বাঙলার জীবনে যেমন বাঙলা সাহিত্যেও তেমনি চৈতন্যদেবের প্রভাব অপরিসীম। অনেকটা তাঁকে কেন্দ্র করেই রচিত হয়েছে মধ্যযুগের গৌরব বিশাল বৈষ্ণব সাহিত্য। এসাহিত্যে আছে পদাবলি, আছে দর্শন, আছে জীবনীসাহিত্য। পদাবলির কথা আগেই বলেছি। বৈষ্ণব জীবনীসাহিত্যও মধ্যযুগের মূল্যবান সৃষ্টি, কেননা যে-মধ্যযুগ কেটেছে দেবতাদের গুণগানে, সেখানে বৈষ্ণবেরা বসিয়েছিলেন মানুষকে। দেবতার বদলে মানুষের প্রাধান্য বৈষ্ণব জীবনসাহিত্যের বড়ো বৈশিষ্ট্য।
আজকাল যেভাবে জীবনী রচিত হয়, বৈষ্ণবজীবনী তেমনভাবে রচিত হয় নি। এখন আমরা মানুষকে মানুষ হিশেবেই দেখতে ভালোবাসি, মানুষকে দেবতা করে তুলি না। মধ্যযুগে এটা সম্ভব ছিলো না। এ-জীবনীগুলো যারা রচনা করেছিলেন, তাঁরা ছিলেন ভক্ত। চৈতন্যদেবের ভক্তের চোখে চৈতন্যদেব সাধারণ মানুষ নন, তিনি অবতার। তাই এজীবনীসমূহে মানুষ অনেক সময় দেবতা হয়ে উঠেছেন। এখানে অবলীলায় স্থান পেয়েছে অলৌকিক ঘটনা, যেগুলোকে তাঁরা সত্যি বলে ভাবতেন। আজকের চোখে নিছক কল্পনা, কিন্তু সেকালে তারা এগুলোকে অবিশ্বাস্য বলে অবহেলা করতে পারেন নি। তবু এজীবনীগুলো বড়ো মূল্যবান। জীবনীগুলোতে সেকালের পরিচয় আছে, আছে সে-সময়ের সমাজের চিত্র। আর যাঁর জীবনকাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে, তাঁকেও আমরা অনেক সময় পাই মানুষ হিশেবে।।
চৈতন্যদেবের মৃত্যুর অল্প পরে তাঁর দুটি জীবনীগ্রন্থ লেখা হয় সংস্কৃত ভাষায়। বাঙলা ভাষায় প্রথম চৈতন্যদেবের যে-জীবনী লেখা হয়, তার নাম চৈতন্যভাগবত। যিনি লেখেন, তাঁর নাম বৃন্দাবন দাস [? ১৫০৭–১৫৮৯]। এটি লেখা হয়েছিলো চৈতন্যদেবের মৃত্যুর পনেরো বছরের মধ্যে। বৃন্দাবন দাসকে এ-গ্রন্থ লেখার প্রেরণা দিয়েছিলেন নিত্যানন্দ প্রভু। এ-গ্রন্থের ঘটনাগুলো তিনি শুনেছিলেন চৈতন্যের সহচরদের মুখে, আর তাকেই তিনি কাব্যরূপ দান করেন। এর মধ্যে অনেক অলৌকিক ঘটনাও আছে। এ-বইটি বিশাল।
বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত-এর পরে চৈতন্যদেবের আরো একটি জীবনী রচনা করেন লোচন দাস [১৬শ শতকে]। এ-বইয়ের নাম চৈতন্যমঙ্গল। এটি চৈতন্যভাগবত-এর চেয়ে ছোটো বই। চৈতন্যদেবের জীবনী হিশেবে যে-বই সবচেয়ে বিখ্যাত, তার নাম চৈতন্যচরিতামৃত। এ-বইয়ের লেখক কৃষ্ণদাস কবিরাজ [১৫৩০–১৬১৫]। এ-বইটিতে চৈতন্যদেবের জীবনী বর্ণনার সাথে সাথে ব্যাখ্যা করা হয়েছে তাঁর দর্শন। কাব্য হিশেবেও এটি চমৎকার। নানা যুক্তির সাহায্যে কৃষ্ণদাস এ-বইতে বৈষ্ণব দর্শন ব্যাখ্যা করে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। তাঁর বর্ণনা সহজ সরল, তবে মাঝেমাঝে কবি চমৎকার উপমারূপক ব্যবহার করেছেন কঠিন তত্ত্ব ব্যাখ্যা করার জন্যে। রাধাকৃষ্ণ তত্ত্ব বোঝানোর জন্যে তিনি বলেন :
মৃগমদ তার গন্ধে যৈছে অবিচ্ছেদ।
অগ্নি জ্বালাতে যৈছে নাহি কভু ভেদ।।
লীলারস আস্বাদিতে ধরে দুইরূপ।
রাধাকৃষ্ণ ঐছে সদা একই স্বরূপ।।
কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজ ছিলেন ভক্ত। বর্ধমানে কাটোয়ার কাছে ঝামটপুরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কাব্যে নিজের সম্বন্ধে যে-বিনীত ভাষণ করেছেন, তা শোনার মতো:
আমি অতি ক্ষুদ্র জীব পক্ষী রাঙাটুনি।
সে যৈছে তৃষ্ণার পিয়ে সমুদ্রের পানি।।
তৈছে এক কণা আমি ছুঁইল লীলার।
এই দৃষ্টান্ত জানিহ প্রভুর লীলার বিস্তার।
আমি লিখি এই মিথ্যা করি অভিমান।
আমার শরীর কাষ্ঠপুতুলী সমান।।
এর পরে জয়ানন্দ [জন্ম? ১৫১২] রচনা করেন চৈতন্যমঙ্গল। চৈতন্যদেবের জীবনী ছাড়া বৈষ্ণব ধর্মের আর যারা প্রধান ব্যক্তি ছিলেন, তাঁদের জীবন নিয়েও বেশ কিছু বই লেখা হয়েছে। অদ্বৈত আচার্য ছিলেন এমন এক ব্যক্তি। কৃষ্ণদাস তাঁর বাল্যকালের কথা লেখেন সংস্কৃত ভাষায়, বইটির নাম বাল্যলীলাসূত্র। পরে শ্যামানন্দ বইটি বাঙলা ভাষায় অনুবাদ করেন অদ্বৈতত্ত্ব নামে। তাঁর সম্বন্ধে লেখা আরেকটি বইয়ের নাম অদ্বৈতপ্রকাশ। কেবল অদ্বৈতকে নিয়েই জীবনীগ্রন্থ রচিত হয় নি, তাঁর স্ত্রী সীতাদেবীকে নিয়েও জীবনীগ্রন্থ লেখা হয়েছে। সীতা দেবীর একটি জীবনী রচনা করেছেন বিষ্ণুদাস আচার্য, নাম “সীতাগুণকদম্ব”। আরেকটি জীবনী রচনা করেন লোকনাথ দাস, নাম সীতাচরিত।
এ-সমস্ত বই রচিত হয়েছিলো যোড়শ শতকে। সপ্তদশ শতকে জীবনীর বিষয়বস্তু অন্যরকম হয়ে দাঁড়ায়। এতোদিন যে-সকল জীবনী রচিত হয়, সেগুলো প্রধানত চৈতন্যদেব ও অদ্বৈত আচার্যের এবং তাঁর স্ত্রীর জীবনী। সপ্তদশ শতাব্দীতে বৈষ্ণব জীবনী সাহিত্যের নায়ক হয়ে ওঠেন শ্রীনিবাস ও নরোত্তম। এসব গ্রন্থের একটি হচ্ছে নিত্যানন্দ দাসের প্রেমবিলাস। গুরুচরণ দাস রচনা করেন নিবাস ও তাঁর পুত্রের বাল্যজীবনী, নাম প্রেমামৃত। বৈষ্ণব জীবনীগুলোর মূল্য অশেষ।
দেবতার মতো দুজন এবং কয়েকজন অনুবাদক
কোনো ভাষা শুধু মৌলিক সাহিত্যে সমৃদ্ধ হতে পারে না। যে-ভাষা যতো ধনী, তার অনুবাদ সাহিত্যও ততো ধনী। আমাদের ভাষায় যা নেই, তা হয়তো আছে জর্মন ভাষায় বা ফরাশি ভাষায়। তাই আমাদের ভাষাকে আরো ঋদ্ধ করার জন্যে আমরা অপর ভাষা থেকে অনুবাদ করি। বাঙলা সাহিত্যের মধ্যযুগে কবিরা অনুবাদে হাত দিয়েছিলেন, তাঁরা অনুবাদের আশ্চর্য ফসল ফলিয়েছিলেন। হিন্দু কবিরা সাধারণত অনুবাদ করেছেন তাঁদের পুরাণ কাহিনীগুলো; মুসলমান কবিরা অনুবাদ করেছেন ফারসি, হিন্দি থেকে রোমাঞ্চকর উপাখ্যান। এখানে হিন্দু কবিদের কথা বলবো। তাঁরা পুরাণ কাহিনী অনুবাদ করেছেন, অনুবাদ করেছেন রামায়ণ ও মহাভারত। রামায়ণ ও মহাভারত অনুবাদ করা সহজ কথা ছিলো না। সমাজের ধর্মের যারা ছিলেন মাথা, তাঁরা বাঙলা ভাষায় এসব গ্রন্থের অনুবাদের ভীষণ বিরোধী ছিলেন। তাঁরা মনে করতেন সংস্কৃত থেকে ওসব পুণ্যগ্রন্থ যদি অনূদিত হয় বাঙলায়, তবে ধর্মের মর্যাদাহানি হবে। এ-রকম কিন্তু হয়েছে সব দেশেই। ইংরেজিতে বাইবেল অনুবাদ করতে গিয়ে অনেক বাধার মুখোমুখি হয়েছিলেন অনুবাদকেরা। জর্মন ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করেছিলেন মার্টিন লুথার। তাঁকেও অনেক বিরোধিতা সহ্য করতে হয়েছিলো। বাঙলা ভাষায় কোরান অনুবাদ করতে গিয়েও কম বাধা আসে নি। তাই মধ্যযুগে কবিরা যখন বাঙলা ভাষায় রামায়ণ-মহাভারত অনুবাদ করতে যান, তখন তাদের সামনে মাথা তুলে দাঁড়ায় অনেক বাধা। কবিরা সে-সব বাধা অবহেলা করেছেন। কবিদের অনুপ্রেরণা দিয়েছেন তখনকার মুসলমান সম্রাটরা। মুসলমান সম্রাটদের উৎসাহে বাঙলা ভাষায় রামায়ণ-মহাভারত অনূদিত হতে পেরেছিলো। অনুবাদ সাধারণত করেছেন হিন্দু কবিরা। এ-অনুবাদ কাজে তাঁরা মুসলমান সম্রাটদের সহায়তা পেয়েছেন বলে তারা সম্রাটদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।