ফারসি ভাষাটি ভালোভাবে শিখে ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাড়ি ফেরেন। সম্পত্তি দেখাশোনার ভার পড়ে তাঁর ওপর, একাজে তিনি বর্ধমান যান। এখানে ঘটে এক অঘটন, কী এক কারণে কবিকে গ্রেফতার করে বর্ধমানের রাজা। কিন্তু বেশিদিন বন্দী থাকেন নি; পালান তিনি কারাগার থেকে। এমনভাবে পালান যাতে বর্ধমানরাজ তাঁকে আর ধরতে না পারে। পালিয়ে বর্ধমানের রাজার রাজ্যের সীমার বাইরে চলে যান কবি, হাজির হন ওড়িষ্যার কটকে। ১৭৪২ থেকে ১৭৪৫ পর্যন্ত তিনি ঘুরে বেড়ান ওড়িষ্যায়। এর পরে তিনি হন সন্ন্যাসী, সন্ন্যাসীর বিচিত্র পোশাকে কিছুদিন কাটান ভারতচন্দ্র। কিন্তু আত্মীয়দের হাতে ধরা পড়তে বেশি দেরি হয় নি। সন্ন্যাসীদের সাথে একবার তিনি যাচ্ছিলেন বৃন্দাবনে, পথে হুগলি জেলার কৃষ্ণনগর গ্রাম। সেখানে তাঁর সাথে দেখা হয় তাঁর কিছু আত্মীয়ের। কবিকে ছাড়তে হয় সন্ন্যাসীর বেশ, ফিরে আসতে হয় আবার সাধারণ মানুষের ভিড়ে। ভারতচন্দ্র আত্মীয়দের হাতে ধরা না পড়লেও একদিন না একদিন সন্ন্যাসীর বেশ ফেলে বাড়ি ফিরে আসতেনই। কেননা তার চরিত্রের মধ্যেই ছিলো না সন্ন্যাসী হওয়ার বীজ। তিনি বরং সন্ন্যাসীদের উপহাস করতে পারেন। সন্ন্যাসীবেশে দেশেদেশে যখন আর ঘোরা তাঁর পক্ষে সম্ভব হলো না, ফিরে এলেন দেশে, করতে লাগলেন চাকুরির চেষ্টা।
ফরাশডাঙ্গায় তখন ফরাশি সরকারের বেশ বড়ো কর্মচারী এক ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী। ভারতচন্দ্র গিয়ে ধরলেন তাকে। ইন্দ্রনারায়ণ দেখলো ভারতচন্দ্র ভালো কবি, ছন্দ গাঁথেন অনায়াসে, তাই ভাবলো এঁর হওয়া উচিত কবির চাকুরি। সে নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে পাঠালো ভারতচন্দ্রকে। ভারতের গুণে মুগ্ধ হলো রাজা কৃষ্ণচন্দ্র; ভারতচন্দ্রকে নিজের সভাকবি হিশেবে বরণ করে নিলো। কৃষ্ণচন্দ্র ভারতচন্দ্রকে উপাধি দিয়েছিলো রায়গুণাকর। ভারতচন্দ্র কবি হিশেবে লাভ করেন পরম খ্যাতি এবং সাংসারিক জীবনেও তাঁর সাফল্য অনেকের ঈর্ষার বস্তু হয়েছিলো। তিনি মাসিক বেতন পেতেন চল্লিশ টাকা, তাছাড়া পেয়েছিলেন রাজার কাছ থেকে বেশ জমিজমা।
ভারতচন্দ্র ছিলেন হাস্যরসিক। একটি মজার গল্প আছে ভারতচন্দ্র সম্বন্ধে। কবি তাঁর বিখ্যাত কাব্য “বিদ্যাসুন্দর” রচনা শেষ করেছেন। রচনা শেষ করেই তিনি পা বাড়ালেন। রাজার উদ্দেশে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে উপহার দিলেন কাব্যটি। রাজা তখন অন্য কাজে বিশেষ ব্যস্ত, তাই কাব্যটির পাতা না উল্টিয়ে পাশে রেখে দিলো। ভারতচন্দ্র বলে উঠলেন, মহারাজ করছেন কী, সব রস যে গড়িয়ে পড়বে!’ রাজা তখন অন্য কাজ রেখে চোখের সামনে খুলে ধরলো “বিদ্যাসুন্দর কাব্য”, যে-কাব্য বাঙলা ভাষায় নানা কারণে আলোড়ন জাগিয়ে যাচ্ছে আজ দুশো বছর ধরে।
ভারতচন্দ্র ছিলেন রাজসভার কবি, তাই তাঁর কাব্যে আছে চাতুর্য, বুদ্ধির খেলা, আছে পাণ্ডিত্য। তিনি মুকুন্দরামের মতো সহজ সরল নন, সহজ অনুভূতি তাঁকে মুগ্ধ করে না। ভারতচন্দ্র সর্বদা খুঁজেছেন এমন বস্তু যা পাঠককে চমকে দেবে। তিনি কথা বানিয়েছেন ধারালো করে, চকচকে তরবারির মতো। এ-কবির সব কিছুতে আছে বিদ্রুপ, তিনি সকলকে ঠাট্টা করে গেছেন। তাঁর কাব্য একটি, নাম অন্নদামঙ্গলকাব্য। কাব্যটির আছে। তিনটি ভাগ; এক ভাগের নাম ‘অন্নদামঙ্গল’, আরেক ভাগের নাম ‘বিদ্যাসুন্দর’, এবং আরেক ভাগ ভবানন্দ-মানসিংহ কাহিনী। ভারতচন্দ্র এ-কাব্যে তার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ভবানন্দের গুণকীর্তন করতে চেয়েছিলেন।
ভারতচন্দ্রের কথা মনে হলেই মনে পড়ে তাঁর সময়কে। সে-সময় নানা দিক দিয়ে পতিত হচ্ছে, সমাজের ভিত ভেঙে যাচ্ছে, দেশের শাসনব্যবস্থায় নানা বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। কাল যখন নষ্ট হয়ে যায়, তখন কবিরাও নষ্ট হন। ভারতচন্দ্রেরও হয়েছিলো তেমনি। তিনি জীবনকে গভীরভাবে না দেখে দেখেছেন হাল্কাভাবে, বাঁকা দৃষ্টিতে।
তবে তাঁর প্রতিভা ছিলো অসাধারণ। চমৎকার কথা বলায়, ছন্দের আন্দোলন সৃষ্টিতে তাঁর জুড়ি নেই মধ্যযুগে। কথা বলেন তিনি বিস্ময়কর চাতুর্যের সঙ্গে। যেমন মধ্যযুগের সকল কবিই বলেছেন, তাঁর নায়িকা দেখতে অত্যন্ত সুন্দরী, দেখতে একেবারে চাঁদের মতো। এ নিয়ে তামাশা করেছেন ভারতচন্দ্র। তিনি তাঁর নায়িকার রূপ বর্ণনা করতে এসে দেখলেন, এ বড়ো কঠিন কাজ, কেননা কয়েকশো বছর ধরে কয়েকশো কবি বলে গেছেন, তাঁদের নায়িকারা দেখতে চাঁদের মতো। তাই ভারতচন্দ্র লিখলেন :
কে বলে শারদ শশী সে মুখের তুলা।
পদনখে পড়ি তার আছে কতগুলা।।
এমন চমৎকার কথা তিনি অবিরাম বলেছেন, তাঁর অনেক কথা প্রবাদে পরিণত হয়েছে। যেমন, মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন’, নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়। ছন্দে ছিলো তাঁর অসীম অধিকার, তাই তাঁর কবিতা পড়ার সময়ে বিচিত্র ছন্দের রাজ্যে প্রবেশ করেছি বলে মনে হয়।
উজ্জ্বলতম আলো : বৈষ্ণব পদাবলি
মঙ্গলকাব্য থেকে বৈষ্ণব পদাবলিতে আসা হলো একটি গুমোট স্বল্পালোকিত দালানের ভেতর থেকে উজ্জ্বল সবুজ দক্ষিণের বাতাসে মাতাল বনভূমিতে আসা। মঙ্গলকাব্য পড়তে পড়তে ক্লান্তি আসে; কেননা এগুলোর আকার বিরাট, আর এতো অকাব্যিক বিষয় এগুলোতে ইনিয়েবিনিয়ে বলা হয় যে বেশিক্ষণ পড়া যায় না। অন্যদিকে বৈষ্ণব পদাবলি হচ্ছে কেবল কবিতার রাজ্য, সেখানে বাজে বিষয়ের বাড়াবাড়ি নেই, ভালো কবিতার যা ধন কবিরা এ-কবিতাগুলোতে সে-সব চয়ন করেছেন থরেবিথরে। আর এতো আবেগও যে আছে মানুষের, তা এ-কবিতাগুলো না পড়লে সত্যি বোঝা অসম্ভব। বৈষ্ণব কবিতার জন্যেই অনেক কিছুর নাম শুনলেই আমরা আবেগে কাতর হয়ে পড়ি। কোনো বাঙালি যদি শশানে যমুনা নদীর নাম, বা তমাল তরুর কথা, তাহলে তার পক্ষে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও আনমনা না হয়ে উপায় থাকে না। এ-বিষয়গুলো বৈষ্ণব কবিরা এতো মধুর-নিবিড় আবেগে বর্ণনা করেছেন যে আমাদের হৃদয়ের মধ্যে সেগুলো স্থান করে নিয়েছে। আমরা অনেকেই তমাল তরু দেখি নি, দেখি নি যমুনা নদী, তবু কেননা এরা আমাদের স্বপ্নে ভরে তোলে? এর মূলে আছে বৈষ্ণব কবিতা, যার প্রধান পাত্রপাত্রী রাধা আর কৃষ্ণ। রাধা এবং কৃষ্ণকে নিয়ে মধ্যযুগে সবচেয়ে সৌরভময় ফুল ফুটেছিলো, সে-ফুলের নাম বৈষ্ণব কবিতা। বৈষ্ণব কবিতা বাঙলা কবিতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। একে যদি আলোর সাথে তুলনা করি তাহলে বলবো মধ্যযুগে এমন আলো আর জ্বলে নি।