বাঙলা সাহিত্যে যে-কটি বিখ্যাত গীতিকা আছে, তাদের সবগুলোই প্রায় সগ্রহ করা হয়েছিলো ময়মনসিংহ জেলা থেকে। বাঙলার গীতিকাগুলোর সৌন্দর্য অশেষ। মধ্যযুগের কাহিনীকাব্যগুলোর মধ্যে এগুলোই শ্রেষ্ঠ : মঙ্গলকাব্য এগুলোর পাশে খুবই ম্লান।
দ্বিতীয় অন্ধকার
বাঙলা সাহিত্যের শুরুতে আছে একটি আঁধার যুগ। তখন দেড়শো বছর কেটেছে অন্ধকারে। সে-সময়ের কোনো লেখা আসে নি আমাদের হাতে। আবার মধ্যযুগ যখন শেষ হয়, তখন নামে সামান্য অন্ধকার। অবশ্য এমন নয় যে এ-সময় কিছু লেখা হয় নি। লেখা হয়েছে, অনেক লেখা হয়েছে। তার প্রায় সবটাই এসেছে আমাদের কাছে। কিন্তু তবু এসময়ে আমাদের সাহিত্যের আঙিনায় আলোর অভাব পড়েছিলো; নেমেছিলো অন্ধকার। মধ্যযুগে বাঙলা সাহিত্যে অনেক মূল্যবান সৃষ্টি হয়েছে। মধ্যযুগ একসময় শেষ হয়ে আসে। দেশে দেখা দেয় নানা বিপর্যয়। সুজলা সুফলা বাঙলায় দেখা দেয় হাহাকার। রাজনীতির ক্ষেত্রে দেখা দেয় পরিবর্তন। ১৭৫৭ অব্দে আমরা হারাই স্বাধীনতা। ইংরেজরা বাণিজ্য করতে এসে দখল করে নেয় আমাদের দেশ। বণিক হয় শাসক। রাজা বদল হয়। শুধু যে রাজাই বদলায় তা নয়, বদলে যায় অনেক কিছু। অর্থাৎ সমাজের যে-ভিত্তি এতোদিন অকম্পিত ছিলো, তা ওঠে ভয়ংকরভাবে নড়ে। সমাজে সৃষ্টি হয় নতুন ধনিক শ্রেণী। আগে যারা ছিলো সমাজের মাথা, তারা পিছিয়ে পড়ে, এগিয়ে যায় যারা ছিলো পেছনে। সাহিত্যেরও পরিবর্তন ঘটে। সাহিত্য সমাজের প্রতিচ্ছবি। আয়নায় যেমন আমরা দেখি নিজেদের, তেমনি সাহিত্যে দেখা যায় দেশকালের ছবি। আগে সাহিত্য রচিত হতো সমাজের বড়ো বড়ো মানুষের উৎসাহে; তারা চাইতো উৎকৃষ্ট সাহিত্য। কিন্তু ১৭৬০-এর পরে সাহিত্যের সে-মর্যাদা আর রইলো না। কেননা আগে যারা সাহিত্যের উৎসাহদাতা ছিলো, তারা হারিয়ে ফেলে তাদের আগের মর্যাদা। সমাজে দেখা দেয় নতুন ধনী শ্রেণী। এরা সাধারণত বিভিন্ন বাণিজ্যকেন্দ্রে ব্যবসা করতো। ব্যবসা করে তারা জমিয়ে তোলে অনেক টাকা। তাদের অনেক টাকা ছিলো, কিন্তু ছিলো না রুচি। কিন্তু তারাও চায় আনন্দ, চায় উৎসব। সাহিত্য আনন্দ দানের একটি বড়ড়া উপায়। তাই এ-নতুন ধনীরা চায় সাহিত্য। কিন্তু উন্নত সাহিত্যের স্বাদ তারা গ্রহণ করতে পারে নি। তাদের জন্যে দরকার হয় হাল্কা, নিম্নরুচির সাহিত্য। এ-সাহিত্য সরবরাহ করেন একশ্রেণীর কবি। তাঁদের বলা হয় কবিওয়ালা’। তাঁদের মধ্যে যারা ছিলেন মুসলমান, তাঁদের শায়েরও বলা হয়। তাঁরা কবি নন, কবিঅলা।
সতেরো শশা ষাট থেকে আঠারো শো তিরিশ। সত্তর বছর সময়। এ-সময় আমাদের সাহিত্যের পতন ঘটেছিলো। ১৭৬০-এ মারা যান মধ্যযুগের শেষ বড়ো কবি ভারতচন্দ্র রায়। ভারতচন্দ্র উৎকৃষ্ট সাহিত্য সৃষ্টি করেছিলেন, কিন্তু তাঁর রচনায়ও রয়েছে পতনের পরিচয়। রুচির অভাব রয়েছে ভারতচন্দ্রে। ভারতচন্দ্রের পরে কবিওয়ালা এবং শায়েররা সে-পতনকে পূর্ণ করেন। তাই এ-সময়ের বাংলা সাহিত্য নিয়ে গর্ব করা যায় না। এ সময়টাকে দেখা হয় একটু করুণার সাথে। এ-সময়ে যারা কবিতা রচনা করেন তাঁদের কবিও বলা হয় না, বলা হয় কবিওয়ালা বা কবিয়াল। কেননা, তাঁরা কবিদের সম্মান রক্ষা করেন নি। কবিরা হন আত্মসম্মানী, অর্থের কাছে তাঁরা বিকিয়ে যান না। কিন্তু এ-সময়ের কবিরা অনেকটা বিকিয়ে গিয়েছিলেন, নিজেদের রুচিকে করেছিলেন খাটো। তাঁরা কবিতা লিখতেন না, রচনা করতেন মুখেমুখে, মঞ্চে দাঁড়িয়ে। কবিওয়ালারা করতেন কবিতাযুদ্ধ। একটি মঞ্চে উঠে দাঁড়াতেন দু-দল কবি। তাঁদের একদল প্রথমে অপর দলের উদ্দেশে পদ্যে কিছু বলতেন। তাঁদের বলা যখন শেষ হত তখন অন্য দলের কবিরা আগের দলের কথার জবাব দিতেন। প্রথম দলের কথাকে বলা হয় চাপান’ এবং দ্বিতীয় দলের কথাকে বলা হয় ‘উতোর। কবিদের কথা কাটাকাটি বেশ জমে উঠতো। মঞ্চে দাঁড়িয়ে অনবরত পদ্য রচনা করতেন তাঁরা। তাঁদের কথায় রুচির বিশেষ ছোঁয়া থাকতো না। রুচিতে বা কবিতায় তাঁদের বিশেষ লোভ ছিলো না, তাদের লক্ষ্য ছিলো যেমন করে তোক বিপক্ষকে হারানো। আজো বাঙলার গ্রামে এ-কবিগান শুনতে পাওয়া যায়।
কবিগান ছিলো অনেক রকমের। যেমন : তর্জা, পাঁচালি, খেউড়, আখড়াই, হাফআখড়াই, দাঁড়া-কবিগান, বসা-কবিগান, ঢপ, টপ্পা, কীর্তন ইত্যাদি। এ-কবিদের একটি গুণ কিন্তু স্বীকার করতেই হয়। তা হচ্ছে তাঁদের পটুত্ব; অবলীলায় তাঁরা রচনা করতেন এক-একটি পংক্তি। হয়তো ছন্দে ভুল থাকতো মাঝেমাঝে, শব্দও ব্যবহৃত হতো বেঢপ রকমের, তবু তাতে কী? তারা তো আনন্দ দিতেন। তাঁদের ব্যবহৃত শব্দগুলোও হতো শ্রোতাদের পুলকিত করার মতো। বাঙলা, ফারসি, ইংরেজি অনেকরকম শব্দ তারা ব্যবহার করতেন। অষ্টাদশ শতকের শেষভাগ ওই কবিগানের স্বর্ণযুগ। তবে আজো কবিগান মরে যায় নি, গ্রামাঞ্চলে তা বেঁচে আছে।
কবিগানরচয়িতাদের জীবনী সংগ্রহ করেছিলেন কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত [১৮১২-১৮৫৯]। তিনি উনিশশতকের প্রথম ভাগের একমাত্র কবি। তিনি নিজে একসময় ছিলেন। কবিওয়ালাদের দলে। ঈশ্বর গুপ্তের কবিতায় কবিওয়ালাদের রচনার অনেক স্বাদ পাওয়া যায়। কবিওয়ালাদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে প্রাচীন, তাঁর নামটি বড়ো অদ্ভুত। তার নাম গোঁজলা গুই [আনুমানিক ১৭০৪—?]। তিনি ছিলেন আঠারোশতকের প্রথম দিকের মানুষ। গান গাইতেন ধনীদের বাড়িতে। কবিওয়ালারা যার কাছে গান রচনা শিখতেন তাঁকে গুরু বলে মান্য করতেন, তাই প্রত্যেক কবির এক একজন করে গুরুর নাম পাওয়া যায়। কয়েকজন বিখ্যাত কবিওয়ালার নাম : রাম বসু, রাসু, নৃসিংহ, অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি, হরু ঠাকুর, নিধুবাবু, কেষ্টা মুচি, ভবানী, রামানন্দ নন্দী। রাসু ও নৃসিংহ ছিলেন দুভাই। ফরাসি চন্দননগরের গোদলপাড়ায় তাঁরা জন্মগ্রহণ করেন। হরু ঠাকুর ছিলেন খুবই খ্যাতিমান। তিনি জন্মেছিলেন ১৭৪৯ সালে, আর তাঁর মৃত্যু হয় ১৮২৪ সালে। রাম বসু ছিলেন আরেকজন বিখ্যাত কবিওয়ালা। তাঁর জন্ম হয়েছিলো ১৭৮৬ সালে, আর মৃত্যু হয় ১৮২৮ সালে। কবি অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ছিলেন পর্তুগিজ। তিনিও হয়েছিলেন বাঙলার কবি, তবু তাঁর নামের সাথে জড়িয়ে আছে ফিরিঙ্গি শব্দটি। রাম বসু আর অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি সমসাময়িক ছিলেন, তাঁরা একই মঞ্চে প্রতিযোগিতায় নামতেন। একটি নমুনা দিচ্ছি।