বাঙলা সাহিত্য সম্বন্ধে আরো একটি কথা মনে রাখার মতো। এ-সাহিত্য জন্ম থেকেই বিদ্রোহী; এর ভেতরে জ্বলছে বিদ্রোহের আগুন। কেননা এ-আগুন? বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য সমাজের উঁচুশ্রেণীর লোকের কাছে সহজে মর্যাদা পায় নি। এর জন্মকালে একে সহ্য করতে হয়েছে উঁচুশ্রেণীর অত্যাচার, উৎপীড়ন। দশম শতকে যখন বাঙলা সাহিত্য জন্ম নিচ্ছিলো, তখন সংস্কৃত ছিলো সমাজের উঁচুশ্রেণীর ভাষা, তারা সংস্কৃতের চর্চা করতো। ঠিক তখনি সংগোপনে সাধারণ লোকের মধ্যে জেগে উঠছিলো বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য। সাধারণ মানুষ একে লালনপালন করেছে বহুদিন। সমাজের উঁচুশ্রেণীর লোকেরা সব সময়ই হয় সুবিধাবাদী; যেখানে সুবিধা সেখানে তারা। তাই জন্মের সময় বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য তাদের ভালোবাসা পায় নি, পেয়েছে অত্যাচার। তারপরে মুসলমান আমলে এ-উঁচুশ্রেণী সংস্কৃতের বদলে সেবা করেছে ফারসির, এবং ইংরেজ রাজত্বে তারা আঁকড়ে ধরেছে। ইংরেজিকে। অথচ এরা ছিলো এদেশেরই লোক। তবে বাঙলা ভাষা বিদ্রোহী, অত্যাচারকে পরোয়া করে নি; নিজেকে প্রিয় করে তুলেছে সাধারণ মানুষের কাছে, সাধারণ মানুষের বুকের মধ্যে অগ্নিশিখার মতো জ্বলেছে। সাধারণ মানুষ একে নিজের রক্তের চেয়েও প্রিয় করে নিয়েছে, এবং একে ব্যবহার করেছে নিজেদের প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে। এর ফলে ভীত হয়েছে উঁচুশ্রেণী, এবং সব কিছুকে পরাজিত করে জয়ী হয়েছে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য।
বাঙলা সাহিত্যের বয়স এক হাজার বছরেরও বেশি। চর্যাপদ হচ্ছে বাঙলা সাহিত্যের প্রথম কাব্যগ্রন্থ বা গ্রন্থ। এটি রচিত হয়েছিলো দশম শতকের মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে [৯৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ]। এরপরে যুগে যুগে কবিরা, লেখকেরা এসেছেন; সৃষ্টি করে গেছেন বাঙলা সাহিত্য। আমরা আজকাল সাহিত্যে দুটি ভাগ দেখে থাকি; এর একটি কবিতা, আর একটি গদ্য, যে-গদ্যে লেখা হয় গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ নাটক আরো কত কী। বাঙলা সাহিত্যের একটি বিরাট অংশ কবিতা; ১৮০০ সালের আগে বাঙলা সাহিত্যে গদ্য বিশেষ ছিলোই না। এতোদিন ধরে রচিত হয়েছে কেবল কবিতা। কবিতায় লেখা হয়েছে বড়ো বড়ো কাহিনী, যা আজ হলে অবশ্যই গদ্যে লেখা হতো। ভাবতে কেমন লাগে না যে সেকালে কেউ গদ্যে লেখার কথা ভাবলেন না, সব কিছু গেঁথে দিলেন ছন্দে! সব সাহিত্যেরই প্রথম পর্যায়ে এমন হয়েছে। এর কারণ মানুষ কবিতার যাদুতে বিহ্বল হ’তে ভালোবাসে। সেই কবে যেদিন প্রথম সাহিত্যের আবির্ভাব ঘটেছিলো, সেদিন লেখকের বুকে তরঙ্গিত হয়ে উঠেছিলো ছন্দ। তখন মানুষ সাহিত্যে খোঁজ করতো তা, যা বাস্তব জীবনে পাওয়া যায় না। যে-ভাষায় তারা সারাদিন কথা বলতো, যে-গদ্যে ঝগড়া করতো, তাতে সাহিত্য হতে পারে একথা তারা ভাবতে পারে নি। তাই তারা বেছে নিয়েছিলো এমন জিনিশ, যা প্রতিদিনের ব্যবহারে মলিন নয়, যাতে ছন্দ আছে, সুর আছে। এমন হয়েছে সব দেশের সাহিত্যে; বাঙলা সাহিত্যেও। দশম শতক থেকে অষ্টাদশ শতকের শেষ পর্যন্ত বাঙলা সাহিত্য রচিত হয়েছে কবিতায়, বা পদ্যে।
লাল নীল দীপাবলি বাঙলা সাহিত্যের প্রধান সংবাদগুলো শোনাবে। সব সংবাদ শুনবে বড়ো হলে। তখন তোমাদের হাতে আসবে চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বা বৈষ্ণব পদাবলি। হাতে পাবে বাঙলা সাহিত্যের ঐতিহাসিকদের লেখা বড়ো বড়ো বইগুলো। রবীন্দ্রনাথ তখন তোমার হাতে হাতে ফিরবে; তোমার জন্যে কবিতা গল্প নাটক নিয়ে টেবিলে এসে হাজির। হবেন কবি মধুসূদন দত্ত, ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ঔপন্যাসিক শরৎ-বিভূতিমানিক-তারাশঙ্কর, কবি জীবনানন্দ-সুধীন্দ্রনাথ-বুদ্ধদেব, এবং আরো অনেকে। এবং আসবেন একালের লেখকেরা। তোমার চতুর্দিকে প্রদীপ, মাঝখানে তুমি বসে আছে। রাজা।
বাঙালি বাঙলা বাঙলাদেশ
একজন বাঙালি দেখতে কেমন? বাঙালিরা দেখতে ইংরেজের মতো ধবধবে শাদা নয়, নয় নিগ্রোর মতো মিশমিশে কালো। বাঙালিরা, অর্থাৎ আমরা, তুমি আমি এবং সবাই, আকারে হয়ে থাকি মাঝারি রকমের। আমাদের মাথার আকৃতি না-লম্বা না-গোল, আমাদের নাকগুলো তীক্ষ্ণও নয়, আবার ভোতাও নয়, এর মাঝামাঝি। উচ্চতায় আমাদের অধিকাংশই পাঁচ ফুটের ওপরে আর ছ-ফুটের নিচে। এ হচ্ছে বাঙালিদের সাধারণ রূপ। চারদিকে তাকালে এটা সহজে বোঝা যায়। আমাদের পূর্বপুরুষ কারা; আমরা কাদের বিবর্তনের পরিণতি? আমরা একদিনে আজকের এ-ছছাটোখাটো আকার, শ্যামল গায়ের রঙ লাভ করি নি। আমাদের পূর্বপুরুষ রয়েছে।
নৃতাত্ত্বিকেরা অনেক গবেষণা করে সিদ্ধান্তে এসেছেন আমাদের পূর্বপুরুষ হচ্ছে সিংহলের ভেড্ডারা। এরা অনেক আগে সারা ভারতে ছড়িয়ে ছিলো। আমাদের শরীরের রক্তে তাদের রক্ত রয়েছে বেশি পরিমাণে। তবে আমরা অজস্র রক্তধারার মিশ্রণ : আমাদের শরীরে যুগেযুগে নানা জাতির রক্ত এসে ভালোবাসার মতো মিশে গেছে। রবীন্দ্রনাথ ‘ভারততীর্থ’ কবিতায় বলেছিলেন, ভারতবর্ষে শক হুন মোগল পাঠান সবাই লীন হয়ে আছে। ঠিক তেমনি বাঙালির শ্যামল শরীরে ঘুমিয়ে আছে অনেক রক্তস্রোত। আমরা ভেড়াদের উত্তরপুরুষ। আদিবাসী সাঁওতাল, মুণ্ডা, মালপাহাড়ি, ওরাঁও এদের মধ্যেই শুধু নয়, নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে, এমনকি উচ্চবর্ণের হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যেও এদের উপাদান প্রচুর পাওয়া গেছে। ভেড়া রক্তধারার সাথে পরে মিলিত হয় আরো একটি রক্তধারা। এ-ধারাটি হলো মঙ্গোলীয়। মঙ্গোলীয়দের চোখের গঠন বড়ো বিচিত্র। তাদের চোখ বাদামি রঙের লাল আভামাখা, আর চোখের কোণে থাকে ভাঁজ। বাঙালিদের মধ্যে এরকম রূপ বহু দেখা যায়। এরপরে বাঙালির শরীরে মেশে আরো একটি রক্তধারা; এদের বলা হয় ইন্দো-আর্য। আর্যরা ছিলো সুদেহী, গায়ের রঙ গৌর, আকারে দীর্ঘ, আর তাদের নাক বেশ তীক্ষ। অনেক বাঙালির মধ্যে এদের বৈশিষ্ট্যও চোখে পড়ে।