চতুর্দশ শতকের শেষ দিক থেকে বৈষ্ণব কবিতা রচিত হতে থাকে। এর প্রধান পাত্রপাত্রী রাধা ও কৃষ্ণ। এ-সময়ে বিশেষ কোনো ধর্মীয় আবেগে রচিত হয় নি বৈষ্ণব পদাবলি। ১৪৮৬ অব্দে জন্ম নেন চৈতন্যদেব [১৪৮৬-১৫৩৩]। তিনি প্রচার করেন বৈষ্ণব ধর্ম এবং তার পর থেকে এ-কবিতার মধ্যে বৈষ্ণব দর্শন স্থান পেতে থাকে। অসংখ্য কবি রচনা করেছেন বৈষ্ণব কবিতা, সকলের নামও আমরা জানি না। কেবল বৈষ্ণব কবিরাই একবিতা রচনা করেন নি, অনেক মুসলমান কবিও রয়েছেন, যারা পরম আবেগে চমৎকার বৈষ্ণব পদ রচনা করেছেন। অনেক কবি ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে ছিলেন ভক্ত কবি। ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন [১৮৬৬-১৯৩৯] ১৬৫ জন বৈষ্ণব কবির নাম জানিয়েছেন আমাদের। এ ছাড়াও ছিলেন আরো অনেক কবি, যাঁদের নাম কালস্রোতে হারিয়ে গেছে। কোনো কোনো বৈষ্ণব কবি আবার বেশ মজার কাজ করেছেন। তাঁরা খ্যাতি কামনা করেন নি, তাঁরা চেয়েছেন নিজেদের রচিত কবিতাকে শুধু আমোদের উদ্দেশে ভাসিয়ে দিতে। তাই তাঁরা কবিতায় নিজেদের নাম ব্যবহার না করে ব্যবহার করেছেন কখনো ছদ্মনাম, কখনো ব্যবহার করেছেন পূর্ববর্তী কোন মহৎ কবির নাম। তাই তাঁদের আর পৃথক করে আজ চেনা যায় না। কয়েকজন কবি আছেন অতি বিখ্যাত কবি, বৈষ্ণব কবিতার কথা উঠলেই তাঁদের নাম মনে আসে। তারা হচ্ছেন বিদ্যাপতি ]জন্ম ১৩৭৪], চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস [জন্ম ১৫২০–১৫৩৫], গোবিন্দদাস [১৫৩৪–১৬১৩]। বৈষ্ণব কবিতার তাঁরা চার মহাকবি। আরও যে অনেক কবি আছেন, তাদের কিছু নাম : অনন্তদাস, উদ্ধবদাস, নরোত্তম দাস, নাসির মামুদ, বলরাম দাস, বৈষ্ণব দাস, লোচন দাস, শ্যাম দাস, সেখ জালাল, শেখর রায়, তুলসী দাস। বৈষ্ণব কবিতা ছোটোছোটো। কবিরা রাধা ও কৃষ্ণের মনের কথা একবিতাগুলোতে বলেছেন। মনের কথা মানেই হলো আবেগ, সুখের আবেগ, বেদনার আবেগ। আসলে এ-কবিতাগুলোতে রাধাকৃষ্ণের নামে কবিদের মনের আবেগ লক্ষধারায় প্রবাহিত হয়েছে। আর কে না জানে যে ভালো কবিতার বিষয় হলো মনের কথা? মধ্যযুগে এ-রকম আর দেখা যায় নি। মঙ্গলকাব্য পড়লে বুঝতে কষ্ট হয় যে মানুষের মন বলে একটি বস্তু আছে এবং সে-মন সুখে উল্লসিত হয়, বেদনায় হয় কাতর। বৈষ্ণব কবিতায় এসে দেখা যায় মনের রাজত্ব, যেননা মন আর তার আকুলতা ছাড়া বিশ্বের সব কিছু মিথ্যে। বৈষ্ণব কবিরা তাঁদের কবিতায় ঘর সংসার সমাজ বিশ্ব সকল কিছুকে মিথ্যে বলে ঘোষণা করেছেন; একমাত্র সত্যি বলে দেখিয়েছেন হৃদয়কে। তাই বৈষ্ণব কবিতায় সর্বত্র দেখা যায় হৃদয়ের জয়। হৃদয়ই বৈষ্ণব পদাবলির বিশ্ব।
বৈষ্ণব কবিতার বিষয় রাধা ও কৃষ্ণের ভালোবাসা। এরা একজন চায় অপরজনকে, কিন্তু এদের মধ্যে বিপুল বাধা। এ-বাধাকে সরাতে চেয়েছেন কবিরা। এ-প্রসঙ্গে একটি কথা মনে রাখা দরকার, তা হচ্ছে মধ্যযুগের সব কবিতাই ধর্মের বাহন। বৈষ্ণব কবিতাও তাই। বৈষ্ণবরা মনে করে এই যে সৃষ্টি তার একজন স্রষ্টা আছে। এ-স্রষ্টা কিন্তু নির্দয় নয়, সে তার সৃষ্টিকে ভালোবাসে। সৃষ্টিও তার স্রষ্টাকে ভালোবাসে। তাই সৃষ্টি ও স্রষ্টা উভয়ে চায় মিলিত হতে, কিন্তু পারে না। যে-তত্ত্বের কথা বললাম, বৈষ্ণব কবিরা রাধা ও কৃষ্ণের মধ্য দিয়ে সে-কথাই বোঝাতে চেয়েছেন। রাধা হচ্ছে সৃষ্টি বা বৈষ্ণবদের ভাষায় জীবাত্মা, এবং কৃষ্ণ হচ্ছে স্রষ্টা বা বৈষ্ণবদের ভাষায় ‘পরমাত্মা’। এ-জীবাত্মা-পরমাত্মার মিলনবিরহের কথা বলতে চেয়েছেন বৈষ্ণব কবিরা। কিন্তু আমাদের ধর্মের বা তত্ত্বের দিকে বিশেষ আকর্ষণ নেই, আমরা প্রাণভরে চাই শুধু অসাধারণ এ-কবিতাগুলোকে। বৈষ্ণব কবিতা গীতিকবিতা। যেনো প্রাণের ভেতর থেকে আকুল হয়ে বেরিয়ে এসেছে সুরের মালা। বৈষ্ণব কবিতার কোনোটির বিষয় কৃষ্ণের রূপ, কোনোটির বিষয় রাধার রূপ, কোনোটির বিষয় দুজনের মিলন। এ-রকম অনেক বিষয়কে তাদের কবিতার মধ্যে ধরে রেখেছেন কবিরা। বিষয় অনুসারে এ-কবিতাগুলোকে নানা ভাগে ভাগ করা হয়। ভাগগুলোর কোনোটির নাম অনুরাগ, কোনোটির নাম বংশী, কোনোটির নাম আক্ষেপ, আবার কোনোটির নাম বিরহ ইত্যাদি। এর ফলে সমস্ত বৈষ্ণব কবিতা মিলে গড়ে উঠেছে এক চমৎকার গীতিনাট্য। অন্য এক রকমেও এ-কবিতাগুলোকে ভাগ করা যায়। সেটি হলো রসের ভাগ। মানুষের মনের যে-আবেগঅনুভূতি নিয়ে রচিত হয় সাহিত্য, তাকে প্রাচীনকালের সাহিত্যতাত্ত্বিকেরা কতকগুলো ‘রস’-এ ভাগ করেছেন। যেমন করুণরস, বীররস ইত্যাদি। বৈষ্ণবদের মতে রস পাঁচ প্রকার। তারা পাঁচ রকমের রস পরিবেশন করেছেন কবিতায়। রসগুলো হচ্ছে শান্ত, দাস্য, বাৎসল্য, সখ্য, মধুর।
বৈষ্ণব কবিরা যেমন সংখ্যাহীন, তেমনি অসংখ্য তাঁদের রচিত কবিতা। কারো পক্ষে বলা সম্ভব নয় ঠিক কতোগুলো বৈষ্ণব কবিতা আছে বাঙলা ভাষায়। মধ্যযুগে কবিতা রচিত হতো মুখেমুখে, গাওয়া হতো গানের আসরে। সাধারণত ওগুলো লিখে রাখা হতো না; মানুষ ওগুলোকে গেঁথে রাখতে নিজেদের স্মৃতিতে। কিন্তু স্মরণশক্তি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে, এবং যিনি মুখস্থ করে রেখেছেন, তাঁর মৃত্যুর পরে ওগুলো হারিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। এভাবে অনেক পদ হারিয়ে গেছে, আমাদের কাছে এসে পৌছোতে পারে নি। তাই মধ্যযুগেই শুরু হয়েছিলো এ-গানগুলোকে সংকলিত করার চেষ্টা। এর ফলে বেঁচে আছে গানগুলো। বৈষ্ণব কবিতা যিনি সবার আগে সংকলন করেন, তার নাম বাবা আউল মনোহর দাস। হুগলি জেলার বদনগঞ্জে তার সমাধি রয়েছে। তিনি সম্ভবত সোড়শ শতাব্দীর শেষপ্রান্তে বৈষ্ণব কবিতা সংকলন করেন। তাঁর এ-সংকলনগ্রন্থটি আকারেও বিশাল, এর নাম পদসমুদ্র। আসলেই এটি এক মহাসাগর, কবিতার মহাসমুদ্র। তিনি এ-গ্রন্থে সংগ্রহ করেন পনেরো হাজার বৈষ্ণব কবিতা। তাঁর পরে যিনি বৈষ্ণব কবিতা সংকলন করেন, তিনি রাধামোহন ঠাকুর। তাঁর বইয়ের নাম পদামৃতসমুদ্র। আঠারোশতকের প্রথম দিকে আরো একটি বৈষ্ণব কবিতাসংকলন প্রকাশ করেন বৈষ্ণব দাস। তাঁর বইয়ের নাম পদকল্পতরু। এর পরে আরো অনেক সংকলন হয়েছিলো, যেমন গৌরীমোহন দাস কবিতা সংকলন করেছিলেন পদকল্পলতিকা নামে, হরিবল্লভের সংকলনের নাম গীতিচিন্তামণি, প্রসাদ দাসের সংকলনের নাম পদচিন্তামণিমালা। এ-সব সংকলনে তিরিশ হাজারেরও অধিক কবিতা সংকলিত হয়েছিলো।