মধ্যযুগের কিছু দলিলে বাঙলা গদ্যের আদিরূপ পাওয়া গেছে, এবং পাওয়া গেছে কিছুকিছু চিঠিতে। এরকম একটি চিঠি হচ্ছে কুচবিহারের মহারাজা নরনারায়ণের। তিনি এ-মূল্যবান চিঠিটি ১৫৫৫ অব্দে লিখেছিলেন অহোমরাজ স্বৰ্গদেবকে। এ-চিঠি পড়লে মনে হয় যেনো যে-শিশু সদ্য কথা বলতে শিখছে, সে কারো কাছে চিঠি লিখেছে। একটি দলিল পাওয়া গেছে ১৬৯৬ সালে লেখা। এছাড়া আরো কিছু চিঠি এবং সাহিত্য নয়, এরকম গদ্য রচনা পাওয়া গেছে মধ্যযুগের। এসব রচনা দেখলে শুধু দুঃখ বাড়ে, কেননা পড়ে বুঝতে হলে ভীষণ কষ্ট করতে হয়।
বাঙলা গদ্যের বিকাশে বিদেশিদের অবদান অসামান্য। এটা স্বীকার করা ভালো। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের কথা বলার সময় তা বোঝা যাবে। তবে আঠারোশতকেই বিদেশিরা মন দিয়ে বাঙলা গদ্য লেখা শুরু করেছিলেন। এ-বিদেশিরা ছিলেন পর্তুগিজ। ১৭৪৩ সালে পর্তুগালের লিসবন থেকে তিনটি বাঙলা গদ্যে লেখা বই মুদ্রিত হয়। বই তিনটির দুটি রচনা করেছিলেন একজন পর্তুগিজ। বইগুলো যদিও লেখা বাঙলা ভাষায়, কিন্তু এগুলো ছাপা হয়েছিলো রোমান অক্ষরে। আর ছাপাও হয়েছিলো বাংলাদেশ থেকে বহুদূরে অবস্থিত লিসবনে। বই তিনটির একটির লেখক দোম আনতোনিও। তিনি ছিলেন ঢাকা জেলার ভূষণা অঞ্চলের জমিদারের পুত্র। তাঁর বইয়ের নাম ব্রাহ্মণ-রোমান ক্যাথলিকসংবাদ। অপর বই দুটির লেখক পাদ্রি মনোল দা আসসুম্পসাঁউ। পাদ্রি মনোএল-এর একটি বইয়ের নাম কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ, এবং অপর বইটির নাম বাঙলা-পর্তুগিজ অভিধান। কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ বইটি রচিত হয়েছিলো ১৭৩৪ খ্রিস্টাব্দে, ভাওয়াল পরগণায়। তার অভিধানটিও রচিত হয়েছিলো ভাওয়ালেই।
এসব সত্ত্বেও বাঙলা গদ্য উনিশশতকেরই উপহার। এ-উপহার দানের গৌরব সবার আগে দাবি করতে পারে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ। এ-কলেজে গড়ে ওঠে গদ্য। তাই বাঙলা গদ্যের ইতিহাসে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ একটি বড়ো অধ্যায়। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের মে মাসের ৪ তারিখে। ইংরেজরা এক বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে স্থাপন করে এ-কলেজ। ইংরেজরা তখন দেশের রাজা। বিলেত থেকে এদেশে আসতো তরুণ ইংরেজ রাজকর্মচারীরা। যোগ্যতার সাথে শাসনের জন্যে তাদের পরিচয় থাকার দরকার ছিলো এ-দেশের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির সাথে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ওপর ভার পড়ে রাজকর্মচারীদের এ-দেশের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষিত করে তোলার। তাদের শিক্ষা কেন্দ্র করে এ-কলেজে বিকশিত হয় বাঙলা গদ্য।
১৮০১ অব্দে উইলিয়ম কেরি ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে যোগ দেন বাঙলা ও সংস্কৃত ভাষার অধ্যাপকরূপে। তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে যোগ দিয়ে মনোযোগ দেন গদ্যের বিকাশে। তাঁর সহায়ক হন কয়েকজন পণ্ডিত। এ-পণ্ডিতদের মধ্যে আছেন রামরাম বসু, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, এবং আরো কয়েকজন। পণ্ডিতেরা কেরির পরিচালনায় বিকাশ ঘটাতে থাকেন গদ্যের। কেরি নিজেও বসে ছিলেন না, তিনিও গদ্যের সাধনায় নামেন। এর ফলে শুরু হয় বাঙলা সাহিত্যের নবযুগ। এখানে অবশ্য সাহিত্য সৃষ্টির প্রচেষ্টা হয় নি, সিভিলিয়ানরা যাতে সহজে এ-দেশের নানা কিছুর সাথে পরিচিত হতে পারে, বই রচনার সময় তা লক্ষ্য রাখা হয়। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে তাই রচিত হয় পাঠ্যপুস্তক। পাঠ্যপুস্তককে নির্ভর করেই বেড়ে ওঠে গদ্য। এখান থেকে যে-সব বই প্রকাশিত হতো, সেগুলোর দাম ছিলো কিন্তু বেশ। তাই সবাই সে-বই কিনতে পারতো না। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পণ্ডিতেরা বাঙলা গদ্যকে পূর্ণ বিকশিত করতে পারেন নি, তাঁরা শুধু ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। ১৮০১ থেকে ১৮২৬-এর মধ্যে এ-কলেজ থেকে বেরোয় অনেকগুলো বাঙলা বই।
বাঙলা অক্ষরে মুদ্রিত বাঙালির লেখা যে-বইটি সর্বপ্রথম ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের ছাপাখানা থেকে বেরোয়, সেটির নাম প্রতাপাদিত্যচরিত্র। বইটি প্রকাশিত হয়েছিলো ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে। বইটি লিখেছিলেন রামরাম বসু। তিনি ভাগ্যবান ব্যক্তি। তাঁর বই সবার আগে ছাপা হয়েছিলো, এজন্যেই তো আমরা তাঁকে চিরকাল মনে রাখবো। গদ্যলেখক হিশেবেও তিনি একেবারে ফেলনা নন। তিনি লিখেছিলেন আরো একটি বই। বইটির নাম লিপিমালা। এটি বেরিয়েছিলো ১৮০২ অব্দে। রামরাম বসুর জীবন খুব রোমাঞ্চকর। তিনি কেরিকে বাঙলা শিখিয়েছিলেন। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের যিনি ছিলেন পরিচালক, সেই উইলিয়ম কেরিও লিখেছিলেন কয়েকটি বই। সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কথোপকথন। এটি ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের দ্বিতীয় বই; প্রকাশিত হয়েছিলো ১৮০১-এ। এ-বইটি কলকাতা ও শ্রীরামপুর এলাকার বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের বিভিন্ন বিষয়ে কথোপকথন। মানুষেরা নানা বিষয়ে কথা বলেছে এ-বইতে। তাই এ-বইটিতে সেকালের মানুষের মুখের ভাষার পরিচয় লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। কেরি এ-দেশের মানুষ ছিলেন না, কিন্তু তার এ-বই পড়লে বোঝা যায় তিনি এদেশবাসীকে কেমন তীক্ষ চোখে দেখেছিলেন। এখানে নানা শ্রেণীর মানুষ কথা বলেছে; কথা বলেছে মেয়েরা, বুড়োরা, উঁচুশ্রেণীরা, নিচুশ্রেণীরা। কেরি যেনো তাঁর বইতে নিজে কিছু না লিখে সত্যিকার মানুষের কথাবার্তা অবিকল তুলে দিয়েছেন। কেরির কথোপকথন -এ সেকালের মেয়েরা কথা বলে এভাবে :
তোমার কয় যা।
আমি সকলের বড় আমার আর তিন যা আছে।
কেমন যায় যায় ভাব আছে কি কালের মতো।
আহা ঠাকুরাণী আমার যে জ্বালা আমি সকলের বড় আমাকে তাহারা অমুক বুদ্ধি করে না।