শুন ভাই সভাজন কবিত্বের বিবরণ এই গীত হইল যেন মতে।
উড়িয়া মায়ের বেশে, কবির শিয়র দেশে, চণ্ডিকা বসিল আচম্বিতে।।
সহর সিলিমবাজ তাহাতে সজ্জনরাজ নিবসে নিয়োগী গোপীনাথ।
তাঁহার তালুতে বসি দামিন্যায় চাষ চষি নিবাস পুরুষ ছয় সাত।।
ধন্য রাজা মানসিংহ বিষ্ণুপদাম্বুজ-ভৃঙ্গ গৌড়-বঙ্গ-উৎকল-অধিপ।
সে মানসিংহের কালে প্রজার পাপের ফলে ডিহিদার মামুদ সরিপ।।
উজির হলো রায়জাদা বেপারিরে দেয় খেদা, ব্রাহ্মণবৈষ্ণবের হল্য অরি।
মাগে কোণে দিয়া দড়া পনর কাঠায় কুড়া নাহি শুনে প্রজার গোহারি।।
কবি বলছেন, ভাইয়েরা শোননা, আমি কী করে কবি হলাম। শুয়ে ছিলাম আমি, হঠাৎ আমার শিয়রে এসে বসলো দেবী চণ্ডী। আমাকে তাঁর গান রচনা করতে বললো। এটুকু ব’লে কবি শুরু করেন তাঁর জীবনকাহিনী। সিলিমবাজ নামে এক শহর ছিলো, তার জমিদার গোপীনাথ নিয়োগী। কবির বসবাস গোপীনাথের তালুকে, দামুন্যা গ্রামে। কবির পূর্বপুরুষেরা অনেক দিন ধরে এ-গ্রামে বসবাস করে আসছেন। তারপর এলো মানসিংহের রাজত্ব, গৌড়-বঙ্গ-উৎকলের সে রাজা। তার সময়ে কবির গ্রামের ডিহিদার হলো মামুদ শরিফ। সে ছিলো বড়ো অত্যাচারী। কবি তার অত্যাচারের বিবরণ দিয়েছেন। মামুদ শরিফ ব্রাহ্মণ বৈষ্ণব সকলের সাথে শত্রুতা করতে লাগলো। সে জমির মাপ নিতে লাগলো জমির কোণ থেকে কোণে দড়ি ধরে, তাতে জমির আয়তন বেশি মাপা হতে লাগলো। পনেরো কাঠায় এক কুড়া ধরতে লাগলো। সে প্রজাদের কোনো অভিযোগ শশানে
বেশ দীর্ঘ বিবরণ দিয়েছেন কবি। কবি আর তাঁর পরিবারের চিরদিনের বসবাস যেগ্রামে, যে-গৃহে, সেখানে থাকতে পারলেন না। গ্রাম ছেড়ে তিনি পালালেন। তাঁর সাথী হলো পরিবারের লোকজন, আর ভাই রামানন্দ ও অনুচর দামোদর নন্দী। নদী বেয়ে এগোতে লাগলেন গন্তব্যহীন কবি। পথে দেখা দিলো বিপদ, কবি পড়লেন রূপরায় নামক এক ডাকাতের কবলে। রূপরায় কবির সব কিছু হরণ করলো। কবিকে আশ্রয় দিলেন। যদুকুণ্ডু নামে এক লোক। কবি আবার যাত্রা শুরু করলেন, তাঁর নৌকো চলছে গোড়াই নদী বেয়ে, এসে পৌছোলেন একদিন তেউট্যা নামক এক স্থানে। এর পরে আবার শুরু হলো নৌযাত্রা, এবারের নদীর নাম দারুকেশ্বর। কবি পৌছোলেন বাতনগিরিতে, সেখান থেকে গেলেন কুচুট শহরে। কবির জীবনটা এ-সময়ে দুঃখে ভরা; —–আহার নেই, বস্ত্র নেই, গৃহ নেই। এ-কুচুট শহরেই কবিকে ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে চণ্ডী কবিতা রচনা করতে বললো। এরপর কবি আসেন আড়রা গ্রামে, সেখানে এসে কবি একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন। এএলাকার জমিদার বাঁকুড়া রায়। সে বেশ ভালো লোক, কবিকে আশ্রয় দিলো। জমিদারের ছিলো এক পুত্র, নাম রঘুনাথ। কবি রঘুনাথের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হলেন। পিতার মৃত্যুর পরে রঘুনাথ হলো জমিদার, আর তার সময়েই কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী লেখেন অমর কাব্য চণ্ডীমঙ্গল।
কবির পিতামহের নাম ছিলো জগন্নাথ মিশ্র, পিতার নাম হৃদয় মিশ্র, বড়ো ভাইয়ের নাম কবিচন্দ্র। তাঁর পুত্রের নাম শিবরাম, মেয়ের নাম যশোদা, পুত্রবধূর নাম চিত্রলেখা। এসব পাওয়া গেছে তাঁর নিজের লেখা জীবনকাহিনীতেই। কবি মুকুন্দরাম বড়ো কবি। তাঁর কবিতা অবশ্য কবিতা বলতে আমরা যে হৃদয়মাতানো, মনভোলানো জিনিশ বুঝি, তা নয়। তাঁর চণ্ডীমঙ্গলকাব্য হচ্ছে মধ্যযুগের উপন্যাস। তিনি জীবনের বাস্তব দিক এমনভাবে বর্ণনা করেছেন যে বিস্মিত হতে হয়। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী কল্পনা করতে জানতেন না, খুব চতুর ঝকঝকে কথা বলতে জানতেন না; তিনি ছিলেন একজন বড়ো দর্শক। তার চারপাশে যা তিনি দেখতে পেতেন, তাই তিনি লিখতেন। এজন্যে তাঁর কাব্যে বাস্তবের বর্ণনা খুব পরিচ্ছন্ন। তিনি চারপাশে দেখেছেন কালকেতুর মতো সহজ-সরল নির্বোধ ধরনের পুরুষ; দেখেছেন ফুল্লরার মতো শ্রীময়ী গৃহিণী। দেখেছেন মুরারি শীলের মতো ধূর্ত বণিক এবং ভাঁড়দত্তের মতো ভণ্ড। এদের তিনি বাস্তব জগতে যেমন হয়, তেমন করে সৃষ্টি করেছেন। এর ফলে তাঁর কাব্যে জীবন্ত হয়ে আছে কয়েকটি চরিত্র। উপন্যাসেই চরিত্র সৃষ্টি হয়ে থাকে, কবিতায় নয়। এজন্যে অনেক বলেন, কবি মুকুন্দরাম যদি মধ্যযুগে জন্মগ্রহণ না করে আধুনিক কালে জন্মাতেন, তবে তিনি কবি না হয়ে হতেন ঔপন্যাসিক। কেমন ঔপন্যাসিক? বঙ্কিমচন্দ্রের মতো কল্পনাপ্রধান ঔপন্যাসিক নয়, হতেন শরৎচন্দ্র বা তারাশঙ্কর বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বাস্তবতার শিল্পী। তিনি যে মানুষকে চিনেছিলেন ভালোভাবে। কালকেতু দেবীর কৃপায় অনেক ধন পেয়েছে। কালকেতু জীবনে সোনা দেখে নি। সে সোনা লাভের পর সোনা ভাঙাতে যায় মুরারি শীল নামের এক বেণের কাছে। বেণে চতুর, কালকেতু বোকা। বেণে ভাবলো, দেখি না একটু বাজিয়ে যদি কালকেতুকে ঠকাতে পারি। তাই বেণে মুরারি শীল বললো :
সোনা রূপা নহে বাপা এ বেঙ্গা পিতল।
ঘষিয়া মাজিয়া বাপু করেছ উজ্জ্বল।।
মুরারি বলছে, এ সোনারুপো নয়, পেতল। তুমি একে ঘষেমেজে উজ্জ্বল করে এনেছো। কালকেতু বললো, এ আমি দেবীর কাছ থেকে পেয়েছি। কবির ভাষায় :
কালকেতু বলে খুড়া না কর ঝগড়া।
অংগুরী লইয়া আমি যাই অন্য পাড়া।।
তখন বেণের টনক নড়ে। সে তো চিনেছে এ-সোনার মতো সোনা হয় না। তাই বেণে শেষে সোনা রেখে দেয়। এভাবে দেখা যায় মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁর সকল পাত্রপাত্রীকে জীবন্ত করে এঁকেছেন, মধ্যযুগে এর তুলনা বেশি পাই না।