নানা রকমের কবিতা লিখেছেন মুসলমান কবিরা। তাঁরা লিখেছেন কাহিনীকাব্য, লিখেছেন ধর্মীয় কাব্য। তাঁরা লিখেছেন ইতিহাস ও কল্পনা মিলিয়েমিশিয়ে বড়োবড়ো কাব্য। লিখেছেন শোককবিতা, লিখেছেন সঙ্গীতশাস্ত্র, জ্যোতিষশাস্ত্র সম্বন্ধীয় বই। সবই কবিতায় বা পদ্যে। ইউসুফ-জুলেখার কাহিনী লিখেছেন শাহ মুহম্মদ সগীর। হানিফা ও কয়রা পরীর গল্প লিখেছেন সাবিরিদ খান। লাইলি-মজনুর প্রণয়ের কথা বলেছেন বাহরাম খান। এগুলো বিদেশের কাহিনীর অনুবাদ। ইউসুফ-জুলেখার গল্প নিয়ে ফারসি ভাষায় বেশ কয়েকজন বড়ো কবি কাব্য লিখেছেন। তাঁদের মধ্যে আছেন ফেরদৌসি ও জামি। তাঁদের কারো বইয়ের অনুবাদ করেছিলেন কবি সগীর। লাইলি-মজনুর গল্প অবলম্বনে ফারসি কবি জামি কাব্য লিখেছিলেন। এ-বইয়ের অনুবাদ হচ্ছে বাহরাম খানের লাইলি-মজনু। মুসলমান কবিরা যে কেবল বিদেশের গল্পেরই অনুবাদ করেছেন, তা নয়। ভারতববেস বিখ্যাত অনেক গল্প তাঁদের আকর্ষণ করেছে, এবং তাঁরা সেগুলো নিয়ে কাব্য লিখেছেন। মনোহর-মধুমালতীর কাহিনী লিখেছেন কবি মুহম্মদ কবির। বিদ্যাসুন্দরের কাহিনী নিয়ে চমৎকার বই লিখেছেন সাবিরিদ খান। মুহম্মদ কবির ছিলেন ষোড়শ শতকের শেষাংশের কবি। তিনি তাঁর কাব্য মধুমালতী লেখা শুরু করেছিলেন ১৫৮৩ অব্দে। সাবিরিদ খানও সম্ভবত ষোড়শ শতকেরই কবি। তাঁর কাব্য আছে বেশ কয়েকটি। বিদ্যাসুন্দর ছাড়াও তিনি লিখেছেন রসুলবিজয় ও হানিফা ও কয়রা পরী নামক আরো দুটি কাব্য। কবি হিশেবে খুব ভালো কবি ছিলেন বাহরাম খান। তাঁর কাব্যের নাম লাইলি-মজনু। তিনিও ছিলেন ষোড়শ শতাব্দীর কবি। বাহরাম খান তাঁর কাব্যের শুরুতে একটি বড়ো আত্মকাহিনী বলেছেন। সে থেকে জানা যায় তাঁর পিতার নাম ছিলো মুবারক খান। তিনি ছিলেন নিজাম শাহের দৌলত উজির’ অর্থাৎ অর্থমন্ত্রী। মুবারক খান মারা গেলে নিজাম শাহ কবি বাহরাম খানকে অর্থমন্ত্রী পদটি দান করেন। কবি নগর চট্টগ্রামের চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন :
নগর ফতেয়াবাদ দেখিতে পুরএ সাধ,
চাটিগ্রামে সুনাম প্রকাশ।
।মনোহর মনোরম অমর নগর সম,
শতে শতে অনেক নিবাস।
লবণাম্বু সন্নিকট কর্ণফুলি নদীতট
শুভপুরী অতি দীপ্যমান।
চৌদিক বিশাল গড় উজল বিস্তর সর
তাহে শাহ বদর পয়ান।
আরেকজন কবি ছিলেন আফজল আলী। তিনি একটি কাব্য লিখেছিলেন, কাব্যটির নাম নসিহত্যামা। ইতিহাস ও কল্পনা মিলিয়ে কয়েকজন কবি কাব্য লিখেছিলেন। এসব কাব্যে ইতিহাস প্রায় রূপকথায় পরিণত হয়েছে। এসব কাব্যে কবিদের উদ্দাম কল্পনা দেখে অবাক হতে হয়। এ-রকম কাব্য লিখেছিলেন জৈনুদ্দিন, সাবিরিদ খান, শেখ ফয়জুল্লাহ। কবি জৈনুদ্দিনের কাব্যের নাম রসুলবিজয়, শেখ ফয়জুল্লাহর কাব্যের নাম গাজিবিজয়। ফয়জুল্লাহ গোরক্ষবিজয় নামে আরো একটি কাব্য লিখেছিলেন। এ-সময়ে আরো বেশ কয়েকজন কবি ছিলেন। তাঁদের নাম চাদ কাজি, শেখ কবির, মোজাম্মিল। যাদের কথা বললাম তাঁরা সবাই প্রায় সোড়শ শতাব্দীর কবি। এ-সময়ে মুসলমান কবিরা একে একে কাব্যরাজ্যে আসছেন আর আসন অধিকার করছেন। তাঁদের কবিতা কাব্যমূল্যে বেশ মূল্যবান, যদিও বড়ো কবি নন তাঁরা। এরপরে আসেন সপ্তদশ শতাব্দীর কবিরা।
আসেন অনেক কবি। তাঁদের মধ্যে আছেন সৈয়দ সুলতান, শেখ পরাণ, হাজি মুহম্মদ, মুহম্মদ খান, সৈয়দ মর্তুজা, আবদুল হাকিম, কাজি দৌলত, আলাওল, মাগন ঠাকুর, এবং আরো অনেকে। সৈয়দ সুলতান, আবদুল হাকিম, কাজি দৌলত এবং আলাওল বিখ্যাত কবি। তাঁরা সবাই মিলে বাঙলা কবিতাকে এমন সৌন্দর্য দান করেছিলেন, যা তাদের সহগামী হিন্দু কবিদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। এর ফলে বাঙলা সাহিত্য মধ্যযুগ থেকে হয়ে ওঠে হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের সম্পত্তি। তারা উভয়ে মিলে বুনে যেতে থাকে কাব্যলক্ষ্মীর শাড়ির পাড়।
কবি সৈয়দ সুলতানের জীবন মোড়শ এবং সপ্তদশ দু-শতকে বিস্তৃত ছিলো। তিনি বেঁচেছিলেন অনেকদিল, আর লিখেছিলেন অনেক কাব্য। তার কয়েকটি কাব্য আকারে বিশাল। তাঁর কাব্যশক্তিও ছিলো গৌরবজনক। কবি সৈয়দ সুলতান তাঁর শবেমিরাজ কাব্যে নিজের বিশদ পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর কাব্যগুলো হচ্ছে নবীবংশ, শবেমিরাজ, রসুলবিজয়, ওফাতে রসুল, জয়কুম রাজার লড়াই, ইবলিশনামা, জ্ঞানচৌতিশা, জ্ঞানপ্রদীপ। এছাড়া তিনি লিখেছেন মারফতি গান এবং পদাবলি। কবির নবীবংশ বিশাল বই। এ-কাব্যে কবির ইসলামপ্রচারক মনটি স্পষ্ট দেখা যায়। কবি এ-কাব্য সম্বন্ধে বলেছেন :
কহে ছৈয়দ সুলতানে শুন নরগণ।
এহি হিন্দি নবীবংশ শুন দিয়া মন।।
আছিল আরবী ভাষে হিন্দি করিলুঁ।
বঙ্গদেশী বুঝে মত প্রচারিয়া দিলুঁ।
ন বুঝি আরবী শাস্ত্র জ্ঞান ন পাইলা।
হিন্দিয়ানি ভাষা পাই আচার জানিলা।।
কবি হাজি মুহম্মদের একটি কাব্য পাওয়া গেছে, কাব্যটির নাম নূরজামাল। কবি মুহম্মদ খানের কাব্যও আছে বেশ কয়েকটি। তাঁর কাব্যের নাম সত্যকলি-বিবাদসংবাদ, হানিফার লড়াই, মুকতাল হোসেন।
মধ্যযুগের একজন ভালো কবি কবি আবদুল হাকিম। তাঁর আটটি কাব্যের খবর পাওয়া গেছে। তার কয়েকটি কাব্যের নাম হচ্ছে ইউসুফ-জুলেখা, নূরনামা, কারবালা, শহরনামা। কবি আবদুল হাকিম নিজেকে বাঙালি বলতে গর্ববোধ করতেন। সেই মধ্যযুগেই একদল মুসলমান দেখা দিয়েছিলো যারা নিজেদের বাঙালি বলতে চাইতো না। তারা নিজেদের আরবইরানের মানুষ ভাবতে চাইতো। বাঙলা ভাষাকে তারা অবজ্ঞা করতো। আবদুল হাকিম এদের ওপর ভয়ানক ক্ষেপেছিলেন। এসব পরগাছাদের নিন্দা করে তিনি লিখেছিলেন অমর কতিপয় পংক্তি; সে-পংক্তিগুলো আছে তাঁর নূরনামা কাব্যে। পংক্তিগুলো তুলে দিচ্ছি :