পদ্মাবতী রূপ কি কহিমু মহারাজ।
তুলনা দিবারে নাহি ত্রিভুবন মাঝ।।
আপাদলম্বিত কেশ কস্তুরী সৌরভ।
মহাঅন্ধকারময় দৃষ্টি পরাভব।।
তার মধ্যে সীমন্ত খড়গের ধার জিনি।
বলাহক মধ্যে যেন স্থির সৌদামিনী।।
স্বর্গ হন্তে আসিতে যাইতে মনোরথ।
সৃজিল অরণ্যমাঝে মহাসূক্ষ্ম পথ।।
পদ্মাবতীর রূপ অপূর্ব, তবে কবির ভাষা বুঝতে কিছুটা অসুবিধা হতে পারে। কবি কী বলছেন এখানে? আসলে কবি নন, এক হীরামণ পাখি রত্নসেনকে বলছে, মহারাজ পদ্মাবতীর রূপের কথা আমি আর কী বলবো! তার সাথে তুলনা দিতে পারি এমন জিনিশ তো ত্রিভুবনে নেই। তার মাথার কেশরাশি পা পর্যন্ত লম্বা, আর তাতে ভরপুর সর্বদা মৃগনাভির সৌরভ। সে-কেশরাশি এতো কালো যে চোখের দৃষ্টি সেখানে পরাজিত হয়, তা রাত্রির মতো। তোমরা যখন বড়ো হবে চুল সম্বন্ধে একজন আধুনিক কবির এরকম এক অসাধারণ পংক্তির সাক্ষাৎ পাবে। সে-কবির নাম জীবনানন্দ দাশ। তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতা হচ্ছে বনলতা সেন’। জীবনানন্দ দাশ বনলতা সেনের চুলের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা।’ চমৎকার না? যাক, আমরা আলাওলে ফিরে আসি। কবি এরপরে সিঁথির কথা বলছেন। পদ্মাবতীর সিথি কেমন? তা খুব সরু, সুন্দর, তীক্ষ, এমনকি তরবারির তীক্ষ্ণতার চেয়েও অধিকতর তীক্ষ পদ্মাবতীর সিথি। তারপর কবি একটি উপমা দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন সে-সিঁথির সৌন্দর্য। বলছেন, ওই সিঁথির রেখাকে মনে হয় যেনো কালো মেঘের মধ্যে স্থির হয়ে আছে বিদ্যুৎরেখা। এতেও কবির মন ভরে নি। তাই তিনি দেন আরো একটি উপমা। বলেন, স্বর্গ থেকে আসা-যাওয়ার জন্যে সৌন্দর্যের দেবতা অরণ্যের মধ্যে এক সূক্ষ্ম পথ নির্মাণ করেছিলেন, পদ্মাবতীর সিথি তেমনি সুন্দর, নয়নাভিরাম। আলাওল কিন্তু খুব সহজ কবি নন। তিনি কথা বলেন উপমায়, অলঙ্কারে এবং অনেক সময় বেশ শক্ত শব্দে। তিনি মনোযোগ দিয়ে পড়ার মতো কবি।
লোকসাহিত্য : বুকের বাঁশরি
আমরা বাতাসের সাগরে ড়ুবে আছি। তবু অনেক সময় মনে থাকে না যে আমাদের ঘিরে আছে বাতাস। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ একবার বাতাসের সাথে তুলনা করেছিলেন লোকসাহিত্যকে। বাতাস যেমন আমাদের ঘিরে আছে, তেমনি আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে লোকসাহিত্য। কিন্তু তার কথা আমাদের মনে থাকে না। তা যে বাতাসের মতোই উদার, বাতাসের মতোই সীমাহীন। যে-সাহিত্য লেখা হয় নি তালপাতার মূল্যবান গাত্রে, যে-সাহিত্য পায় নি সমাজের উঁচুতলার লোকদের আদর, যে-সাহিত্য পল্লীর সাধারণ মানুষের কথা বলেছে গানেগানে, যে-সাহিত্যের রচয়িতার নামও অনেক সময় হারিয়ে গেছে, তাকে বলা হয় লোকসাহিত্য। এ-সাহিত্য বেঁচে আছে শুধুমাত্র পল্লীর মানুষের ভালোবাসা ও স্মৃতি সম্বল করে। অনেক ছড়া আমরা পড়ি, জানি না সেগুলোর রচয়িতা কারা? এগুলো অনেক দিন ধরে বেঁচে আছে পল্লীর মানুষের কণ্ঠে। অনেক গীতিকা আমরা শুনি, জানি না কখন কোন কবি লিখেছিলেন এ-বেদনাময় কাহিনী। এ-সবই লোকসাহিত্যের সম্পদ।
লিখিত সাহিত্যের থাকে নির্দিষ্ট লেখক। কিন্তু লোকসাহিত্যের কোনো সুনির্দিষ্ট লেখকের পরিচয় পাওয়া যায় না। মনে হয় যেনো সারা সমাজ একসাথে বসে নিজেদের মনের কথা গানের সুরে বলেছে। তা লেখা হয় নি কাগজে বা তালপাতায়। তবে তা লেখা হয়েছে মানুষের হৃদয়ে। গ্রামের মানুষ সে-গান মনে রেখেছে, আনন্দে বেদনায় তা গেয়েছে। এভাবে বেঁচে আছে লোকসাহিত্য। লোকসাহিত্যের সৃষ্টি ও বিকাশের রীতি বেশ চমৎকার। ধরা যাক ছড়ার কথা। কখন যে কার মনে কোন ঘটনা দাগ কেটেছে, এবং সে ঘটনা ছন্দ লাভ করেছে, তা আজ আর বলা সম্ভব নয়। কিন্তু সেই ছড়া একজনের কাছ থেকে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছে সারা সমাজে। সমাজের যখন ভালো লেগেছে ছড়াটিকে, তখন সেটিকে মুখেমুখে ছড়িয়ে দিয়েছে চারদিকে। এভাবে ছড়াটি হয়ে উঠেছে সমগ্র সমাজের সৃষ্টি। কোনো নির্দিষ্ট লেখকের নাম আর পাওয়া যায় না। আবার ধরা যাক কোনো গীতিকার কথা। গীতিকা হয় বেশ দীর্ঘ; তাতে বড়ো কাহিনী বলা হয়ে থাকে। কিন্তু অধিকাংশ গীতিকার লেখকের নাম পাওয়া যায় না। কেননা পাওয়া যায় না? পাওয়া যায়, কেননা হয়তো তার কোনো একজন নির্দিষ্ট কবি নেই, অনেকের মনের কথা হয়তো জমাট বেঁধে একটি গীতিকায় রূপ পেয়েছে। আবার হয়তো কোনো একজন কবি মূলে সত্যিই রচনা করেছিলেন গীতিকাটি। রচনা হয়ে যাওয়ার পরে তিনি সেটি গান করেন সকলের সামনে। ভালো লাগে সকলের গীতিকাটি। তখন সমাজের লোকেরা মুখস্থ করে নেয় গীতিকাটিকে। তারপর কেটে যায় অনেক বছর। যে-কবি আগে রচনা করেছিলেন গীতিকাটি, কালের প্রবাহে তাঁর নাম যায় হারিয়ে, তখন গীতিকাটি হয়ে ওঠে সারা সমাজের সৃষ্টি। কেননা কবির রচনা এর মধ্যে অনেক বদলে গেছে মানুষের কণ্ঠেকণ্ঠে ফিরেফিরে।
বাঙলা সাহিত্য বেশ ধনী লোকসাহিত্যে। প্রচুর লোকসাহিত্য আছে আমাদের। গ্রামেগ্রামে ছড়িয়ে ছিলো, এবং আজো আছে। ভদ্রলোকেরা এর সংবাদ অনেক দিন জানতো না। কেননা লোকসাহিত্য লিখিত হয় নি, তা বেঁচে ছিলো গ্রামের মানুষের মনে। তারাই ছিলো লোকসাহিত্যের লালনপালনকারী। তারপর এক সময় আসে যখন দ্রলোকদের দৃষ্টি পড়ে সেদিকে। শুরু হয় লোকসাহিত্য সগ্রহ। বাঙলাদেশের গ্রামাঞ্চল থেকে সংগৃহীত হয় অনেক ছড়া, অনেক গীতিকা। আমরা সেগুলোর স্বাভাবিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হই। বাঙলা লোকসাহিত্য সংগ্রহের জন্যে যাদের নাম বিখ্যাত, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে। বিখ্যাত চন্দ্রকুমার দে (১৮৮৯-১৯৪৬)। তিনি ছিলেন ময়মনসিংহের অধিবাসী। লোকসাহিত্যের প্রতি তাঁর ছিলো প্রবল অনুরাগ; তাই তিনি সংগ্রহ করেছিলেন অনেকগুলো গীতিকা। তাঁর সংগৃহীত গীতিকাগুলোকে সম্পাদনা করে ময়মনসিংহ গীতিকা (১৯২০) নামে প্রকাশ করেন ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন। দীনেশচন্দ্র সেন নিজে সংগ্রাহক ছিলেন না, কিন্তু তার ছিলো লোকসাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগ। তিনি লোকসাহিত্যকে দেশেবিদেশে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও লোকসাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন। তিনি সগ্রহ করেছিলেন অনেকগুলো ছড়া। কেবল ছড়া সগ্রহ করে তিনি থেমে যান নি। লোকসাহিত্যের ওপর একটি অসাধারণ বইও তিনি লিখেছিলেন লোকসাহিত্য নামে। এবই লোকসাহিত্যকে জনপ্রিয় করতে অনেক সহায়তা করেছে। রূপকথা সংগ্রহ করেছিলেন দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার [১৮৭৭-১৯৫৭], উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (১৮৬৩-১৯১৫)। দক্ষিণারঞ্জন মিত্ৰমজুমদারের রূপকথা সংগ্রহের নাম ঠাকুরমার ঝুলি, ঠাকুরদাদার ঝুলি। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর রূপকথা সংগ্রহের নাম টুনটুনির বই। এছাড়া আছেন আরা অনেক সংগ্রাহক, যাঁদের সকলের চেষ্টায় আমরা পাচ্ছি এক অপূর্ব লোকসাহিত্যের ভাণ্ডার।