কৃত্তিবাসের হাতে রাজপুত্র রাম, রাজবধূ সীতার অনেক বদল ঘটেছে। বদলে গেছে লক্ষ্মণ, রাবণ। সবাই বাঙালিতে পরিণত। প্রাচীন মহিমা এ-বইতে রক্ষিত হয় নি বলে দুঃখ করার কিছু নেই, কেননা এটি নবরামায়ণ। রামায়ণ বলতে যেমন বাঙলায় বোঝায় কৃত্তিবাসের রামায়ণ, তেমনি মহাভারত বলতে বোঝায় কাশীরাম দাসের মহাভারত। কাশীরাম মহাভারতের প্রথম কবি নন, অনেক কবি যখন মহাভারত রচনা করে ভূলোক থেকে বিদায় নিয়েছেন তখন সতেরোশতকে দেখা দেন বাঙলার বেদব্যাস কাশীরাম দাস। তার মহাভারত অনেকদিন ধরে বাঙলার ঘরেঘরে গল্পের স্বাদ এবং ধর্মের পুণ্য বিলিয়ে আসছে। কাশীরামের বিখ্যাত স্তবকটি কে না জানে :
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।
কাশীরাম অবশ্য সারাটি মহাভারত অনুবাদ করেন নি। অনেকে মনে করেন কাশীরাম দাস ১৬০২ থেকে ১৬১০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মহাভারত রচনা করেন। কাশীরামের পরিবারটি ছিলো কবি-পরিবার, এক বংশে এতো কবির জন্ম বেশি হয় নি। কাশীরামের পিতার নাম কমলাকান্ত। তাঁর বড়ো ভাই লিখেছেন শ্রীকৃষ্ণবিলাস নামে একটি কাব্য, ছোটো ভাই গদাধর লিখেছেন জগতমঙ্গল নামে একটি কাব্য। আর কাশীরাম তো মহাকবি। প্রচলিত আছে যে কাশীরাম দাস মহাভারত পুরোপুরি অনুবাদ করে যেতে পারেন নি। এ সম্বন্ধে যে-শ্লোকটি প্রচলিত, তা হচ্ছে :
আদি সভা বন বিরাটের কতদূর।
ইহা রচি কাশীদাস গেলা স্বর্গপুর।।
ধন্য হইল কায়স্থ কুলেতে কাশীদাস।
তিন পর্ব ভারত যে করিল প্রকাশ।।
তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর ভাইয়ের ছেলে এবং আরো কয়েকজন মিলে মহাভারতের অনুবাদ সম্পূর্ণ করেন। কাশীরামের মহাভারতের সাথে সংস্কৃত মহাভারতের অমিল অনেক। মহাভারতের শৌর্য সংঘাতের বিরাটত্ব এতে নেই; এ-কাব্য হয়ে উঠেছে বাঙালির মহাভারত এবং পরিণত হয়েছে বাঙলার সাধারণ সম্পত্তিতে।
ভিন্ন প্রদীপ : মুসলমান কবিরা
বাঙলাদেশে মুসলমানদের আগমন এক হাজার বছরের প্রথম প্রধান ঘটনা; দ্বিতীয় প্রধান ঘটনা ইংরেজদের আগমন। এয়োদশ শতকের প্রথম দশকে ইখতিয়ারউদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি নবদ্বীপের বুড়ো রাজা লক্ষ্মণ সেনকে হঠাৎ আক্রমণ করে। রাজা পালিয়ে বাঁচে। শুরু হয় এদেশে নতুন যুগ। রাজা গেলো বদলে। শুধু রাজা বদলালো, তাই নয়; সে-কোন সুদূর থেকে এলো বিদেশি রাজা। তাদের ধর্ম ভিন্ন, সংস্কৃতি ভিন্ন, চরিত্র ভিন্ন। তার ফলে দেশে এলো বিরাট আলোড়ন। সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য, অর্থাৎ জীবনের সবদিকে পড়লো তার প্রচণ্ড প্রভাব। মুসলমান রাজারা রাজ্যে একটু আরাম করে বসার পর এদেশের কবিদের দিতে লাগলো উৎসাহ। কিন্তু বাঙলা সাহিত্যে মুসলমানেরা প্রবেশ করে কখন? চতুর্দশ শতকের শেষ দিকে বা পঞ্চদশ শতকের প্রথম পাদে দেখি বাঙলা ভাষায় কবিতা রচনায় হাত দিয়েছেন মুসলমান কবিরা। বেশ কয়েক শশা বছর লেগেছিলো। অবশ্য একথা ভাবার কারণ নেই যে বিদেশ থেকে আসা মুসলমানেরা শুরু করেছিলো বাঙলা কবিতা লেখা। কবিতা যারা লিখেছেন, তাঁরা এদেশেরই বাঙালি; শুধু তারা ধর্ম বদলে হয়েছিলেন মুসলমান। বাঙলা ভাষায় প্রথম মুসলমান কবি শাহ মুহম্মদ সগীর। তিনি সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের রাজত্বকালে কাব্য রচনা করেন। তাঁর কাব্যের নাম ইউসুফ-জুলেখা।
মুসলমান কবিরা কবিতা লেখা শুরু করলেন বাঙলা ভাষায়। তাঁদের কবিতা নানা দিক দিয়ে নতুন। তাঁরা সৃষ্টি করেন বাঙলা কাব্যজগতে এক নতুন ধারা। মধ্যযুগের হিন্দু কবিদের সব কবিতা ধর্মকেন্দ্রিক। দেবতাদের নিয়ে তাঁরা রচনা করেছেন তাঁদের কাব্যাবলি। মঙ্গলকাব্যে দেখি দেবতাদের লীলাখেলা। বৈষ্ণব পদাবলিতে পাই দেবতার চেয়ে বড়ো রাধা আর কৃষ্ণকে। আরো আগে লেখা চর্যাপদ তো ধর্মের নিয়মকানুনের কাব্য। তাই মধ্যযুগে ধর্ম ছাড়া কবিতা ছিলো না। সেখানে মানুষ ছিলো গৌণ, দেবতাই প্রধান। সাধারণ মানুষের জীবনের কথা কবিরা ভাবতে পারেন নি। মুসলমান কবিরা নিয়ে আসেন নতুন বিষয়বস্তু। মুসলমানদের দেবতা নেই। তাই তারা লেখেন মানুষের গল্প। এগল্প কখনো ইউসুফ-জুলেখার, কখনো লাইলি-মজনুর। এরা দেবতা নয়, মানুষ, যদিও অবাস্তব। আধুনিক কালে মানুষই সাহিত্যের মূল বিষয়।
মুসলমান কবিরা যে শুধু মানুষের কথা বলছেন, তা নয়। ধর্ম তাঁদের কবিতারও একটি বড়ো অংশ অধিকার করে আছে। এ-ধর্ম অবশ্য পুরোপুরি কোরানহাদিসের ধর্ম নয়। ইসলামের অনেক গল্প তারা নানা লৌকিক কাহিনীর সাথে মিশিয়ে পরিবেশন করেছেন। হিন্দুদের একটি বড়ো ঐতিহ্য রয়েছে, সে-ঐতিহ্য রামায়ণের, মহাভারতের। মুসলমানদের ঠিক এমন কোনো কাহিনীভরা ঐতিহ্য নেই। তাই অনেক মুসলমান কবি হিন্দুদের অনুসরণে নতুন নতুন মুসলমান ঐতিহ্যের জন্ম দিয়েছেন। যেমন, ধরা যাক ইউসুফ-জুলেখার গল্প। এ-গল্প কোরানে আছে, বাইবেলে আছে। কিন্তু তা আছে সামান্য হয়ে, অত্যন্ত খসড়া আকারে। কবিরা সেই খসড়া গল্পের গায়ে নিজেদের কল্পনা মিশিয়ে নতুন কাহিনী গড়ে তুলেছেন তারা।
মুসলমান কবিদের কবিতা সম্বন্ধে একটি কথা মনে রাখতে পারি। তা হচ্ছে তাদের কোনো রচনাই মৌলিক নয়, তাঁরা নিজেরা কোনো গল্পের কাহিনী তৈরি করেন নি। তাঁদের সব রচনাই অনুবাদ। তাঁরা অনুবাদ করেছেন হিন্দি থেকে, ফারসি থেকে, আরবি থেকে। এ-অনুবাদ আজকের দিনের অনুবাদের মতো নয়। আজকের দিনে আমরা যে-বই অনুবাদ করি, তাকে অবিকৃত রাখতে চাই। মূল রচনার কোনো অংশ বাদ দিই না, বা নিজেদের কোনো রচনাংশ ওই বইয়ের মধ্যে জুড়ে দিই না। কিন্তু আমাদের কবিরা অন্য রকম করেছেন। তাঁরা মূল রচনার কোনো অংশ হয়তো পরিত্যাগ করেছেন, আবার কোথাও নিজের রচনাকে গেঁথে দিয়েছেন। হয়তো তিনি আরবদেশের বই অনুবাদ করছেন। মূল বইতে আছে মরুভূমির কথা। কিন্তু আমাদের কবিরা সেখানে বলেছেন স্নিগ্ধ সজল সবুজ বাঙলার মাঠের কথা। এর ফলে ওই বই অনুবাদ হয়েও আর অনুবাদ থাকে নি, হয়ে উঠেছে নতুন বই। মৌলিক বই। এজন্যে আমাদের কবিদের হাতে মরু অঞ্চলের লাইলি-মজনু হয়ে উঠেছে বাঙলার তরুণতরুণী।