বেশ সহজ সরল নরম না কথাগুলো? কেরির আরো একটি বই হচ্ছে ইতিহাসমালা। বইটি বেরিয়েছিলো ১৮১২ অব্দে। এতে আছে কয়েকটি গল্প। সহজ সরলভাবে বলা।
ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পণ্ডিতদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বেশি বই লিখেছিলেন, তিনি মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার [১৭৬২-১৮১৯]। তিনি প্রতি মাসে বেতন পেতেন দুশো টাকা। তিনি লিখেছিলেন পাঁচটি বই, তার মধ্যে চারটি প্রকাশ করেছিলো ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ। তাঁর বইগুলো হচ্ছে বত্রিশ সিংহাসন (১৮০২), হিতোপদেশ (১৮০৮), রাজাবলি (১৮০৮), প্রবোধচন্দ্রিকা (১৮১৩)। তাঁর আরেকটি বই বেদান্তচন্দ্রিকা (১৮১৭)। বাঙলা গদ্যকে সামনের দিকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন বিদ্যালঙ্কার। তাঁর রচনায় একজন ভালো শিল্পীর হাতের ছোঁয়া লক্ষ্য করার মতো। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের আরো যারা লেখক ছিলেন, তাঁরা হচ্ছেন গোলকনাথ শৰ্মা, তারিণীচরণ মিত্র, চণ্ডীচরণ মুনশি, রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়, রামকিশোর তর্কালঙ্কার, হরপ্রসাদ রায়। তারিণীচরণ লিখেছিলেন এশপের কাহিনী (১৮০৩), চণ্ডীচরণ লিখেছিলেন তোতা ইতিহাস (১৮০৫), রাজীবলোচন লিখেছিলেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং (১৮০৫)। রামকিশোর লিখেছেন হিতোপদেশ (১৮০৮) এবং হরপ্রসাদ রায় লিখেছেন পুরুষপরীক্ষা (১৮১৫)। এসকল বই ব্যতীত উইলিয়ম কেরি দু-খণ্ডে সংকলন করেন বাঙলা ভাষার অভিধান। এর প্রথম খণ্ডটি বেরোয় ১৮১৫ অব্দে, এবং দ্বিতীয়টি বেরোয় ১৮২৫-এ। অসাধারণ এ-অভিধান।
ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পাঠ্যপুস্তক লেখকেরা বাঙলা গদ্যের বিকাশে পালন করেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তবে তাঁদের গদ্য পরিপূর্ণ বিকশিত নয়; পাঠ্যপুস্তকও পুরোপুরি পাঠ্যপুস্তক নয়। তাঁদের লেখা পড়ে বুঝতে কষ্ট হয়। এমন অনেক শব্দ আছে যা আজ আর কেউ ব্যবহার করে না। তাছাড়া এ-গদ্যে দাঁড়ি নেই, কমা নেই, সেমিকোলন নেই; নেই আরো অনেক কিছু। পণ্ডিতেরা ছিলেন সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত, তাই তাঁরা অনেক জায়গায় ব্যবহার করেছেন কঠিন কঠিন সংস্কৃত শব্দ। তবে এ-গদ্যের আলোতেই পথ দেখেছেন পরবর্তী গদ্যলেখকেরা। এরপরে এসেছেন অনেক বড়ো বড়ো গদ্যশিল্পী। যেমন, রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তারা বাঙলা গদ্যকে ভেঙেছেন, নতুন করে গড়েছেন।
ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পর বাঙলা গদ্য লাভ করেছে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার লালনপালন। পত্রপত্রিকা গদ্যের প্রবাহকে অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করে। উনিশশতকের দ্বিতীয় দশকে প্রকাশিত হয়েছিলো সাময়িকপত্র, বাঙলা গদ্য এসকল পত্রপত্রিকা আশ্রয় করে বেড়ে ওঠে। পত্রপত্রিকাগুলোতে থাকতো নানা জ্ঞানের কথা, নানা রসের কথা, থাকতো নানা বাদপ্রতিবাদ। এর ফলে গদ্যের সীমাও যায় বেড়ে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে গদ্যের পরিধি ছিলো সীমিত, কেননা সেখানে রচিত হয়েছে শুধু পাঠ্যবই। জীবনের সকল দিকের প্রতি তাদের লক্ষ্য ছিলো না। পত্রপত্রিকার লক্ষ্য জীবনের সবদিকে। তাই গদ্য বিস্তার লাভ করে।
বাঙলা ভাষায় প্রথম পত্রিকা প্রকাশ করেন শ্রীরামপুরের মিশনারিরা। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে। পত্রিকাটির নাম দিকদর্শন। এ-পত্রিকায় বাঙলা গদ্য বেশ সহজ সরলভাবে ব্যবহৃত হয়। শ্রীরামপুর মিশন থেকে ১৮১৮-তে বেরোয় আরো একটি পত্রিকা। নাম সমাচার দর্পণ। এটি ছিলো সাপ্তাহিক পত্র। এর সম্পাদক ছিলেন জে সি মার্শম্যান। এপত্রিকায় চাকুরি করতেন পণ্ডিত জয়গোপাল তর্কালঙ্কার, পণ্ডিত তারিণীচরণ শিরোমণি।।
বাঙালিদের প্রচেষ্টায় যে-পত্রিকাটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো তার নাম বাঙ্গালা গেজেটি। এটি ছিলো সাপ্তাহিক পত্রিকা; প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো ১৮১৮ সালের মে মাসের ১৪ তারিখে। পত্রিকাটি বেশিদিন বাঁচে নি। সব পত্রিকার মধ্যে সমাচার দর্পণ-এর অবদান উল্লেখযোগ্য। এ-পত্রিকাটিতে সাহিত্য-ভাষা-রাজনীতি-ইতিহাস নানাবিধ বিষয় ঠাঁই পেতো। এ-পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছিলো উনিশশতকের প্রথম দিকের বিখ্যাত নকশা “বাবু উপাখ্যান”।
১৮২১ খ্রিস্টাব্দে রামমোহন রায় শিবপ্রসাদ রায় ছদ্মনামে প্রকাশ করেন ব্রাহ্মণ-সেবধি নামে একটি মাসিক পত্রিকা। রামমোহন ভালো গদ্যলেখক ছিলেন; এ-পত্রিকাটিতে তাই মোটামুটি ভালো গদ্য স্থান পেতো। ১৮২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আরো একটি পত্রিকা। নাম সম্বাদকৌমুদী। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। পত্রিকাটি বের হতে প্রতি মঙ্গলবারে। ভবানীচরণ ছিলেন একজন ভালো লেখক। তিনি লিখেছিলেন একটি নামকরা বই—কলিকাতা কমলালয়। পরে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বের করেছিলেন আরেকটি পত্রিকা, সমাচারচন্দ্রিকা নামে। এ-পত্রিকার প্রধান কাজ ছিলো সতীদাহপ্রথা নিবারণের বিরুদ্ধে লেখা। ভবানীচরণ রক্ষণশীল ছিলেন; তিনি বিরোধিতা করেছিলেন সেকালের অনেক প্রগতিশীল আন্দোলনের। তবে তিনি রচনা করেছিলেন কয়েকটি বই। সেগুলো হচ্ছে কলিকাতা কমলালয়, নববাবুবিলাস, নববিবিবিলাস।
কিন্তু সব পত্রপত্রিকাকে ছাপিয়ে উঠেছিলো একটি পত্রিকা, সেটির নাম সম্বাদপ্রভাকর। এটির সম্পাদক ছিলেন কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। পত্রিকাটি সাপ্তাহিকরূপে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে ১৮৩১ সালের ২৮ জানুয়ারিতে। ১৮৩৯ সালে এটি পরিণত হয় দৈনিক পত্রিকায়। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ছিলেন নামকরা কবি, তাঁর গদ্যও বেশ ভালো। তিনি উনিশশতকের অন্তত দুজন মহৎ লেখককে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। একজন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অপরজন নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র। এ-পত্রিকায় ঈশ্বরচন্দ্র বাঙলার সাহিত্যসংস্কৃতিকে বিকশিত করতে চেয়েছিলেন। তাই এতে নিয়মিত প্রকাশিত হতো গদ্য-পদ্য এবং বিভিন্ন শ্রেণীর রচনা। ঈশ্বরগুপ্ত প্রভাকর-এর পাতাতেই প্রকাশ করেন প্রাচীন কবিদের জীবনী, প্রকাশ করেন কবি ভারতচন্দ্রের জীবনী ও সাহিত্যের পরিচয়। এভাবে জীবনের সকল দিক উন্মােচিত হওয়ার সাথে বিকশিত হয়েছিলো বাঙলা গদ্য। ১৮৮১ সালে বের হয় জ্ঞানান্বেষণ নামে একটি পত্রিকা। এ-সকল পত্রপত্রিকা আশ্রয় করে বাঙলা গদ্য অনেকখানি সবলতা লাভ করে। সবলতা আসে সবদিকে। ভাষা ব্যবহারোপযোগী হয়ে ওঠে জীবনের সর্বক্ষেত্রে। গদ্যের প্রয়োজন তো সর্বত্র। তাই তার রূপও হওয়া দরকার বিচিত্র। গদ্য যখন ব্যবহৃত হয় প্রবন্ধে তখন তার রূপ এক, যখন গদ্য ব্যবহৃত হয় উপন্যাসে তখন তার রূপ আরেক। যখন গদ্য হালকা রচনায় ব্যবহৃত হয় তখন তা থাকে এক রকম, যখন তা ব্যবহৃত হয় গুরু রচনায়, তখন তা হয় অন্যরকম। সাময়িকপত্রের পৃষ্ঠায় গদ্যে আসে এ-বৈচিত্র্য। তবে বাঙলা গদ্যকে সাবলীল করে তোলেন মহৎ গদ্যশিল্পীরা।
গদ্যের জনক ও প্রধান পুরুষেরা
বিভিন্ন লেখকের হাতের স্পর্শে বাঙলা গদ্য ধীরেধীরে ধারণ করেছিলো নিজের প্রকৃত রূপ। কেউ রচনা করেছিলেন পাঠ্যবই লেখার উপযোগী গদ্য, কেউ গদ্যকে করে তুলেছিলেন যুক্তিতর্কের উপযোগী। কারো হাতে গদ্য হয়ে উঠেছিলো গল্পের উপযোগী, কারো হাতে হয়ে উঠেছিলো সমালোচনা সাহিত্যের উপযোগী। কিন্তু উনিশশতকের প্রথম দু-তিন দশক ধরে চলে গদ্যের বিকাশ ও সুস্থিতির কাজ। এমন কোনো বড়ো গদ্যশিল্পী তখন দেখা দেন নি, যাঁর গদ্যকে বলা যেতে পারে নিটোল গদ্য। উনিশশতকের দ্বিতীয় দশকে আবির্ভূত হন রামমোহন রায় [১৭৭২-১৮৩৩]। তিনি ছিলেন কৃতী পুরুষ, নতুন কালের মহাপুরুষ। বাঙলা গদ্যে তাঁর দানও উল্লেখযোগ্য। রামমোহন সবার আগে গদ্যকে পাঠ্যবইয়ের বৃত্ত থেকে বিস্তৃততর এলাকায় নিয়ে যান। রামমোহন ছিলেন সংস্কারক। তাই তাঁকে তর্কবিতর্কে নামতে হয়েছে তাঁর প্রতিপক্ষের সাথে। তিনি বিরোধীপক্ষকে আঘাত করেছেন নানা রচনায়, আর এ-আঘাতে দল মেলেছে গদ্য। রামমোহন রচনা করেছিলেন বেশ কয়েকটি বাঙলা বই। সেগুলো হচ্ছে বেদান্ত গ্রন্থ (১৮১৫), বেদান্তসার (১৮১৫), ভট্টাচার্যের সহিত বিচার (১৮১৭), গোস্বামীর সহিত বিচার (১৮১৮), প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ (১৮১৮), পথ্যপ্রদান (১৮২৩), গৌড়ীয় ব্যাকরণ (১৮৩৩)। এছাড়া তিনি সম্পাদনা করেছিলেন দুটি পত্রিকা, ব্রাহ্মণসেবধি ও সম্বাদকৌমুদী। এসকল রচনা ভিত্তি করে গড়ে ওঠে ব্যক্তিত্বমণ্ডিত গদ্য। রামমোহনের গদ্য পাঠের সময় এক প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের লেখা পাঠ করছি, একথা সব সময় মনে হয়। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তাঁর গদ্য সম্বন্ধে লিখেছিলেন যে তিনি জলের মতো সহজ গদ্য লেখেন। তবে তাঁর গদ্য বিশেষ সরস নয়। আসলে রামমোহনের গদ্য ঠিক জলের মতো ছিলো না, এ-গদ্য অনেকটা জটিল, বাক্যগুলো বড়ো বড়ো, এলানোছড়ানো। অনেক সময় তাঁর ভাষা কর্কশ। দাঁড়ি-কমা-সেমিকোলনেরও অভাব আছে। তবু রামমোহন রায় বাঙলা গদ্যের এক প্রধান ব্যক্তি।