বড় চণ্ডীদাস আমাদের প্রথম মহাকবি। তাঁর একটি কাব্য পাওয়া গেছে; নাম শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। এটি এক দীর্ঘ কাব্য, অনেকগুলো পদ বা কবিতার সমষ্টি। বড়ু চণ্ডীদাস কাহিনী বলার ও আবেগ প্রকাশের অসাধারণ ক্ষমতা রাখেন। তাঁর কবিতা থেকে কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি :
কে না বাঁশী বা বড়ায়ি কালিনী নইকুলে।
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে।।
আকুল শরীর মোর বেআকুল মন।
বাঁশীর শবদে মো আউলাইলোঁ রান্ধন।।
কে না বাঁশী বা বড়ায়ি সে না কোন জনা।
দাসী হআঁ তার পাএ নিশিবোঁ আপনা।।…
অঝর ঝর মোর নয়নের পাণী।
বাঁশীর শবদেঁ বড়ায়ি হারায়িলোঁ পরাণী।
দ্বিজ চণ্ডীদাস জন্মগ্রহণ করেছিলেন চতুর্দশ শতকের শেষভাগে, বীরভূম জেলার নানুর গ্রামে। তিনি ছিলেন বাশুলীদেবীর ভক্ত। তাঁর সম্বন্ধে অনেক উপকথা প্রচলিত আছে। এউপকথাগুলোর মধ্যে সত্য কতোটুকু আছে তা আজ আর যাচাই করে দেখা সম্ভব নয়, তবে এসব থেকে বুঝতে পারি কবি হিশেবে তিনি লাভ করেছিলেন অসীম জনপ্রিয়তা। তার সহজ সরল কথার তীব্র আবেগ বাঙলাদেশকে আকুল করে তুলেছিলো। বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক চৈতন্যদেব পাগলের মতো জপ করতেন চণ্ডীদাসের পদাবলি।
চণ্ডীদাসের জনপ্রিয়তার কারণ তাঁর রাধা। রাধার আবেগ, আচরণ, সকাতর হৃদয় এতো মোহনীয় যে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। রাধা মানবীরূপে মানুষের হৃদয়ের আবেগ। মানুষের হৃদয়ের আকুলতা তার মধ্যে রূপ লাভ করছে। রাধার সব আবেগ ও কাতরতা কৃষ্ণের জন্যে। কৃষ্ণের নাম শুনেই রাধা কৃষ্ণের জন্যে অধীর হয়, সব সময় সে কৃষ্ণের কথা ভাবে, সব কিছুতে সে দেখতে পায় সুন্দর কৃষ্ণকে। আকাশের মেঘ, যমুনার নীল জল, ময়ূরের কণ্ঠের উজ্জ্বল রঙে রাধা খুঁজে পায় শ্যাম বা কৃষ্ণকে। চণ্ডীদাস জটিল নন, অনেক ভেবে তিনি কবিতা রচনা করেন না। অতি সহজে এতো গভীর কথা তিনি বলেন যে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। চণ্ডীদাসের একটি সকাতর পদের কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি :
বহু দিন পরে বধুয়া এলে।
দেখা না হইত পরাণ গেলে।।
এতেক সহিল অবলা বলে।
ফাটিয়া যাইত পাষাণ হ’লে।।
দুখিনীর দিন দুখেতে গেল।
মথুরা নগরে ছিলে ত ভাল।।
এই সব দুখ কিছু না গণি।
তোমার কুশলে কুশল মানি।।
চণ্ডীদাসের কবিতা স্বতস্ফূর্ত কোমল আবেগের প্রকাশ, গীতিময় ও অন্তরঙ্গ। অনেকটা দীর্ঘশ্বাসের মতো। চণ্ডীদাসের ভাষাও সহজ সরল, তাঁর আবেগের মতো নিরাভরণ। তাঁর পদ অরণ্যের নির্জন পুষ্পের মতো চিরস্নিগ্ধ, গোপন সুবাস বিলিয়ে চলছে শতাব্দীর পর শতাব্দী।
চৈতন্য ও বৈষ্ণবজীবনী
চৈতন্যদেব এক অক্ষরও কবিতা লেখেন নি, তবু তিনি বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসে অধিকার করে আছেন বড়ো স্থান। বাঙলা সাহিত্যে তার প্রভাব অসীম। তিনি মধ্যযুগের বাঙলাদেশে জাগিয়েছিলেন বিশাল আলোড়ন, তাতে অনেকখানি বদলে গিয়েছিলো বাঙলার সমাজ ও চিন্তা ও আবেগ। তিনি সাহিত্যে যে-আলোড়ন জাগান, তা তো তুলনাহীন। মধ্যযুগের সমাজ ছিলো সংস্কারের নিষ্ঠুর দেয়ালে আবদ্ধ, চৈতন্যদেব তার মধ্যে আনেন আকাশের মুক্ত বাতাস। তিনি প্রচার করেন ভালোবাসার ধর্ম, যাকে বলা হয় বৈষ্ণব ধর্ম। এর ফলে মধ্যযুগের মানুষ লাভ করে কিছুটা মানুষের মর্যাদা; এবং মধ্যযুগের কবি বলেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। চৈতন্যদেবের আবির্ভাবে বাঙলার জীবনে, সমাজে এসেছিলো জাগরণ। এর ফলেই বাঙলা সাহিত্য ফুলেফুলে ভরে ওঠে।
চৈতন্যদেব প্রেমের অবতার। তাঁর সম্পর্কে গভীর আবেগে দীনেশচন্দ্র সেন লিখেছেন যে প্রেম পৃথিবীতে একবার মাত্র রূপ গ্রহণ করেছিলো, তা বাঙলাদেশে। তাঁর কথায় যেমন আছে আবেগ, তেমনি রয়েছে সত্য। চৈতন্যদেব জন্মেছিলেন ১৪৮৬ অব্দে নবদ্বীপে। তাঁর পিতার নাম জগন্নাথ মিশ্র; মায়ের নাম শচীদেবী। ভালোবেসে চৈতন্যদেবকে মানুষ নানা নামে ডাকে। তাঁর আসল নাম ছিলো বিশ্বম্ভর, ডাক নাম নিমাই। তাঁর গায়ের রঙ ছিলো গৌরবর্ণ, তাই তার আরেক নাম গৌরাঙ্গ, সংক্ষেপে গোরা। বাল্যে চৈতন্য ছিলেন যেমন দুষ্ট, তেমনি মেধাবী। বেশ ভালোভাবে পড়াশুনা করে যৌবনেই চৈতন্য পণ্ডিত হিশেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। ছাত্রদের পড়ানোর জন্যে একটি ইস্কুল খোলন তিনি। কিন্তু বেশিদিন তা চলে নি। একবার গয়া যান চৈতন্য। সেখানে দেখা পান ঈশ্বরপুরীর এবং দীক্ষা গ্রহণ করেন তাঁর কাছে। এরপরে গোরা হয়ে ওঠেন শ্রীচৈতন্য। তিনি নিজেকে বিলিয়ে দেন ভগবত প্রেমে, মেতে ওঠেন হরিসংকীর্তন এবং ভগবতপাঠে। এরপর সারাজীবন কেটেছে তাঁর কৃষ্ণপ্রেমে। তিনি প্রচার করেছেন প্রেম। তাঁর অপূর্ব ধর্মে ধীরেধীরে এসে যোগ দিয়েছে প্রেমপাগল মানুষেরা। চৈতন্যদেব কৃষ্ণপ্রেমকে জীবনের সারকথা বলে মেনে নিয়েছিলেন। সেখানে মানুষে মানুষে কোনো ভেদ নেই, সবাই সমান। এ যে কতো বড়ো ঘোষণা, তা মধ্যযুগের পটভূমি ছাড়া বোঝা কঠিন। তখন মানুষে মানুষে ছিলো সীমাহীন প্রভেদ, এমনকি ধর্মেও সকলের অধিকার ছিলো না। এ-সময়েই শ্রীচৈতন্য বলেন, মুচি হয়ে শুচি হয় যদি কৃষ্ণ ভজে। এ-ঘঘাষণা মানুষকে বিরাট মূল্য দেয়। চৈতন্যদেব বেশিদিন বাঁচেন নি; মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৫৩৩ সালে তিনি পুরীতে প্রাণত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যু সম্বন্ধে নানা অলৌকিক গল্প প্রচলিত আছে। কেউ বলেন, তিনি পুরীতে কৃষ্ণপ্রেমে এতো পাগল ছিলেন যে সমুদ্রের নীল জলকে তার মনে হয়েছিলো কৃষ্ণ। কৃষ্ণ মনে করে তিনি সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণত্যাগ করেন। আবার কেউ বলেন, রথযাত্রার সময়ে তিনি নামকীর্তন করে নাচছিলেন, তখন তাঁর গায়ে আঘাত লাগে। তাতেই তিনি মারা যান।