কবি মুকুন্দরামের আরো একটি বড়ো বৈশিষ্ট্য তিনি নির্বিকার। কবিরা আবেগে ফেটে পড়ে, বেদনায় কাতর হয়। কিন্তু এ-কবি অন্য রকম; আবেগ তাঁকে বিহ্বল করে না, বেদনা তাঁকে কাতর করে না, সুখ তাঁকে উল্লসিত করে না। কবি সব সময় সমান নির্বিকার, তিনি সব কিছুকে সহজভাবে গ্রহণ করেছেন। এ হচ্ছে একজন উৎকৃষ্ট ঔপন্যাসিকের গুণ। ঔপন্যাসিক তাঁর পাত্রপাত্রীর সুখদুঃখে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন না, তিনি থাকেন ওই আনন্দবেদনার জগৎ থেকে দূরে। মুকুন্দরামও তেমনি।
মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলকাব্য-এর প্রথম অংশের নায়ক কালকেতু, নায়িকা কালকেতুর স্ত্রী ফুল্লরা। এ-কাব্যে আছে আরো অনেক পাত্রপাত্রী; যেমন, মুরারি শীল, ভঁড়দত্ত, কলিঙ্গের রাজা। আছে বনের পশুরা, যাদের আচরণ একেবারে মানুষের মতো। পশুরা যখন দেবীর কাছে প্রার্থনা জানায় কালকেতুর বিরুদ্ধে, তখন মনে হয় গরিব জনসাধারণ অভিযোগ জানাচ্ছে রাজার কাছে। কবি মুকুন্দরামের কাব্য পড়ে মনে হয় তিনি ছিলেন সহজ সরল সুখী রাষ্ট্রব্যবস্থাকামী। কালকেতু যখন রাজ্য স্থাপন করে তখন চাষী বুলান মণ্ডলকে সে যে-কথা বলে, তাতে এর পরিচয় আছে। ওই অংশ তুলে দিচ্ছি :
আমর নগরে বৈস যত ভূমি চাহ চষ
তিন সন বই দিও কর।
হাল পিছে এক তংকা না করো কাহার শংকা
পাট্টায় নিশান মোর ধর।।
খন্দে নাহি নিব বাড়ী রয়ে বসে দিও কড়ি
ডিহিদার না করিব দেশে।
সেলামি কি বাঁশগাড়ি নানা বাবে যত কড়ি
লইব গুজরাট বাসে।
কালকেতু বুলান মণ্ডলকে বলছে, তুমি আমার নগরে এসে ইচ্ছেমতো জমি চাষ করো। তিন বছর পরপর কর দিয়ো। তুমি কর দেবে হালপ্রতি মাত্র এক টাকা। যখন ফসল পাকবে তখন আমার লোকেরা কোনো অত্যাচার করবে না তোমাকে, এদেশে কোন ডিহিদার থাকবে না। ডিহিদার মামুদ শরিফের অত্যাচারে কবি গ্রাম ছেড়েছিলেন; তাই তিনি কালকেতুর রাজ্যে কোনো ডিহিদার রাখেন নি। গুজরাটে কোনো ওপরি কর থাকবে। কবি চেয়েছিলেন সুখী সাধারণ জীবন, যে-জীবন তার দেশের মানুষ কখনো পায় নি।
রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র
দেবী অন্নদা নদী পার হলো ঈশ্বরী পাটনির খেয়ানৌকোয়। তীরে নেমে মাঝিকে জিজ্ঞেস করলো, কী বর চাও তুমি, মাঝি? যা চাও তাই পাবে। মাঝি গরিব মানুষ, খেয়া পারাপার করে তার জীবন চলে। মাঝি দেবীর কাছে চাইতে পারতো রাজ্য, বাড়িভর্তি সোনারুপো, মুক্তোপান্না। তার অভাবের দিন কেটে যেতে দেবীর দয়ায়। মাঝি ওসব কিছু চাইলো না, সে দেবীর কাছে নিবেদন করলো একটি ছোটো প্রার্থনা। বললো, আমার সন্তান যেনো থাকে দুধে ভাতে।’ মাঝির এ-প্রার্থনার মধ্যে আমরা মধ্যযুগের আঠারোশতকের জীবনের পরিচয় পাই। যে-কবি এ-পংক্তিটি রচনা করেছেন, তিনি মধ্যযুগের একজন শ্রেষ্ঠ কবি। নাম ভারতচন্দ্র রায়; উপাধি রায়গুণাকর।
ভারতচন্দ্র জন্মেছিলেন আঠারোশতকের প্রথম দিকে, আনুমানিক ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে। তিনি মধ্যযুগের আরেক বড়ো কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর থেকে প্রায় দুশো বছরের ছোটো। ভারতচন্দ্র যখন জন্ম নেন, তখন মধ্যযুগ শেষ হয়ে আসছে। আগে সমাজে যে-স্থিরতা ও শান্তি ছিলো, তাও নষ্ট হচ্ছে দিনেদিনে। সাহিত্যের একটি যুগ যখন শেষ হয়ে আসতে থাকে তখন শেষের বছরগুলোতে দেখা দেয় নানারকম পতন। সমাজে যেমন সাহিত্যেও তেমন। ভারতচন্দ্রের সময়ে সমাজের পতন শুরু হয়েছিলো, তাঁর মৃত্যুর তিন বছর আগে আমাদের দেশ দখল করে নেয় শাদা ইংরেজরা। ভারতচন্দ্র এক পতনশীল সমাজের কবি, তবু তিনি প্রতিভাবলে অসাধারণ সাহিত্য রচনা করে গেছেন।
ভারতচন্দ্র বর্ধমানের (বর্তমান হাওড়া জেলা] পেঁড়োবসন্তপুর বা পাণ্ডুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম নরেন্দ্রনারায়ণ রায়। ভারতচন্দ্রের জীবন বেশ রোমাঞ্চপূর্ণ। তাঁর জন্মের পরেই তাঁদের পরিবারে নেমে আসে দুর্দিন। ১৭১৩ সালে বর্ধমানের রাজা সুরসুট আক্রমণ করে, এবং জয় করে নেয় ভবানিপুরের গড়। তখনকার ভুরসুট পরগণায় ছিলো পাণ্ডুয়া গ্রাম। এ-গ্রাম চলে যায় বর্ধমানের রাজার অধিকারে। এর ফলে ভারতচন্দ্রের পিতা নরেন্দ্রনারায়ণ রায় হারিয়ে ফেলেন তাঁর জমিজমা, ধনসম্পদ। ভারতচন্দ্রের বয়স যখন দশের মতো তখন তিনি পালিয়ে যান মামাবাড়ি। মামারা যে-গ্রামে বাস করতো, তার নাম নওয়াপাড়া। সেখানে বসবাসের সময়ে তিনি এক পণ্ডিতের টোলে সংস্কৃত ব্যাকরণঅভিধান পড়েন। তাঁর পড়াশোনাটা হয়েছিলো বেশ ভালো রকমের, বেশ পণ্ডিত হয়ে উঠেছিলেন অল্প বয়সেই ভারতচন্দ্র। তিনি বিয়ে করেন মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে। বিয়ে করে পড়া শেষ করে ভারতচন্দ্র বাড়ি ফিরে আসেন। কিন্তু সেখানে অভিনন্দনের বদলে লাভ করেন তিরস্কার। তখন রাজভাষা ছিলো ফারসি, তাই সমাজে ফারসির মর্যাদা খুব। কেননা ফারসি শিখলে পাওয়া যেতো ভালো চাকুরি। কিন্তু তা না শিখে কবি শিখেছেন মৃতভাষা; সমাজে যার কদর কম, সে সংস্কৃত ভাষা। বাড়ির লোকেরা তাকে সারাক্ষণ জ্বালাতে থাকে এজন্যে। ভারতচন্দ্র এতে ক্ষুব্ধ হন। মনস্থির করেন তিনিও ফারসি শিখবেন এবং অনেকের চেয়ে ভালোভাবে শিখবেন। আবার পালান ভারতচন্দ্র, এবার আসেন হুগলি জেলার দেবানন্দপুরের রামচন্দ্র মুনশির বাড়িতে, এবং শিখতে থাকেন অর্থকরী রাজভাষা ফারসি।। খুব উৎসাহের সাথে শিখতে থাকেন ফারসি ভাষাটি ভারতচন্দ্র। তাঁর শিক্ষক এতে খুব মোহিত হন। রামচন্দ্র মুনশির বাড়িতেই তিনি সর্বপ্রথম কবিতা রচনা করেন। ভারতচন্দ্র কবি হন।