রামায়ণ-মহাভারত শুধু ধর্মগ্রন্থ নয়। এ-দুটি বইয়ে রয়েছে নানা মনোহর কাহিনী। কাহিনীর মনোহারিত্বে মুগ্ধ হয়েছিলেন মুসলমান রাজারা, আর বারবার তাঁরা কবিদের উৎসাহ দিয়েছেন রামায়ণ-মহাভারত অনুবাদ করতে। রামায়ণ ও মহাভারতের দুজন অনুবাদক আজ প্রায় দেবতার মর্যাদা লাভ করেছেন। তারা হচ্ছেন রামায়ণের অনুবাদক কবি কৃত্তিবাস এবং মহাভারতের অনুবাদক কবি কাশীরাম দাস। এ-দুজন ছাড়াও আছেন আরো অনেক অনুবাদক, যাঁরা রামায়ণ-মহাভারত কবিতায় অনুবাদ করেছেন। তাঁদের সকলের রচনা আজ আর পড়া হয় না, কিন্তু প্রবল ভক্তিতে বাঙলার হিন্দুরা পড়ে কৃত্তিবাসের রামায়ণ, কাশীরামের মহাভারত। মধ্যযুগের কোনো অনুবাদই মূল রচনার হুবহু অনুবাদ নয়। কবিরা মূল কাহিনী ঠিক রেখে মাঝেমাঝে নিজেদের মনের কথাও বসিয়ে দিয়েছেন এখানেসেখানে। তাতে এগুলো অনুবাদ হয়েও নতুন রচনা হয়ে উঠেছে। তাই আজ আর বলি না যে কাশীরাম অনুবাদ করেছেন মহাভারত, কৃত্তিবাস অনুবাদ করেছেন রামায়ণ। বলি, বাঙলায় মহাভারত লিখেছেন কাশীরাম দাস এবং রামায়ণ রচনা করেছেন কৃত্তিবাস। বাঙলায় তাঁরা দুজন বাল্মীকি এবং বেদব্যাসের সমান।
মুসলমান রাজারা রামায়ণ-মহাভারত এবং অন্যান্য পুরাণকাহিনী অনুবাদের প্রেরণা দিয়েছিলেন কবিদের। তেমন কয়েকজন রাজার নাম বলছি। ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গৌড়ের রাজা ছিলেন নাসির খাঁ। তাঁর অনুপ্রেরণায় মহাভারতের একটি অনুবাদ হয়েছিলো। অবশ্য এ-বইটি পাওয়া যায় নি। কৃত্তিবাস অনুবাদ করেছেন রামায়ণ। কৃত্তিবাসকে প্রেরণা, উৎসাহ ও সাহায্য দিয়েছিলেন রুকনুদ্দিন বারবক শাহ [১৪৫৯–৭৪]। পরাগল খান কবীন্দ্র পরমেশ্বর নামক এক কবিকে দিয়ে অনুবাদ করেছিলেন মহাভারতের অনেকখানি। পরাগল খানের পুত্রের নাম ছিলো ছুটি খান। ছুটি খানের উৎসাহে শ্রীকর নন্দী নামক আরেকজন কবি অনুবাদ করেছিলেন মহাভারতের আরো অনেকখানি। এভাবে আরো অনেক মুসলমান রাজার নাম পাওয়া যায়, যাঁরা উৎসাহ দিয়েছিলেন এ-সব গ্রন্থ অনুবাদে। মুসলমান রাজারা রামায়ণ-মহাভারত অনুবাদে উৎসাহ দিয়েছিলেন নানা কারণে। তাঁরা গল্প শুনতে চেয়েছিলেন বলে উৎসাহ দিয়েছিলেন। তাঁরা হিন্দু প্রজাদের বশীভূত করতে চেয়েছিলেন বলে অনুবাদে উৎসাহ দিয়েছিলেন।
রামায়ণের প্রথম অনুবাদকই শ্রেষ্ঠ অনুবাদক; তাঁর নাম কৃত্তিবাস। মহাভারতের বেলা ঘটেছে অন্যরকম। কাশীরাম দাস মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক, তবে তিনি প্রথম অনুবাদক নন, বেশ পরবর্তী অনুবাদক। আমরা এখানে কৃত্তিবাস এবং কাশীরাম দাস সম্বন্ধেই বেশি কথা বলবো। তার আগে অন্যান্য অনুবাদকের কথা কিছুটা বলে নিই। কৃত্তিবাস ছাড়া আর যারা রামায়ণ অনুবাদ করেছিলেন, তাঁদের একজন চন্দ্রাবতী [জন্ম ১৫৫০]। চন্দ্রাবতী মনসামঙ্গলের কবি বংশীদাসের কন্যা। রামায়ণের আরো কয়েকজন অনুবাদকের নাম : ভবানীদাস, জগত্রাম রায়, রামমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রামানন্দ ঘোষ, দ্বিজ মধুকণ্ঠ, কবিচন্দ্র। মহাভারতের অনুবাদও করেছেন অনেক কবি। মহাভারতের প্রথম অনুবাদক শ্রীকর নন্দী। তিনি হোসেন শাহের সেনাপতি পরাগল খানের অনুপ্রেরণায় সর্বপ্রথম মহাভারত অনুবাদ করেন। মহাভারতের আরো কয়েকজন অনুবাদকের নাম : নিত্যানন্দ ঘোষ, রামেশ্বর নন্দী, রাজীব সেন, সঞ্জয়, রামনারায়ণ দত্ত, রাজেন্দ্র দাস। হিন্দুধর্মের একটি পবিত্র বই অনুবাদ করেছিলেন মালাধর বসু। বইটি ভাগবত। মালাধর বসুও একজন মুসলমান রাজার প্রেরণায় ভাগবত অনুবাদ করেছিলেন। সে-রাজা তাঁকে ‘গুণরাজ খান উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। মালাধর বসু লিখেছেন, “গৌড়েশ্বর দিলা নাম গুণরাজ খান। মালাধর বসুর ভাগবতের অন্য নাম শ্রীকৃষ্ণবিজয়।
বাঙলা রামায়ণ মানেই কৃত্তিবাসের রামায়ণ। এ-বই কয়েক শশা বছর ধরে বাঙলার হিন্দুদের ঘরেঘরে পরম ভক্তিতে পঠিত হচ্ছে। রামসীতার বেদনার কথা কৃত্তিবাস পয়ারের চোদ্দ অক্ষরের মালায় গেঁথে বাঙালির কণ্ঠে পরিয়ে গেছেন। রামায়ণ কৃত্তিবাসের হাতে বাঙলার সম্পদে পরিণত হয়েছে; বাল্মীকির অসীম বৃহৎ জগৎ বাঙলাদেশে পরিণত হয়েছে। রামসীতা এবং আর সবাই হয়ে পড়েছে কোমল কাতর বাঙালি। যে-কৃত্তিবাস এমন অসাধারণ কাজ করে গেছেন, তাঁকে নিয়ে কিন্তু সমস্যার অন্ত নেই। কৃত্তিবাস কখন জন্মগ্রহণ করেছিলেন, কোন রাজার আশীর্বাদ লাভ করেছিলেন, এ নিয়ে বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসে বেশ বড়ো এক বিতর্ক রয়েছে। আজ মনে করা হয় কবি কৃত্তিবাস তার আত্মপরিচিতিতে যে-রাজার ইঙ্গিত করেছেন, তার নাম রুকনুদ্দিন বারবক শাহ। কৃত্তিবাস পঞ্চদশ শতকের কবি। তাঁর একটি দীর্ঘ আত্মপরিচিতি পাওয়া গেছে। এ-আত্মপরিচিতিতে তিনি অনেক কথা বলেছেন; বেলা ক-টার সময় তিনি রাজার দরবারে গেলেন, তখন রাজা কী করছিলেন, তাঁর চারপাশে কারা ছিলেন, এসব তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু কবি শুধু রাজার নামটি বলতে ভুলে গেছেন! এমন হয়েছে তার জন্মকালের বিবরণ দিতে গিয়েও। কখন তাঁর জন্ম হলো, কারা তাঁর পূর্বপুরুষ, তার জন্মের সময় কোন তিথি ছিলো, তিনি সব বলেছেন। শুধু ভুলে গেছেন তাঁর জন্মের অব্দ বা সালটি উল্লেখ করতে! তাই কৃত্তিবাসকে নিয়ে মহাবিতর্ক, তিনি যেমন মহাকবি, তাঁকে নিয়ে বিতর্কটিও মহাকাব্যিক।