যাঁর হাতের ছোঁয়ায় বাঙলা গদ্য রূপময় হয়ে ওঠে, তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর [১৮২০-১৮৯১]। তাকে বলা হয় বাঙলা গদ্যের জনক। বিদ্যাসাগর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালিদের একজন। তিনি বিদ্যাসাগর, দয়ার সাগর, একথা সবাই জানি। এসব কথা যদি স্মৃতিহীন বাঙালি কখনো ভুলেও যায়, তবু তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন তার অনুপম গদ্য রচনার জন্যে। তাঁর গদ্য রচনাকে কেউ ভুলতে পারবে না। আজ আমরা যে-গদ্য রচনা করি, তার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন বিদ্যাসাগর। তাঁর সে-ভিত্তির ওপর কতো রঙবেরঙের প্রাসাদ উঠেছে এবং আরো কতো উঠবে, তবু তিনি থাকবেন সবার মূলে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮২০ অব্দে, মেদেনিপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে। তাঁর পিতার নাম ঠাকুর দাস, মাতার নাম ভগবতী দেবী। বাল্যকালে তিনি দুষ্টু চঞ্চল ছিলেন, ছিলেন বড়ো একরোখা। পরবর্তী জীবনে তিনি হন নির্ভীক, এবং ভীষণভাবে একরোখা। তাঁর সম্বন্ধে গল্প আছে, বাল্যকালে তাঁকে যা বলা হতো তিনি করতেন তার উল্টোটি। যদি মা বলতেন পড়ো, তাহলে তিনি পড়া বন্ধ করতেন। তাই তার মা শীতকালে বালক ঈশ্বরচন্দ্রকে বলতেন কিছুতেই স্নান কোরো না, আর অমনি বালক ঈশ্বর লাফিয়ে পড়তেন জলে। এ-বালক পরে হয়ে উঠেছিলেন বাঙলার মহত্তম ব্যক্তি।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাঙলা গদ্যের অস্থির রূপটিকে স্থির করে দিয়ে গেছেন। তিনি রচনা করেছেন নানা রকমের বই। লিখেছেন পাঠ্যবই, করেছেন অনুবাদ। রচনা করেছেন নিজের জীবনী, শুনিয়েছেন প্রাচীন কাহিনী, লিখেছেন শোকগাথা, বিদ্রুপভরা রচনা। তাঁর সব রচনাই নানা দিক দিয়ে অমূল্য। বিদ্যাসাগরই সবার আগে আবিষ্কার করেন বাঙলা গদ্যের ছন্দ। কবিতার যেমন ছন্দ থাকে, তেমনি থাকে গদ্যেরও ছন্দ। এ-কথাটি আমাদের প্রথম দিকের গদ্যশিল্পীরা বুঝতে পারেন নি, তাই তাঁদের গদ্য প্রাণহীন। গদ্য রচনার ভেতরে গোপনে লুকিয়ে থাকে ছন্দ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এটি বুঝেছিলেন। তিনি সবার আগে নিয়মিতভাবে ঠিক জায়গাটিতে ব্যবহার করেন দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন ইত্যাদি চিহ্নগুলো। তার আগের বাঙলা গদ্যে যতিচিহ্ন ছিলো না, থাকলেও তা যথাস্থানে নিয়মিতভাবে ছিল না। বিদ্যাসাগর এগুলোকে গদ্যের ছন্দ রক্ষার জন্যে নিয়মিতভাবে ব্যবহার করেন। তাই তাঁর গদ্যরচনা পাঠ করার সময় ঘনঘনভাবে কমার ব্যবহার দেখতে পাই। তিনি কমা ব্যবহার করেছেন খুব বেশি, কেননা তিনি অনভ্যস্ত পাঠকদের চোখের সামনে গদ্যের ছন্দ তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। বিদ্যাসাগরের গদ্য সম্বন্ধে খুব ভালো কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি বলেছেন, বিদ্যাসাগর সবার আগে বাঙলা গদ্যকে মুক্তি দেন সংস্কৃত দীর্ঘ সমাসের কবল থেকে, এবং আবিষ্কার করেন বাঙলা শব্দের সঙ্গীত। তিনি বাঙলা গদ্যকে গ্রাম্য পাণ্ডিত্য ও গ্রাম্য বর্বরতা থেকে মুক্ত করে ভদ্রসভার উপযোগী করে তোলেন।
বিদ্যাসাগর গদ্যের ছন্দ আবিষ্কার করেছিলেন বলে তাঁর লেখা পড়ার সময় মধুর সঙ্গীত ধ্বনিত হয়। তাঁর ব্যবহৃত শব্দগুলো ধ্বনিময়, গুঞ্জনময়। এজন্যে পরবর্তী কালে অনেক লেখক অনুসরণ করেছেন বিদ্যাসাগরের গদ্যরীতি। সে-গদ্য সুর ছড়ায়, ছবি আঁকে, কল্পনার জগতে নিয়ে যায়। আবার তিনি যখন হাল্কা বিষয়ে কিছু রচনা করেছেন, তখন তা সরসতায় হয়ে উঠেছে মধুর। বিদ্যাসাগরের সঙ্গীতময় রচনার কিছু অংশ শোনাচ্ছি :
এই সেই জনস্থান মধ্যবর্তী প্রস্রবণগিরি। এই গিরির শিখরদেশ, আকাশপথে সততসঞ্চরমাণ জলধরমণ্ডলীর যোগে, নিরন্তর নিবিড় নীলিমায় অলকৃত, অধিত্যকা প্রদেশ ঘনসন্নিবিষ্ট বিবিধ বনপাদপ সমূহে আচ্ছন্ন থাকাতে, সতত স্নিগ্ধ, শীতল ও রমণীয়; পাদদেশে প্রসন্নলিলা গোদাবরী, তরঙ্গ বিস্তার করিয়া, প্রবল বেগে গমন করিতেছে।
এ-অংশটুকু নেয়া হয়েছে বিদ্যাসাগরের সীতার বনবাস থেকে। উচ্চারণ করে পড়লে সঙ্গীতের মতো শোনাবে।
বিদ্যাসাগরের অধিকাংশ বইই অনুবাদ। কিছু মৌলিক বইও তিনি লিখেছেন। তাঁর প্রথম বই বেতালপঞ্চবিংশতি বের হয়েছিলো ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে। এটি হিন্দি থেকে অনুবাদ। তাঁর দ্বিতীয় বইয়ের নাম বাঙ্গলার ইতিহাস (১৮৪৯)। এটি তিনি রচনা করেছিলেন মার্শম্যানের বই অবলম্বনে। বিদ্যাসাগরের তৃতীয় বইটিও একটি ইংরেজি বই অবলম্বনে লেখা, বইটি হচ্ছে জীবনচরিত (১৮৪৯)। এগুলো ছিলো পাঠ্যবই। তিনি আরো কয়েকটি অনুপম পাঠ্যবই লিখেছেন। তার মধ্যে রয়েছে বর্ণ-পরিচয় (১৮৫৪), কথামালা (১৮৫৬)। বর্ণ-পরিচয় বইটিতে আছে একটি ছন্দময় চরণ; — জল পড়ে। পাতা নড়ে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাল্যকালে এ-চরণটি পাঠ করে অভিভূত হয়েছিলেন। বালক কবির মনে হয়েছিলো তখন যেনো তাঁর সকল চেতনায় জল পড়তে এবং পাতা নড়তে লাগলো। এরকম আরো দুটি বই বোধোদয় (১৮৫১), আখ্যানমঞ্জরী (১৮৬৩-৬৮)। আখ্যানমঞ্জরীতে গল্প বলা হয়েছে সরসভাবে, এর সরসতার তলে লুকিয়ে আছে নীতিকথা।
বিদ্যাসাগর অনুবাদ করেছিলেন বিশ্বসাহিত্যের কয়েকটি অনন্য বই। এসব বই মূল থেকে অনুবাদ করা সহজ কথা নয়। বিদ্যাসাগর অনুবাদ করেছিলেন কালিদাসের বিখ্যাত বই শকুন্তলা (১৮৫৪), বাল্মীকি ও ভবভূতির কাহিনী চয়ন করে লিখেছিলেন সীতার বনবাস (১৮৬০)। তিনি শেক্সপিয়রের কমেডি অফ অ্যাররস বাঙলায় রূপান্তরিত করেছিলেন ভ্রান্তিবিলাস (১৮৬৯) নামে। এই বইগুলোকে শুধু অনুবাদ বললে ঠিক বলা হয় না। তিনি নিজের কালের মতো করে রচনা করেছিলেন এসব কাহিনী। এগুলো বই থেকে জন্ম নেয়া নতুন বই।