দেশে ফিরে এসে দেখে সে যে-শিশুপুত্র রেখে গিয়েছিলো, সে পরিপূর্ণ যুবকে পরিণত হয়েছে। নাম তার লখিন্দর। একমাত্র পুত্রের মুখ দেখে সুখী বোধ করলো চাঁদ। চাঁদ অসীম আশাবাদী, পরাজয়হীন তার চিত্ত। লখিন্দর সুন্দর যুবক। চাঁদ নিজের পুত্রের বিয়ের আয়োজন করতে লাগলো। সুন্দরী পাত্রী মিললো উজানিনগরে। মেয়ের নাম বেহুলা। বেহুলা নানা গুণে উজ্জ্বল মেয়ে। চাঁদ জানে বিয়ের রাতে বাসরঘরে সাপের কামড়ে লখিন্দরের মৃত্যু হবে। চাঁদ চায় এ-মৃত্যুকে ঠেকাতে। সে ডেকে আনলো শিল্পীদের তৈরি করতে বললো ছিদ্রহীন লোহার বাসর, যাতে কিছুতেই ঢুকতে না পারে সাপ। চাঁদ যেমন উদ্যমপরায়ণ, মনসাও তেমনি প্রতিহিংসাপরায়ণ। সে শিল্পীদের স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললো ছিদ্র রাখতে, নইলে তাদের ভাগ্যে আছে মৃত্যু। বিয়ে হয়ে গেলো লখিন্দর-বেহুলার বাসর রাতে ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করে বেহুলার দীর্ঘ কেশ বেয়ে শয্যায় উঠলো মনসার দূত সাপ। কামড়ে দিলো। মৃত্যু হলো লখিন্দরের।
সাপের কামড়ে যারা মরে, তাদের ভাসিয়ে দেয়া হয় ভেলায় করে নদীর জলে। অনেক রোদনের মধ্যে দিয়ে লখিন্দরকেও ভেলায় করে ভাসিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হলো। বেহুলা এবার বেদনা থেকে উঠে বসলো, হলো পাথরের মতো শক্ত; বললো সেও যাবে ভেলায় করে তার স্বামীর সাথে। সে ফিরিয়ে আনবে তার স্বামীকে স্বর্গলোক থেকে। বেহুলা সুন্দর, যেমন আনন্দে তেমনি বেদনায়, তেমনি প্রতিজ্ঞায়। কারো কথা সে মানলো
স্বামীর সাথে সে উঠে বসলো ভেলায়। নদীর নাম গাঙুর, ভেসে চলছে লখিন্দরের ভেলা, মৃত স্বামীর পাশে বসে আছে বেহুলা একরাশ বেদনার মতো। দিনে দিনে শরীর থেকে ঝরে যাচ্ছে লখিন্দরের মাংস আর নদীর স্রোতে ভেসে চলছে ভেলা। ভেলা ঘাট থেকে ঘাটে ভেসে যায়। বেহুলার সামনে আসে নানা বিপদ, কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বেহুলা সেসব জয় করে। তার মধ্যে আছে জয়ের বীজ, জয় তার ভাই।
ভাসতে ভাসতে ভেলা এসে পৌছোলো এক ঘাটে, যেখানে প্রতিদিন স্বর্গের ধোপানি কাপড় ধোয়। বেহুলা একদিন এক অবাক কাণ্ড দেখলো। ধোপানি কাপড় ধুতে এসেছে। একটি ছোটো শিশু নিয়ে। শিশুটি দুরন্ত, সারাক্ষণ দুষ্টুমি করে। ধোপানি এক সময় শিশুটিকে একটি আঘাত করে মেরে ফেললো। পরে যখন কাপড় কাচা হয়ে গেলো, তখন আবার সে তাকে বাঁচিয়ে নিয়ে চলে গেলো। বেহুলা বুঝতে পারলো, এ মানুষ বাঁচাতে জানে। পরদিন বেহুলা গিয়ে তার পদতলে পড়লো, তার স্বামীকে বাঁচিয়ে দিতে অনুরোধ করলো। ওই ধোপানির নাম নেতা। সে বললো, একে আমি বাঁচাতে পারব না, কেননা একে মেরেছে মনসা। তুমি স্বর্গে যাও, দেবতাদের সামনে উপস্থিত হও। দেবতারা ভালোবাসে নাচ দেখতে। তুমি যদি তোমার নাচ দেখিয়ে তাদের মুগ্ধ করতে পারো, তাহলে তারা তোমার স্বামীকে বাঁচিয়ে দেবে।
আশার মোম জ্বলে উঠলো বেহুলার চোখে, মনে, সারা চেতনায়। সে স্বর্গে গেলো। দেবতারা বসে আছে; তাদের সামনে বেজে উঠলো বেহুলা, বেজে উঠলো তার পায়ের নূপুর। বেহুলার নাচে চঞ্চল হয়ে উঠলো চারদিক, তার নূপুরের ধ্বনিতে ভরে গেলো স্বর্গলোক। বেহুলার নৃত্যে এক অসাধারণ ছন্দ। মুগ্ধ হলো দেবতারা। তারা বেহুলাকে বর প্রার্থনা করতে বললো। সে তার স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা করলো। মহাদেব রাজি হলো তাতে। মনসা এসে বললো, আমি লখিন্দরকে ফিরিয়ে দিতে পারি, যদি চাঁদ আমার পুজো করে। বেহুলা তাতে রাজি হলো, এবং বললো, তাহলে তোমাকে ফিরিয়ে দিতে হবে আমার শ্বশুরের সব কিছু। ফিরিয়ে দিতে হবে তাঁর পুত্রদের, তাঁর সমস্ত বাণিজ্যতরী। রাজি হলো মনসা।
মনসা সব ফিরিয়ে দিলো, বেঁচে উঠলো লখিন্দর, ভেসে উঠলো চোদ্দ ডিঙ্গা। চাঁদ পাগলের মতো ছুটে এলো বেহুলার কাছে। কিন্তু এসে যেই শুনলো যে তাকে মনসার পুজো করতে হবে, তখন তার সকল আনন্দ নিভে গেলো, সে দৌড়ে সরে গেলো সবকিছুর থেকে। বেহুলা গিয়ে কেঁদে পড়লো চাঁদের পায়ে। যে-চাঁদ মনসাকে চিরদিন অপমান করেছে, যে কোনোদিন পরাজিত হতে চায় নি, সে-চাঁদ বেহুলার অশ্রুর কাছে পরাজিত হলো। বেহুলা বললো, তুমি শুধু বাঁ হাতে একটি ফুল দাও, তাহলেই খুশি হবে মনসা। চাঁদ বললো, আমি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বাঁ হাতে ফুল দেবো। তাই হলো। মুখ ফিরিয়ে বা হাতে একটি ফুল হেলাভরে ছুঁড়ে দিল চাঁদ। আর পৃথিবীতে প্রচারিত হলো মনসার পুজো।
কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী
কবির নাম মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। তাঁর কাব্যের নাম চণ্ডীমঙ্গলকাব্য। কবির উপাধি ছিলো কবিকঙ্কন, উপাধিটি চমৎকার। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী মধ্যযুগের একজন শ্রেষ্ঠ কবি; তাঁর কাব্য বাঙলা সাহিত্যে গর্বের ধন। কিন্তু এ-মহান কবি সম্বন্ধে আমরা জানি কতোটুকু? খুব সামান্য। কবি কাব্যের শুরুতে তাঁর জীবনকাহিনী বলেছেন। এ-কাহিনী সংক্ষিপ্ত, কবির সকল পরিচয় জানা যায় না। তবু আমাদের পিপাসা মেটাতে হয় কবির স্বরচিত সে-সামান্য কাহিনীর ঠাণ্ডা জলেই। তাঁর বইতে যে-পরিচয় পাওয়া যায়, তাতে মনে হয় কবির জন্ম হয়েছিলো ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে, আর তিনি কাব্য লিখেছিলেন ১৫৭৫ অব্দের কাছাকাছি সময়ে। কবির জীবনের যে-সামান্য কাহিনী আমরা জানি তাতে বিস্মিত হবার মতো কোনো উপাদান নেই। মনে হয় কবি ছিলেন সহজ সরল, তাঁর সারাটি জীবন। কেটেছে শাদামাটাভাবে। শুধু তাঁর জীবনের শুরুতে দেখা দিয়েছিলো কিছুটা সংঘাত। কবির নিজের ভাষায় সে কাহিনীর কিছুটা :