বৈষ্ণব কবিতা আকারে ছোটো; এ-কবিতায় জীবনের সমস্ত মোটা কথা পরিহার করে ঘেঁকে তোলা হয়েছে মনের আবেগের সারটুকু। তাই এখানে পাওয়া যায় মানুষের দুঃখের এবং আনন্দের সারসত্তা। রাধার আনন্দ, রাধার বেদনায় আমরা নিজেদের আনন্দবেদনাকে পাই। মধ্যযুগে এ-কাজটি করতে পেরেছিলেন বৈষ্ণব কবিরা। বৈষ্ণব কবিরা ছিলেন অতিশয় সৌন্দর্যচেতন। সেকালে তাঁরা সৌন্দর্যের যে-সূক্ষ্ম বর্ণনা দিয়েছেন, তা বিস্ময়কর। রাধা বা কৃষ্ণের সৌন্দর্য বর্ণনার কালে, বা তমালের একটি শাখা বর্ণনার কালে, অথবা যমুনার নীলজলের কথা বলার সময় তারা পৃথিবীকে স্বপ্নলোকে পরিণত করেছেন। তাঁদের সাথে তুলনা করা যায় শুধু আর একজন কবিকে, তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ যদি মধ্যযুগে জন্ম নিতেন, তবে তিনি হতেন একজন বৈষ্ণব কবি।
অপূর্ব এ-সব কবিতার উপমা; অতুলনীয় এগুলোর ছবি। ভাষার ওপর তাঁদের অধিকার ছিলো বিধাতার মতো; তারা বেছে নিয়েছিলেন বাঙলা ভাষার সে-সব শব্দ, যা মনোহর, মায়াবী, স্বপ্নের মতো। তাই বিদ্যাপতির কবিতা, চণ্ডীদাসের কবিতা আমাদের আকুল করে তোলে। তারা যখন উপমা দেন মনে হয় এ-রকম আর হয় না; তাঁরা যখন হৃদয়াবেগ প্রকাশ করেন তাতে আমরা আবেগাতুর হয়ে পড়ি। বিদ্যাপতি কবিতা রচনা করতেন ব্রজবুলি নামক এক ভাষায়। এটি বাঙলা ভাষা নয়, আবার একে অবাঙলাও বলা যায় না। এতে সামান্য কৃত্রিমতা আছে, তবে এতে আছে সুমধুর ধ্বনি, সুর; তাই এতে মুগ্ধ হয়ে থাকা যায় না। বিদ্যাপতির একটি পদ তুলে আনছি এখানে, যার ভাষা আর কল্পনার মধুরতায় বিভোর হতে হয় :
যব—গোধূলি সময় বেলি।
ধনি–মন্দির বাহির ভেলি।।
নব জলধর বিজুরি রেহা
দ্বন্দ্ব পসারি গেলি।।
ধনি–অল্প বয়েসী বালা।
জনু–গাঁথনি পুহপ-মালা।।
ভাষাটি বুঝতে একটু কষ্ট হচ্ছে হয়তো। কিন্তু একবার বুঝে ফেললে উল্লসিত হ’তে হবে। রবীন্দ্রনাথ বাল্যকালে এ-ভাষার যাদুতে এতো মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি এ-ভাষা শিখে অনেক কবিতা লিখেছিলেন। এ-ভাষার নামই ব্রজবুলি। এ-ভাষায় কোনো অমধুর শব্দ নেই। কঠিন শব্দ নেই। যে-সকল শব্দ উচ্চারণ করলে শুনতে ভালো লাগে না, তাদের বলে এখানে সুন্দর করা হয়। এজন্যে ব্রজবুলি খুব মিষ্টি, সুরময়, গীতিময় ভাষা। ওপরের অংশে এজন্যে ‘বেলা হয়েছে ‘বেলি’, ‘বিদ্যুৎ’ হয়েছে ‘বিজুরি’, ‘রেখা হয়েছে ‘রেহা’। কবি রাধার বর্ণনা দিচ্ছেন কবিতাটিতে। রাধা খুব রূপসী, তখন গোধূলি বেলা। কবি বলছেন, যখন গোধূলি বেলা, তখন রাধা ঘর থেকে বাইরে এলো। সে এক অপরূপ দৃশ্য। কবি রাধার বাইরে আসার দৃশ্যকে একটি উপমা দিয়ে বুঝিয়েছেন। বলছেন, হঠাৎ যেন মেঘের কোলে বিদ্যুৎ চমকে গেলো। তারপর বলছেন, রাধা অল্প বয়সের মেয়ে। কিন্তু কেমন মেয়ে? যেনো ফুলের গাঁথা মালা।
সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে বৈষ্ণব কবিতায় যেমন শিউলি ভোরের বেলা ছড়িয়ে থাকে শিউলি বনের অঙ্গনে। এ-কবিতায় ঢল ঢল কাঁচা অঙ্গের লাবণ্যে বিশ্ব ভেসে যায়। কৃষ্ণ এখানে সৌন্দর্য ছড়ায়, রাধা এ-কবিতায় সৌন্দর্যের দেবী হয়ে আসে। চারদিকে ভাসে রাধার মনের আকুল কান্নার মধুর ধ্বনি। বৈষ্ণব কবিতার রাজ্যে সারাক্ষণ বাঁশি বেজে যাচ্ছে, সে-বাঁশিতে পাগল হয় রাধা, পাগল হই আমরা, সবাই। এমনকি নাম শুনেও রাধা আকুল হয়ে ওঠে কৃষ্ণের জন্যে। চণ্ডীদাসের একটি পদে রয়েছে :
লাল নীল দীপাবলি ৩৫
সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম।
কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো
আকুল করিল মোর প্রাণ।।
না জানি কতেক মধু শ্যাম নামে আছে গো
বদন ছাড়িতে নাহি পারে।
জপিতে জপিতে নাম অবশ করিল গো
কেমন পাইব সই তারে।।
এ-পদটি সহজ সরল, কিন্তু এর আবেগ তীব্র বাঁশরির সুরের মতো। রাধা শুধু শ্যাম অর্থাৎ কৃষ্ণের নাম শুনেছে, তাতেই সে আকুল হয়ে উঠেছে। কবি তার হৃদয়ের আকুলতাকে ছন্দে গেঁথে দিলেন, আর যুগযুগ ধরে সে-ছন্দের ঢেউ রাধার আকুলতা হয়ে আমাদের বুকে এসে দোলা দিতে লাগলো।
বৈষ্ণব কবিতার চার মহাকবি বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাস। তাঁদের মধ্যে বিদ্যাপতি ও গোবিন্দদাস লিখেছেন ব্রজবুলি ভাষায়, আর চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাস লিখেছেন খাটি বাঙলা ভাষায়। বিদ্যাপতি ও গোবিন্দদাস বেশ সাজানোগোছানো, তাঁরা আবেগকে চমৎকাররূপে সাজাতে ভালোবাসেন। ভেবেচিন্তে, চমৎকার উপমাউৎপ্রেক্ষায় গেঁথে এ-দুজন কবিতা লিখেছেন। অন্যদিকে চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাস সহজ সরল আবেগ প্রকাশ করেন সহজ সরল ভাষায়; কিন্তু ভাষার মধ্যে সঞ্চার করে দিয়েছেন নিজেদের প্রাকৃত হৃদয়ের তীব্র চাপ। এ-দুজনের কবিতা যেনো বনফুল; আর বিদ্যাপতি ও গোবিন্দদাসের কবিতা বাগানের লালিত পুষ্প। জ্ঞানদাসের একটি কবিতার কয়েকটি পংক্তি তুলে আনছি :
রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।
প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।।
হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে।
পরাণ পীরিতি লাগি থির নাহি বান্ধে।।
গোবিন্দদাসও মহান কবি, তাঁর কল্পনা মোহকর। তিনি কল্পনাকে চমৎকার অলঙ্কার পরিয়ে দেন। তার কয়েকটি পংক্তি :
যাহাঁ যাহাঁ নিকসয়ে তনু তনু জ্যোতি।
তাহাঁ তাহাঁ বিজুরি চমকময় হোতি।।
যাহাঁ যাহাঁ অরুণচরণ চল চলই।
তাহাঁ তাহাঁ থল-কমল-দল খলই।।