যে সব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়।
নিজ দেশ ত্যাগি কেন বিদেশ ন যায়।।
মাতাপিতামহক্রমে বঙ্গেত বসতি।
দেশী ভাষা উপদেশ মান হিত অতি।।
এ-অংশ পড়লে বোঝা যায় কবি কী গভীরভাবে বাঙালি ছিলেন। বর্তমানের বাঙালিদের তিনি যথার্থ পূর্বপুরুষ; তবে তিনি যাদের নিন্দা করছেন, তারা এখনো আছে বাঙলায়।
মধ্যযুগে আরাকানেও রচিত হয়েছিলো বাঙলা সাহিত্য। এই আরাকানের প্রাচীন নাম ছিলো রোসাঙ্গ। আরাকানের রাজদরবারে স্থান পেয়েছিলেন বাঙলা ভাষার কয়েকজন ভালো কবি। তাঁদের মধ্যে আছেন আলাওল, কাজি দৌলত, মাগন ঠাকুর। এ-কবি তিনজনের সবাই সপ্তদশ শতকের মানুষ। কাজি দৌলত লিখেছিলেন একটি কাব্য; নাম সতীময়না বা লোরচন্দ্রানী। কাব্যটি তিনি নিজে সমাপ্ত করে যেতে পারেন নি। কিছু অংশ লেখার পরে তিনি পরলোকগমন করেন। পরে কাব্যটি সমাপ্ত করেন আলাওল। কাজি দৌলত জন্মগ্রহণ করেছিলেন চট্টগ্রামের রাউজান থানার সুলতানপুর গ্রামে। বয়স হবার পরে তিনি আরাকানের রাজসভায় যান, এবং আরাকানের রাজা সুধর্মের সেনাপতি আশরাফ খানের প্রীতি লাভ করেন। আশরাফ খানের উৎসাহে তিনি রচনা করেন সতীময়না নামক কাব্যটি।
আলাওল ছিলেন আরাকানের রাজসভার আশীর্বাদপ্রাপ্ত কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। শুধু তাই নয়, তিনি মধ্যযুগের মুসলমান কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তিনি সমগ্র বাঙলা সাহিত্যের বড়ো কবিদের একজন। তাঁর কথা পরে পৃথকভাবে বলবো। কবি আলাওলকে আশ্রয় দিয়েছিলেন মাগণ ঠাকুর। তার নামটি অদ্ভুত; তবে তিনি ছিলেন মুসলমান। তিনি ছিলেন আরাকানের অধিবাসী। মাগন ঠাকুরও একটি ভালো কাব্য লিখেছিলেন চন্দ্রাবতী নামে। তিনিও বেশ ভালো কবি ছিলেন।
মুসলমান কবিদের সংবাদ আমরা সব জানি না। কেননা বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনার জন্যে যখন তথ্য সংগ্রহ করা শুরু হয়, তখন মুসলমান কবিদের কাব্য বিশেষ সংগ্রহ করা হয় নি। কে করবে? মুসলমানেরা চিরদিনই এসব বিষয়ে উদাসীন। তবু কিছু সংবাদ পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে একজন মহাপুরুষের চেষ্টায়। তার নাম আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ [১৮৭১-১৯৫৩)। তিনি ছিলেন চট্টগ্রামের অধিবাসী। তিনি গ্রামেগ্রামে ঘুরে সংগ্রহ করেছেন মুসলমান কবিদের পুথি। যদি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ না জন্মাতেন, তাহলে হয়তো মুসলমান কবিদের সাধনার কথা জানতে পেতাম না। তাই তিনি চিরস্মরণীয়।
আলাওল
আলাওল, কবি; বড়ো কবি। তিনি লিখেছেন অনেকগুলো কাব্য, আর প্রত্যেক কাব্যে লিখেছেন অসংখ্য ভালো কবিতার পংক্তি। তিনি সপ্তদশ শতকের কবি। তাঁর কবিতা পড়ার সময় আগে মনে দাগ কাটে তাঁর ভাষা। সে-সময় কবিরা ভাষার দিকে বিশেষ নজর দিতেন না। কিন্তু আলাওল কবিতা লেখার সময় ভাষাকে ভাবতেন দেবতা, তাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিতেন। সেকালের অনেক বড়োবড়ো কবি ছিলেন ভাষার ব্যবহারে গ্রাম্য। তাঁরা যে-কোনো শব্দকে কবিতার চরণে ঠাই দিতেন। কবি আলাওল ছিলেন অন্যরকম। ভাষাকে সাজাতেন নানা অলঙ্কারে, অনেক অপ্রচলিত মনোহর শব্দকে তিনি ডেকে আনতেন এবং কবিতাকে করে তুলতেন সুনির্মিত প্রাসাদের মতো চমৎকার। আলাওলের “পদ্মাবতী” কাব্যটি পড়ার সময় বারবার মনে হয় যেনো ক্রমশ একটি সযত্নে নির্মিত প্রাসাদের ভেতর প্রবেশ করছি। তার কক্ষেকক্ষে ছড়িয়ে আছে সৌন্দর্য।
আলাওল সপ্তদশ শতকের কবি। তাঁর জন্ম, জন্মস্থান ইত্যাদি নিয়ে বিতর্ক আছে। কেউ বলেন, তিনি ফরিদপুরের লোক; কেউ বলেন, আলাওল চট্টগ্রামের মানুষ। তবে একথা ঠিক তার জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে চট্টগ্রামে, বিশেষ করে আরাকানে। আলাওল বিভিন্ন কাব্যে নিজের কথা বলেছেন। তা থেকে জানা যায় কবি আলাওলের জীবন শাদামাটা ছিলো না, তাতে আছে অনেক ওঠানামা, আছে রোমাঞ্চ, আছে জীবনের সুখ ও দুঃখের টানাপোড়েন। কবির পিতা ছিলেন ফতেহাবাদ অঞ্চলের অধিপতি মজলিশ কুতুবের প্রধান কর্মচারী। একসময়ে আলাওল তাঁর পিতার সাথে নৌকো করে কোথাও যাচ্ছিলেন। সে-সময় বাঙলার নদীতেনদীতে দস্যুতা করে ফিরতে পর্তুগিজরা। আলাওলের পিতার নৌকো আক্রমণ করে পর্তুগিজ জলদস্যুরা। অনেকক্ষণ লড়াই হয় তাদের মধ্যে। সে-লড়াইয়ে আলাওলের পিতা নিহত হন। কবির জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। অনেক কষ্টের মুখে আলাওল আসেন আরাকানে। আলাওলের বয়স তখন কম; যোললা থেকে কুড়ির মধ্যে। আলাওল ভর্তি হন আরাকানের রাজার অশ্বারোহী সেনাবাহিনীতে। সে-সময় আরাকানের রাজদরবারে অনেক নামকরা মুসলমান কর্মচারী ছিলেন। তাঁরা কবি আলাওলের প্রকৃত পরিচয় পেয়ে তাঁকে উৎসাহ দেন কবিতা রচনা করতে। তাঁদের উৎসাহ পেয়ে সৈনিক আলাওল কবি হয়ে ওঠেন। কবি আলাওল তাঁর জীবনের যে-সব কথা বলেছেন, তা শোনার মতো। তিনি পদ্মাবতী কাব্যে নিজের সম্বন্ধে যা বলেছেন, তার খানিকটা :
মুলুক ফতেহাবাদ গৌড়েত প্রধান।
তথাত জালালপুর পুণ্যবন্ত স্থান।।
বহু গুণবন্ত বৈসে খলিফা ওলামা।
কথেক কহিমু সেই দেশের মহিমা।।
মজলিশ কুতুব তাহাতে অধিপতি।
মুই হীন দীন তান অমাত্য সন্ততি।।
কার্যগতি যাইতে পথে বিধির গঠন।
হার্মাদের নৌকা সঙ্গে হৈল দরশন।।…
কহিতে বহুল কথা দুঃখ আপনার।
রোসাঙ্গ আসিয়া হৈলুং রাজ আসোয়ার।।