গোবিন্দদাসের ভাষাটি একটু কঠিন, কিন্তু এর ভেতরে আছে সৌন্দর্য। কবি এখানে রাধার বর্ণনা দিচ্ছেন। রাধা খুব সুন্দর, তা সবাই জানি; কবি সে-সৌন্দর্য কী রকম, তা বলছেন। রাধা তার সখীদের সাথে যাচ্ছে। কবি বলছেন, রাধার শরীর থেকে যেখানে ছলকে পড়ছে সৌন্দর্য, সেখানে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। যেখানে রাধা রাখছে তার আলতারাঙানো পা, সেখানেই যেনো রাধার পা থেকে ঝরে পড়ছে স্থলপদ্মের লাল পাপড়ি। এমন অনেক সুন্দর বর্ণনা আছে বৈষ্ণব কবিতায়। বৈষ্ণব কবিতা মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবিতা।
বিদ্যাপতি
বিদ্যাপতি ছিলেন রাজসভার মহাকবি। রাজার নাম শিবসিংহ, রাজার রাজধানীর নাম মিথিলা। বিদ্যাপতি বাঙলা ভাষায় একটি কবিতা লিখেন নি, তবুও তিনি বাঙলা ভাষার কবি। বিদ্যাপতি লিখতেন ব্রজবুলি নামক একটি বানানো ভাষায়। এ-ভাষাটিতে আছে হিন্দি শব্দ, আছে বাঙলা শব্দ এবং আছে প্রাকৃত শব্দ। বিভিন্ন শ্রেণীর শব্দ মিলে অবাককরা এক মধুর ভাষা ব্রজবুলি। এ-ভাষাতে বৈষ্ণব কবিতা রচনা করেছেন কবি বিদ্যাপতি। কবি বিদ্যাপতি বেঁচে ছিলেন পঞ্চদশ শতকে। তখন মিথিলা ছিলো জ্ঞান ও সাহিত্যচর্চা কেন্দ্র। সেকালের বাঙলার ছেলেরা জ্ঞানার্জনের জন্যে যেতো মিথিলায়, আর বুক ভরে নিয়ে আসতো বিদ্যাপতির মধুর কবিতাবলি। এভাবে বিদ্যাপতির কবিতা হয়েছে বাঙলা কবিতা এবং বিদ্যাপতি হয়েছেন বাঙলার কবি। বিদ্যাপতিকে ছাড়া বৈষ্ণব কবিতার কথা ভাবাই যায় না। বিদ্যাপতি শুধু ছোটোছোটো বৈষ্ণব কবিতার মালা রচনা করেন নি, তাঁর আরো অনেক গ্রন্থ আছে। তিনি সংস্কৃত ভাষায় রচনা করেন পুরুষপরীক্ষা নামে একটি বই। বিদ্যাপতির এ-জাতীয় আরো কয়েকটি বই : কীর্তিলতা, গঙ্গাবাক্যাবলী, বিভাগসার। কবির রচনায় মোহিত হয়েছিলো তাঁর রাজা শিবসিংহ। এজন্যে সে বিদ্যাপতিকে একটি চমৎকার উপাধিতে ভূষিত করে। উপাধিটি হলো কবিকণ্ঠহার।
বিদ্যাপতি আমাদের প্রিয় তাঁর অতুলনীয় বৈষ্ণব কবিতাগুলোর জন্যে। একবিতাগুলোর ভাব-ভাষা-প্রকাশরীতি মোহনীয়। কবি বিদ্যাপতি আবেগে ভেসে যেতেন না চণ্ডীদাসের মততা, তিনি তাঁর ভাবকে পরিয়ে দিতেন সুন্দর ভাষা এবং ভাষাকে সাজিয়ে দিতেন শোভন অলঙ্কারে। উপমা-রূপক তিনি ব্যবহার করেন কথায় কথায়, তাঁর উপমারূপক ঝাড়লণ্ঠনের মতো আলো দেয় কবিতা ভরে। আধুনিক কালে এক কবি বলেছেন, উপমাই কবিত্ব। অনেকে বলেন, রূপকই কবিত্ব। এ-কথার সত্যতা আমরা বুঝতে পারি বিদ্যাপতির কবিতা পড়লে। বিদ্যাপতির একটি ছোটো কবিতা উদ্ধৃত করছি। কবিতাটিতে রাধা বলছে কৃষ্ণ তার কে হয়। একথা বোঝাতে রাধা অবিরাম সাহায্য নিচ্ছে রূপকের। একটি রূপকের পর ব্যবহার করছে আরেকটি রূপক, এবং পরে আরেকটি, এবং আরো আরো। পদটি হয়ে উঠেছে রূপকের দীপাবলি। কবিতাটি :
হাথক দরপণ মাথক ফুল।
নয়নক অঞ্জন মুখক তাম্বুল।।
হৃদয়ক মৃগমদ গীমক হার।
দেহক সরবস গেহক সার।।
পাখীক পাখ মীনক পানি।
জীবক জীবন হাম তুহু জানি।।
তুহু কৈসে মাধব কহ তুহু মোয়।
বিদ্যাপতি কহ পুঁহু দোঁহা হোয়।।
কবিতাটিতে রাধা ভালোভাবে জানতে চাইছে কৃষ্ণ তার কে হয়? তখন রাধা বসে কাব্যিক হিশেবনিকেশে। রাধার মনে হয় কৃষ্ণ তার হাতের আয়না, যাতে সে নিজেকে। দেখে থাকে। তারপর মনে হয় কৃষ্ণ তার মাথার ফুল, যা তার শোভা বাড়িয়ে দেয়। তারপর বলতে থাকে এভাবে—তুমি আমার চোখের কাজল, মুখের লাল পান। তুমি আমার হৃদয়ের সৌরভ, গ্রীবার অলঙ্কার। তুমি আমার শরীরের সর্বস্ব, আমার গৃহের সার। পাখির যেমন থাকে পাখা এবং মাছের যেমন জল, তুমি ঠিক তেমনি আমার। রাধা বলছে, প্রাণীরা যেমন জানে নিজেদের প্রাণকে তুমি ঠিক তেমনি আমার। এততা ব’লেও তৃপ্তি হয় না রাধার, কেননা এখনো সে বুঝতে পারে নি পরম পুরুষ কৃষ্ণ তার কে হয়। তাই শেষ চরণের আগের চরণে কৃষ্ণকেই জিজ্ঞেস করে, বললা প্রভু তুমি আমার কে? উত্তরটি দেন। কবি বিদ্যাপতি নিজে। কবি বলেন, তোমরা দুজনে অভিন্ন। চমৎকার নয়? বিদ্যাপতির কল্পনা অসাধারণ ভাষা লাভ করেছে। এ-রকম ভালো তাঁর সব কবিতাই, পড়তে পড়তে মন ভরে যায়।
আরেকটি আনন্দের অসাধারণ কবিতার কথা বলি। কবিতাটির বিষয় হলো বহুদিন পর, বহু নিশীথের পর কৃষ্ণ ফিরে এসেছে রাধার কাছে। রাধার আনন্দ আর ধরে না, কেননা এতোদিনে তার বেদনার দিন ফুরোলো। কৃষ্ণ কাছে ছিলো না বলে আগে রাধার চাঁদের আলো ভালো লাগে নি, চন্দনের শীতল ছোঁয়াকে মনে হয়েছে বিষের মতো। কৃষ্ণ এসেছে, রাধার মন আনন্দে তাই নাচছে রঙিন ময়ূরের মতো। তাই রাধা বলছে :
আজু রজনী হম ভাগে গমাওল।
পেখল পিয়া মুখ চন্দা।
জীবন যৌবন সফল করি মানল
দশদিশ ভেল নিরন্দা।
আজু মঝু গেহ গেহ করি মানল
আজু মঝু দেহ ভেল দেহা।…
সোই কোকিল অব লাখ ডাকউ
লাখ উদয় করুচন্দা।
অর্থাৎ অনেক ভাগ্যে আজ আমার রাত পোহালো; দেখলাম প্রিয়মুখ। আমার জীবন আজ সফল, দশদিক এখন আনন্দময়। আজ আমার গৃহ হলো গৃহ, দেহ হলে দেহ। এখন কোকিল ডাকুক লাখে লাখে, লাখে লাখে উদয় হোক চাঁদ।
চণ্ডীদাস
চণ্ডীদাস বাঙলা কবিতার একজন শ্রেষ্ঠ কবি। তাঁর হৃদয় ভরা ছিলো অসাধারণ আবেগে, এতো আবেগ রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কোনো বাঙালি কবির নেই। তাঁর কবিতা পড়ার অর্থ হলো আবেগের স্রোতে ভেসে যাওয়া। তবে এ-আবেগ বানানো নয়, ফিকে নয়; টসটসে তাঁর আবেগ। তিনি আবেগকে ঠিক ভাষায় সাজিয়ে দিতে পেরেছেন। এ-মহাকবিকে নিয়ে এক বড়ো সমস্যা আছে বাঙলা সাহিত্যে। সমস্যাটি বিখ্যাত চণ্ডীদাস-সমস্যা’ নামে। আমরা চণ্ডীদাস নামের বেশ কয়েকজন কবির কবিতা পেয়েছি। তাদের কারো নাম বড় চণ্ডীদাস, কারো নাম দ্বিজ চণ্ডীদাস, কারো নাম দীন চণ্ডীদাস। এজন্যে প্রশ্ন উঠেছে কজন চণ্ডীদাস ছিলেন আমাদের? এ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। আজকাল মনে করা হয় তিনজন চণ্ডীদাস আছেন আমাদের : একজনের নাম বড় চণ্ডীদাস, আরেকজনের নাম দীন চণ্ডীদাস, এবং অন্যজনের নাম দ্বিজ চণ্ডীদাস। এখানে দ্বিজ চণ্ডীদাসের কথা বলছি।