কৃত্তিবাসের আত্মপরিচিতিটি চমৎকার। এটি পড়লে বোঝা যায় কবি কী রকম ছিলেন। নিজের সম্বন্ধে তাঁর ছিলো বড়ো বিশ্বাস; তিনি যে বড়ো কবি সে-সম্পর্কে তাঁর নিজের কোনো সন্দেহ ছিলো না। উনিশশতকের মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত কৃত্তিবাসকে উদ্দেশ করে বলেছেন, কৃত্তিবাস, কীর্তিবাস কবি।’ রাজদরবারে যাওয়া সম্পর্কে তিনি যা লিখেছেন, তার কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি :
পাটের চাঁদোয়া শোভে মাথার উপর।
মাঘ মাসে খরা পোয় রাজা গৌড়েশ্বর।।
দাণ্ডাই গিয়া আমি রাজ-বিদ্যমানে।
নিকটে যাইতে রাজা দিল হাতসানে।।…
নানা ছন্দে শ্লোক আমি পড়িনু সভায়।
শ্লোক শুনি গৌড়েশ্বর আমা পানে চায়।।
নানা মতে নানা শ্লোক পড়িলাম রসাল।
খুশি হৈয়া রাজা দিলা পুষ্পমালা।।…
পাত্রমিত্র সবে বলে শুন দ্বিজরাজে।
যাহা ইচ্ছা হয় তাহা চাহ মহারাজে।।
কারো কিছু নাহি লই করি পরিহার।
যথা যাই তথায় গৌরব মাত্র সারা।।
যত যত মহাপণ্ডিত আছয়ে সংসারে।
আমার কবিতা কেহ নিন্দিতে না পারে।।…
প্রসাদ পাইয়া বাহির হইলাম সত্বরে।
অপূর্ব জ্ঞানে ধায় লোক আমা দেখিবারে।।
চন্দনে ভূষিত আমি তোক আনন্দিত।
সবে বলে ধন্য ধন্য ফুলিয়া পণ্ডিত।।
মুনি মধ্যে বাখানি বাল্মীকি মহামুনি।
পণ্ডিতের মধ্যে কৃত্তিবাস গুণী।।
কবির স্নিগ্ধ মহান অহমিকার এমন প্রকাশ খুবই দুর্লভ। রাজা তাঁর কবিতায় মুগ্ধ হয়েছেন; রাজার পাত্রমিত্ররা কবিকে বলেছেন, তোমার যা ইচ্ছে তা তুমি চাইতে পারো রাজার কাছে। কিন্তু কবি কৃত্তিবাস কিছুই চান না, কবিতাই তাঁর গৌরব; তাই বললেন, কারো কিছু নাহি লই করি পরিহার। যথা যাই তথায় গৌরব মাত্র সার।’ কবির মহান ঔদ্ধত্যের প্রকাশরূপে পংক্তি দুটি অমর হয়ে আছে। কৃত্তিবাসের আত্মপরিচিতিটির এ-অংশ পড়লে বাঙলা ভাষার অন্য একটি সেরা কবিতার কথা মনে পড়ে। কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের ‘পুরস্কার’। ‘পুরস্কার’ কবিতাটি পড়লে মনে হয় রবীন্দ্রনাথের কবিতার নায়ক কৃত্তিবাস বা অন্যকালের কৃত্তিবাস রোম্যানটিক রবীন্দ্রনাথ।
‘পুরস্কার’ কবিতার নায়ক কবি। তিনি বাড়িতে বসে বসে শুধু কবিতা রচনা করেন। তাঁর হাঁড়িতে চাল নেই, মাথার ওপর ঘরের চাল পড়োপড়ো। কবির সে-দিকে দৃষ্টি নেই, তিনি মেতে আছেন কাব্যলক্ষ্মীকে নিয়ে। তাঁর কবিতা অসাধারণ, কিন্তু সেগুলোকে তিনি অর্থ উপার্জনের পণ্য হিশেবে ব্যবহার করেন না। একদিন কবির স্ত্রী অনেক বুঝিয়ে কবিকে রাজি করালেন রাজদরবারে যেতে। রাজা যদি খুশি হয় কবিতা শুনে, তবে আর কোনো অভাব থাকবে না সংসারে। রাজার কাছ থেকে অনেক ধন চেয়ে আনতে পারবেন কবি। স্ত্রীর কথায় কবিতা নিয়ে যান রাজদরবারে। রাজা কবিকে কবিতা শোনাতে বলে। কবি শোনান কালজয়ী অমর কবিতা। ওই কবিতার কয়েক স্তবক :
শুধু বাঁশিখানি হাতে দাও তুলি
বাজাই বসিয়া প্রাণমন খুলি,
পুষ্পের মতো সঙ্গীতগুলি
ফুটাই আকাশভালে।
অন্তর হতে আহরি বচন
আনন্দলোক করি বিরচন,
গীতরসধারা করি সিঞ্চন
সংসার ধূলিজালে।…
সংসার মাঝে কয়েকটি সুর
রেখে দিয়ে যাব করিয়া মধুর,
দু’একটি কাঁটা করি দিব দূর–
তার পরে ছুটি নিব।
আরো অনেক স্তবক শোনান কবি, রাজা হয় আনন্দে আত্মহারা। রাজা কবিকে কী দান করবে ভেবে পায় না। কবিকে রাজা বলেন, আমার ভাণ্ডারে যা আছে তা থেকে যা ইচ্ছে তুমি নিতে পারো, কবি। কবি কিন্তু কোনো ধন চাইলেন না, তিনি শুধু চাইলেন রাজার কষ্ঠের ফুলমালাখানি।
কৃত্তিবাস জন্মগ্রহণ করেছিলেন নদীয়ার ফুলিয়া গ্রামের এক বিখ্যাত পণ্ডিত পরিবারে। তাঁর পিতার নাম বনমালী। তিনি পদ্মা পেরিয়ে উত্তরে বরেন্দ্র অঞ্চলে গিয়েছিলেন বিদ্যালাভের জন্যে। সেখানে প্রচুর পড়াশুনো করার পর কৃত্তিবাস যান গৌড়ের রাজার কাছে। এ-রাজা রুকনুদ্দিন বারবক শাহ। তারপরে লিখেন রামায়ণ। বাল্মীকির রামায়ণকে তিনি অপূর্বরূপে বাঙলা ভাষায় রূপান্তরিত করেন। তাঁর রামায়ণের অন্য নাম হলো শ্রীরামপাঞ্চালি। বর্তমানে যে-কৃত্তিবাসী রামায়ণ প্রচলিত আছে, তাতে কৃত্তিবাসের রচনার আদিরূপ পাওয়া যায় না। কেননা তার পর কয়েক শো বছর অতীত হয়েছে, কৃত্তিবাসের জনপ্রিয় কাব্যে কালেকালে নতুন কবিরা নিজেদের রচনা গেঁথে দিয়েছেন। তাছাড়া সেকালে কবিতা লিখিত হতো খুব কম, সাধারণত গায়কেরা নিজেদের মুখেমুখে বাঁচিয়ে রাখতেন কবিতা। এভাবে এক গায়কের কণ্ঠ থেকে কবিতা চলে যেতো অন্য গায়কের কণ্ঠে, তাতে অনেক পংক্তি পরিবর্তিত হতো, কখনো কোনো অংশ হয়তো বাদ পড়তো, আবার নতুন কোনো অংশ তৈরি করে নিতেন গায়কেরা। কৃত্তিবাসের রামায়ণ বাঙলার সবচেয়ে জনপ্রিয় গ্রন্থে পরিণত হয়েছিলো। বাঙালি হিন্দুরা রামসীতার পুণ্যকাহিনী পড়ার জন্যে পাঁচশো বছর ধরে আর বাল্মীকির রামায়ণ খুলে ধরে না, তারা খুলে ধরে কৃত্তিবাসের রামায়ণ। কৃত্তিবাসের রামায়ণ ১৮০২ কিংবা ১৮০৩ সালে সর্বপ্রথম মুদ্রিত হয়। এটি ছেপেছিলেন শ্রীরামপুরের খ্রিস্টীয় পাদ্রিরা। এরপর ১৮৩০ সালে জয়গোপাল তর্কালঙ্কার কৃত্তিবাসের ভাষা বেশ মেজেঘষে নতুন করে কৃত্তিবাসী রামায়ণ মুদ্রিত করেন। এখন এ-বইটিই চলছে, এটিকেই অকৃত্রিম কৃত্তিবাসী রামায়ণ মনে করে ভক্তিতে আকুল মনে পাঠ করছে ভক্তরা।