকের মাঝে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিলো চারুপাঠ। বইটি তিন খণ্ডে বিভক্ত, বের হয়েছিলো ১৮৫২, ১৮৫৪ এবং ১৮৫৯ সালে। এটি ছিলো সেকালের একটি অবশ্যপাঠ্য পাঠ্যবই। অক্ষয়কুমারের অন্য দুটি বই ধর্মনীতি (১৮৫৬), ভারতবর্ষীয় উপাসকসম্প্রদায় (১৮৭০)। অক্ষয়কুমার বাঙলা গদ্যকে জ্ঞানচর্চার উপযোগী করে তুলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন উৎকৃষ্ট কাব্যময় গদ্যলেখক। তিনি ছিলেন ব্রাহ্মধর্মের প্রতিষ্ঠাতা, তত্ত্ববোধিনী সভা ও তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর বইগুলোর মধ্যে রয়েছে আত্মতত্ত্ববিদ্যা (১৮৫২), ব্রাহ্মসমাজের বক্তৃতা (১৮৬২), স্বরচিত জীবনচরিত (১৮৯৪)। তাঁর জীবনচরিত মহৎ বই।
রাজেন্দ্রলাল মিত্র ছিলেন বিখ্যাত পত্রিকা বিবিধার্থ সহ-এর (১৮৫১) সম্পাদক। তিনি এ-পত্রিকায় জ্ঞানবিজ্ঞানচর্চা ও সাহিত্যসমালোচনার এক গৌরবজনক অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন। তাঁর বইগুলোর মধ্যে আছে প্রাকৃত ভূগোল (১৮৫৪), শিল্পিক দর্শন (১৮৬০), পত্রকৌমুদী (১৮৬৩)। এ-সময়ের দুজন বিখ্যাত গদ্যলেখক রাজনারায়ণ বসু [১৮২৬ -১৮৯৯], ও ভূদেব মুখোপাধ্যায় [১৮২৭-১৮৯৪]। রাজনারায়ণ বসুর বিখ্যাত গ্রন্থ সেকাল আর একাল (১৮৭৪), বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্যবিষয়ক বক্তৃতা (১৮৭৮)। ভূদেব মুখখাপাধ্যায়ের বিখ্যাত গ্রন্থ পারিবারিক প্রবন্ধ (১৮৮২), সামাজিক প্রবন্ধ (১৮৯২)।