লোকসাহিত্যের পৃথিবী পল্লী। লোকসাহিত্য পল্লীর মানুষের আনন্দকে ফুটিয়েছে ফুলের মতোন, বেদনাকে বাজিয়েছে একতারার সুরের মতোন। এ-সাহিত্যে আছে সরল অনুভবের কথা, এ-সরলতাই সকলকে মোহিত করে। লোকসাহিত্য পল্লীর মানুষের বুকের বাঁশরি। লোকসাহিত্যে দেখা যায় অতি সহজ করে অনেক গভীর কথা বলা হয়েছে। লোকসাহিত্যের কবিদের যেনো চিন্তা করার দরকারই ছিলো না, তাঁরা অবলীলায় বলে যেতেন তাঁদের কথা। তাই লোকসাহিত্যে পাওয়া যায় চমৎকার সহজ উপমা, সরল বর্ণনা। লোকসাহিত্যের ভাণ্ডার কিন্তু অনেক বড়ো, অনেক বিশাল। অনেক রকমের সৃষ্টি সেখানে দেখা যায়। লোকসাহিত্যে কী কী আছে? আছে ছড়া, প্রবাদ, আছে গীতি, গীতিকা, ধাঁধা, রূপকথা, এবং আরো অনেক কিছু। আমরা সব সময় না হলেও মাঝে মাঝে ছড়া কাটি, এ-ছড়া লোকসাহিত্যের এক গৌরব। গীতি ও গীতিকা লোকসাহিত্যের অনেকখানি অধিকার করে আছে। প্রবাদের কথা তো সবাই জানে, আর ছোটোরা ভালোবাসে রূপকথা—কেমন অশ্চার্য সে-সব গল্প।
ছড়া বড়ো মজার। সারাটি বাল্যকালই তো আমাদের কাটে ছড়ার যাদুমন্ত্র উচ্চারণ করে করে। কে এমন আছে যে বাল্যকালে মাথা দুলিয়ে ছড়া কাটে নি? ছড়ায় যাদু আছে। যে-সব কথা থাকে ছড়ার মধ্যে তার অনেক সময় কোনো অর্থই হয় না, বা অর্থ খুঁজে পাই না; তার এক পংক্তির অর্থ বুঝি তো পরের পংক্তির মানে বুঝি না। ছড়া আসলে অর্থের জন্যে নয়, তা ছন্দের জন্যে, সুরের জন্যে। অনেক আবোলতাবোল কথা থাকে তার মধ্যে, এ-আবোলতাবোল কথাই মধুর হয়ে ওঠে ছন্দের নাচের জন্যে। একটি ছড়া শোনা যাক :
আগড়ুম বাগড়ুম ঘোড়াড়ুম সাজে
ঝাঁঝর কাসর মৃদঙ্গ বাজে
দুটি পংক্তি আমরা গুণগুণ করলাম। এর অর্থ বোঝার কোনো দরকার নেই। তুমি কেবল এর ছন্দে মাতাল হও, এর ভেতর যে কোনো অর্থ থাকতে পারে তার কথা একেবারে ভুলে যাও, কেবল এর ছন্দের যাদুতে নাচো, নাচো। ছড়ায় কোনোই অর্থ থাকে, সে-কথা অবশ্যি পুরো সত্যি নয়। ছড়ায় অর্থ থাকে গভীর গোপনে, অনেক তলে লুকিয়ে; সে ধরা দিতে চায় না, কেননা তার অর্থটা বড়ো নয়। একটি ছড়া, যার ভেতর অনেক দুঃখ লুকিয়ে আছে, তুলে আনছি :
ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে
ধান ফুরুলো পান ফুরুলো খাজনার উপায় কি
আর কিছু কাল সবুর করো রসুন বুনেছি
এটা একটি ঘুমপাড়ানো ছড়া। এর ছন্দ নাচের চঞ্চল ছন্দ নয়, এর পংক্তিতে পংক্তিতে আছে স্বপ্নময় ঘুমের আবেশ। কিন্তু এটির ভেতর ছেড়া সুতোর মতো রয়ে গেছে বর্গীদের অত্যাচারের কথা। বর্গীরা অর্থাৎ মারাঠি দস্যুরা একসময় বাঙলায় ত্রাসের রাজত্ব পেতেছিলো; ছড়াটির মধ্যে ধরা আছে তার স্মৃতি। ছড়ার মাঝে এভাবে লুকিয়ে থাকে ইতিহাস। কিন্তু ছড়ার স্বাদ তার ছন্দে, তার মন্ত্রের মতো ধ্বনিতে।
গীতিকা লোকসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। গীতিকা ছড়ার মতো ছোটো নয়, গীতিকা আকারে অনেক বড়ো। এতে বলা হয় নরনারীর জীবন ও হৃদয়ের কথা। বাঙলা ভাষায় গীতিকার বিরাট ভাণ্ডার রয়েছে। এসকল গীতিকার মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে মহুয়া, দেওয়ানা মদিনা, মলুয়া। এগুলো প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত ময়মনসিংহ গীতিকায়। গীতিকাসমূহে একজন পুরুষ এবং একজন নারীর হৃদয় দেয়ানেয়ার বিষাদময় কাহিনী বর্ণনা করা হয়। গীতিকার নায়কনায়িকারা পল্লীর গাছপালার মতো সরল সবুজ, তারা পরস্পরকে ছাড়া আর কিছু জানে না। এর ফলে গীতিকায় পাওয়া যায় চিরকালের নরনারীর কামনাবাসনার কাহিনী।
একটি গীতিকার কাহিনী বলছি। গীতিকাটির নাম মহুয়া। এক বেদের দল ছিলো, তার সর্দার হুমরা বেদে। বেদেরা সাধারণত কঠিন মানুষ হয়, হুমরা বেদেও তেমনি। তারা জীবিকা অর্জন করতে নানা জায়গায় খেলা দেখিয়ে। একবার হুমরা বেদে কাঞ্চনপুর গ্রামে খেলা দেখাতে যায়। সে-গ্রাম থেকে হুমরা একটি শিশুকন্যাকে নিয়ে পালিয়ে যায়। এমেয়ের নাম হয় মহুয়া। মহুয়া হুমরাকে জানতো তার পিতা বলে। বেশ কয়েক বছর কেটে যায়। বড়ো হয় মহুয়া। সে দেখতে অপূর্ব সুন্দর। সে খেলাও দেখায় অপূর্ব। একবার হুমরা বেদের দল খেলা দেখাতে যায় বামনকান্দা গ্রামে। সে-গ্রামের এক যুবক, যার নাম নদের চাঁদ, মহুয়ার খেলা এবং মহুয়াকে দেখে মুগ্ধ হয়। মহুয়াও মুগ্ধ হয় নদের চাঁদকে দেখে। তারা ভালোবেসে ফেলে একে অপরকে। একথা জানতে পারে হুমরা বেদে। সে তার দলবল এবং মহুয়াকে নিয়ে আবার পালিয়ে যায়। কিন্তু নদের চাঁদ ও মহুয়া কেউ ভোলে না কারো কথা। অনেক খুঁজে আবার নদের চাঁদ দেখা পায় মহুয়ার। হুমরা মহুয়াকে আদেশ দেয় নদের চাঁদকে হত্যা করার। তার বদলে মহুয়া ও নদের চাঁদ যায় পালিয়ে। তারা বাসা বাঁধে, সুখে সময় কাটাতে থাকে। কিন্তু সুখ তাদের জন্যে নেই। তাদের ভুলে যায় নি হুমরা বেদে। হুমরা বেদে খুঁজতে থাকে নদের চাঁদ ও মহুয়াকে। একসময় দেখা পায় এ-সুখী দম্পতির। তার মনে জ্বলে ওঠে আগুনের মতো প্রতিহিংসা। হুমরা বেদে মহুয়ার হাতে তুলে দেয় বিষমাখা ছুরি, বলে নদের চাঁদকে হত্যা করতে। কিন্তু কীভাবে এ সম্ভব, কেননা নদের চাঁদ যে তার কাছে নিজের চেয়েও প্রিয়। তাই মহুয়া পারে নি বেদের আদেশ মানতে। কিন্তু বেদের আদেশ অবশ্য পালনীয়, একথা সে জানতো। তাই মহুয়া নদের চাঁদের বদলে নিজের কোমল বক্ষে আমূল বিদ্ধ করে বিষাক্ত ছুরিকা। সাথেসাথে হুমরার সাথীরা হত্যা করে নদের চাঁদকে। তাদের দুজনকে কবর দেয়া হয় পাশাপাশি। তারপর চলে যায় বেদেরা। শুধু থাকে একজন তাদের কবরের পাশে মোমবাতির মতো জেগে; সে মহুয়ার চিরদিনের বান্ধবী পালঙ। বড়ো বেদনার গল্প মহুয়া।