রাম বসু বলছেন :
বল হে অ্যান্টনি আমি একটি কথা জানতে চাই।
এসে এদেশে এবেশে তোমার গায়ে কেননা কুর্তি নাই।
অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি বলছেন :
এই বাঙলায় বাঙালির বেশে আনন্দে আছি।
হয়ে ঠাকরে সিংহের বাপের জামাই কুর্তি টুপি ছেড়েছি।
বেশ মজার নয়?
টপ্পার রাজা ছিলেন নিধুবাবু [১৭৪১-১৮৩০]। তাঁর পুরোনাম রামনিধি গুপ্ত। তাঁর পিতার নাম ছিলো হরিনারায়ণ গুপ্ত। তাঁর টপ্পায় মুগ্ধ হতে শ্রোতারা। তার একটি অমর গান আছে। গানটির কয়েকটি পংক্তি :
নানান দেশের নানান ভাষা,
বিনে স্বদেশী ভাষা,
পূরে কি আশা?
কতো নদী সরোবর কিবা ফল চাতকীর
ধারা জল বিনে কভু
মিটে কি তৃষা?
এ-সময়ে মুসলমান সমাজে দেখা দিয়েছিলেন শায়েররা। তাঁরা মনোরঞ্জন করতেন গঞ্জের ব্যবসায়ীদের; শোনাতেন নানা রকমের ইসলামি কাহিনী। তাঁরা যে-গান বেঁধেছিলেন, তাকে আজকাল বলা হয় ‘পুথিসাহিত্য’। অনেকে তাঁদের রচনাকে বলেন ‘মিশ্রভাষারীতির কাব্য’। তাঁদের কবিতা আধুনিক কালে কলকাতার শস্তা ছাপাখানা থেকে ছাপা হয়েছিলো বলে এ-বইগুলোকে বটতলার পুথি’ও বলা হয়। এতে সব নাম, এবং নামগুলো দেখে বোঝা যায়, এ-শ্রেণীর কাব্যকেও বিশেষ সম্মানের চোখে দেখা হয় না। এগুলো সত্যিই উন্নতমানের সাহিত্য নয়; এখানে মানুষের শস্তা আনন্দ দেয়ার চেষ্টা আছে। এ-কবিরা অনেক বড়ো বড়ো কাহিনী শুনিয়েছেন শ্রোতাদের। সে-সব কাহিনী যেমন আজগুবি, তেমনি মোটা রসের। আসলে এগুলো বুড়োদের জন্যে পরীর গল্প। এ-কবিরা শুনিয়েছেন ইউসুফ-জুলেখার কাহিনী, লাইলি-মজনু, হাতেমতায়ীর কেচ্ছা, লিখেছেন জঙ্গনামা, আমিরহামজার কথা। এ-সব রচনায় সবচেয়ে লক্ষণীয় হচ্ছে কবিদের ভাষা। ভাষার ক্ষেত্রে এ-কবিরা হৈচৈ ব্যাপার ঘটিয়েছিলেন। তাঁরা কাব্য লিখেছিলেন বাঙলা ভাষায়, কিন্তু তাঁদের হাতে বাঙলা ভাষার প্রাণান্তকর অবস্থা হয়েছিলো। তারা পংক্তিকে জমজমাট করে তুলতেন আরবিফারসি শব্দে, মাঝেমাঝে ইংরেজি শব্দেও। বাঙলা শব্দ ব্যবহৃত হতো ততোটুকু, যতোটুকু না হলেই নয়। এ-কবিতাগুলো যখন ছাপা হয় প্রথমে, তখন সেগুলো ছাপা হয়েছিলো আরবিফারসির মতো ডান দিক থেকে। সব দিকেই একবিরা এক কোলাহল পাতিয়ে তুলেছিলেন। তাদের ভাষার নমুনা :
কেচ্ছার পহেলা আধা শুনিয়া আলম।
আখেরি কেচ্ছার তরে করে বড়া গম।।
কিছু বোঝা গেলো? এখানে এগারোটি শব্দ আছে, তার মাত্র চারটি বাঙলা। তবু একাব্য বাঙলা! এ-কবিরা অনেক সময় তালজ্ঞান, কাণ্ডজ্ঞান সবই হারিয়ে ফেলতেন। এক কবি লিখেছেন :
ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল।
কিছু দূর যাইয়া মর্দ রওনা হইল।।
মর্দ ঘোড়ার পিঠে চড়ে হেঁটে যায়, আর কিছুদূর যাওয়ার পর রওনা হয়। অদ্ভুত জগতের অধিবাসী কবি আর তাঁর কাব্যের মর্দ!
শায়েররা যে-সব কাহিনী লিখেছিলেন, সেগুলোকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। একদিকে তারা লিখেছেন মানুষমানুষীর মন দেয়ানেয়ার গল্প, অন্যদিকে তারা লিখেছেন ইতিহাস আর কল্পনা মিশিয়ে পরধর্মীকে পরাজিত করার কাহিনী। তাঁদের অনেক কাহিনীতে দেখা যায় হিন্দুদের দেবদেবীর সাথে মুসলমান পীরফকিরদের সংঘর্ষের চিত্র। সব মিলে এক রোমাঞ্চকর আজব বিশ্ব সৃষ্টি করেছিলেন এ-কবিবৃন্দ। তাঁদের কল্পনা ছিলো শিশুসুলভ, তা ডানা মেলতো সকল অসম্ভবের মধ্যে। সব গল্পে কথায় কথায় আসে দৈত্য-দানবপরীরা, নায়ক বা নায়িকা চল্লিশ মণ পানি খেয়ে ফেলে একবারে।
এ-শ্রেণীর সাহিত্য রচনা করে যারা খ্যাতি লাভ করেছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন গরীবুল্লাহ, সৈয়দ হামজা, মোহাম্মদ দানেশ। তাঁদের মধ্যে প্রথম দুজনই এ-সাহিত্যের শ্রেষ্ঠপুরুষ। ফকির গরীবুল্লাহ ছিলেন হুগলি জেলার হাফিজপুর গ্রামের বাসিন্দা। তিনি বেশ কয়েকটি কাব্য লিখেছিলেন। তাঁর কাব্যগুলো হচ্ছে ইউসুফজুলেখা, আমির হামজা (প্রথম পর্ব), জঙ্গনামা, সোনাভান, সত্যপীরের পুথি। কবি সৈয়দ হামজা ১৭৩৩ সালে হুগলি জেলার উদনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর কাব্য আছে বেশ কয়েকটি। যেমন মধুমালতী, আমির হামজা (দ্বিতীয় পর্ব), জৈগুণের পুথি, হাতেমতাই। আরেক কবি, যার নাম জয়নাল আবেদিন, রচনা করেছিলেন আবু সামা নামে একটি কাব্য। মোহাম্মদ দানেশ রচনা করেছিলেন গুলবে-সানোয়ারা, নুরুল ইমান, চাহার দরবেশ, হাতেমতাই নামে কয়েকটি কাব্য।
কবিওয়ালা ও শায়েররা মধ্যযুগের শেষপ্রান্তে উদ্ভূত হয়েছিলেন। তাঁরা কোনো অসাধারণ সৃষ্টি রেখে যেতে পারেন নি পরবর্তীকালের জন্যে। এর জন্যে তাঁদের কোনো দোষ নেই। দোষ যদি কিছু থাকে, তবে তা দেশের ও কালের। দেশ গিয়েছিলো নষ্ট হয়ে, কাল গিয়েছিলো পতিত হয়ে। নষ্ট কালে অন্ধকারাচ্ছন্ন দেশে তাঁরা প্রদীপ জ্বালাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে-প্রদীপ জ্বলতে চায় নি উজ্জ্বলভাবে। তাই এ-সময়ে আঁধার ছড়িয়ে পড়েছে সাহিত্যের আঙিনায়। তবু তো কিছুটা আলো ছিলো; আলো জ্বেলেছিলেন একবিরা, তাই তাঁরা স্মরণীয়।।
অভিনব আলোর ঝলক
আসে উনিশশতক। বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের দিকেদিকে সাড়া পড়ে যায়। উনিশশতকে সূচনা হয় বাঙলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের। এ-আধুনিকতা, যাকে বলেছি অভিনব আলো, তার কিরণ পড়ে সাহিত্যের সমগ্র ভুবনে। মধ্যযুগে বাঙলা সাহিত্য ছিলো সংকীর্ণ; সবগুলো শাখা বিকশিত হয় নি তাতে। উনিশশতকে বিকশিত হয় তার সব শাখা, বাঙলা সাহিত্য হয়ে ওঠে সম্পূর্ণ সাহিত্য। আধুনিকতা কাকে বলে? মানুষ যখন যুক্তিতে আস্থা আনে, যখন সে আবেগকে নিয়ন্ত্রিত করে, যখন সে মানুষকে মানুষ বলে মূল্য দেয়, তখন সে হয়ে ওঠে আধুনিক। আধুনিকতার আছে আরো অনেক বৈশিষ্ট্য। মধ্যযুগেও আমরা দেখেছি মাঝেমাঝে এসব বৈশিষ্ট্য, কিন্তু তা জীবনের সকল প্রান্তকে ছোয় নি। উনিশশতকে এবৈশিষ্ট্যগুলো দেখা দেয় প্রধান হয়ে। সাহিত্যের রূপও যায় বদলে। উনিশশতকের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা বাঙলা গদ্যের বিকাশ। প্রাচীন যুগে, মধ্যযুগে বাঙলা সাহিত্যে গদ্যের বিশেষ স্থান ছিলো না। তখন যা কিছু রচিত হয়েছে সবই হয়েছে পদ্যে, ছন্দ মিলিয়ে। কিন্তু পদ্যে কি সব কথা বলা যায়?