এক ঘড়া অবশেষে দেখি মহাবীর।
নিতে নারে দেড়ি ভার হইল অস্থির।।
মহাবীর বলে মাতা করি নিবেদন।
চাহিয় চিন্তিয়া দেহ এক ঘড়া ধন।।
যদি গো অভয়া ধন না দিবা অপর।
এক ঘড়া ধন মাগো নিজ কাঁখে কর।।
অস্থির দেখিয়া বীর ভাবেন অভয়া।
ধন ঘড়া কাঁখে কৈলা বীরে করি দয়া।।
আগে আগে মহাবীর করিল গমন।
পশ্চাতে চলিল চণ্ডী লয়ে তার ধন।।
মনে মনে মহাবীর করেন যুকতি।
ধন গড়া লয়ে পাছে পালায় পার্বতী।।
কালকেতু বাঁকে করে দু-ঘড়া করে ধন নিয়ে যাচ্ছে তার বাড়িতে। ওপরের ঘটনাটি হচ্ছে তৃতীয় বার যখন সে ধন নিতে এসেছে তখনকার। সে দেখে এক ঘড়া ধন বাকি থেকে যাচ্ছে। দেবীকে ধন পাহারায় রেখে যেতে তার সাহস হচ্ছে না। তাই দেবীকে সে বলছে, যদি এ-ধন তুমি আর কাউকে না দিতে চাও, তবে একটু কাঁখে করে এক ঘড়া ধন তুমি নিজেই আমার বাড়িতে পৌছে দাও। দেবী তাতে রাজি হয়। কালকেতু আগে আগে যায়, দেবী যায় পাছে পাছে। কালকেতুর মনে বড়ো ভয় যদি দেবী ধন নিয়ে পালিয়ে যায়! একটু বেশ নির্বোধ না হলে কেউ কি এমন কথা ভাবে।
কালকেতু এ ধনে ধনী হয়ে গুজরাটে বন কেটে বিরাট নগর নির্মাণ করলো। সেখানে ছিলো ভাড়দত্ত নামের এক দুষ্ট লোক। দুষ্টরা মন্ত্রী হতে চায় চিরকালই, সেও এসে কালকেতুর মন্ত্রী হতে চাইলো। কালকেতু তাতে রাজি হলো না। এতে ভাড়দত্ত ক্ষেপে গেলো। সে চলে গেলো কলিঙ্গে, সেখানকার রাজাকে নানা কিছু বুঝিয়ে কালকেতুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে রাজি করালো। বেধে গেলো যুদ্ধ। কালকেতু আগে ছিলো ব্যাধ, এখন রাজা। সে যুদ্ধ জানে না। তাই যুদ্ধে হেরে গেলো, এসে পালিয়ে রইলো, বউয়ের পরামর্শ মতো, ধানের গোলার ভেতরে। কলিঙ্গরাজ তাকে বন্দী করে নিয়ে গেলো, কারাগারে বন্দী করে রাখলো। ব্যাধ কালকেতু দেবীর বরে রাজা হয়েছিলো, এখন সে বন্দী। কারাগারে কালকেতু স্মরণ করলো দেবী চণ্ডীকে।
চণ্ডী কালকেতুর ওপর সব সময় সদয়, কেননা কালকেতু তার ভক্ত। দেবী কলিঙ্গের রাজাকে স্বপ্নে দেখা দিলো। বললো, কালকেতু আমার ভক্ত, তাকে মুক্তি দাও, তার রাজ্য ফিরিয়ে দাও। কলিঙ্গরাজ দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে মুক্তি দিলো কালকেতুকে, ফিরিয়ে দিলো তার রাজ্য। কালকেতু তার রাজ্যে ফিরে এসে আবার রাজা হলো, রাজত্ব করতে লাগলো বেশ সুখে। ফুল্লরা তার সুখী রানী। অনেক দিন রাজত্ব করে বৃদ্ধ হলো কালকেতু আর ফুল্লরা, এবং এক শুভদিনে মহাসমারোহে আবার নীলাম্বর-ছায়ারূপে ফিরে গেলো স্বর্গে।
মনসামঙ্গলের নীল দুঃখ
চাঁদসদাগর আগে ছিলো স্বর্গে। স্বর্গে শোনা যায় সবাই সুখে থাকে, চাঁদসদাগরও ছিলো। কিন্তু কপালে তার সুখ সইলো না। একদিন অকারণে মনসা দেবী রেগে উঠলো চাঁদের ওপর, অভিশাপ দিলো স্বর্গচ্যুত হয়ে মর্ত্যে জন্ম নেয়ার। চাঁদ ছিলো গর্বী আত্মবিশ্বাসী পুরুষ। সেও ধমকে এলো মনসাকে; আমি যাচ্ছি পৃথিবীতে, কিন্তু আমি যদি সেখানে তোমার পুজো না করি তবে সেখানে কেউ তোমার পুজো করবে না। আরম্ভ হলো দুজনার বিরোধ, এ-বিরোধে চাঁদের জীবন হয়ে উঠলো বেদনায় নীল।
চাঁদ মর্ত্যে এসে জন্ম নিলো। তার স্ত্রীর নাম হলো সনকা। চাঁদ পুজো করে শিবের আর গোপনে লুকিয়ে লুকিয়ে সনকা পুজো করে মনসার। চাঁদ একদিন দেখে ফেললো স্ত্রীর মনসাপুজো; রেগে লাথি দিয়ে ফেলে দিলো মনসার মঙ্গলঘট। মনসা খুব রাগী দেবী, চাদের ব্যবহারে জ্বলে উঠলো অগ্নিশিখার মতো। সে চাঁদসদাগরের ওপর প্রতিশোধ নিতে হলো বদ্ধপরিকর। চাঁদসদাগরের একটি বাড়ি ছিলো স্বর্গের উদ্যানের মতো সুন্দর; সেটি ধ্বংস করে দিলো মনসা। রাজ্যের দিকে দিকে দেখা দিলো সাপের অত্যাচার। মনসা হলো সাপের দেবী, সে তার সাপবাহিনীকে লাগিয়ে দিলো চাঁদের বিরুদ্ধে। চাদের এক বন্ধু একদিন সাপের কামড়ে মারা গেলো, চাঁদ বিমর্ষ হয়ে পড়লো। মানসার ক্রোধে আরো মৃত্যু দেখা দিলো চাঁদের বাড়িতে। তার দু-জন শিশুপুত্রকে মেরে ফেললো মনসা। মনসা এসে হাজির হলো চাঁদের কাছে; বললো, আমার পুজো করো, আমি সব ফিরিয়ে দেবো। চাঁদ তবুও অটল, কিছুতেই সে পুজো করবে না মনসার। বরং সে মনসাকে আরো অপমান করলো, মনসাকে সে লাঠি নিয়ে তাড়া করলো, লাঠির আঘাতে ভেঙে গেলো মনসার কাঁকালি। সনকা এসে পায়ে পড়লো চাঁদ সদাগরের; বললো, তুমি মনসার পুজো করো, তাহলে আমি ফিরে পাবো আমার সন্তানদের। তবু চাঁদ অটল, সন্তান ও ধনের চেয়ে সম্মান তার কাছে বড়ো।
সনকার দুঃখ তার কোনো পুত্র নেই, যারা ছিলো তারা মরে গেছে। সে গোপনে মনসার স্তব করে পুত্র মেগে নিলো। তবে মনসা বললো, এ-পুত্র বিয়ের রাত্রেই সাপের কামড়ে মারা যাবে। চাঁদসদাগর চোদ্দ ডিঙ্গা সাজিয়ে বের হলো বাণিজ্যে। তখন আবার এলো মনসা, তার পুজো করতে বললো। এবারও চাদ তাকে অপমান করে বিদায় দিলো। চাঁদ বিদেশে গিয়ে চোদ্দ ডিঙ্গা ভ’রে পণ্য কিনলো, যাত্রা করলো গৃহাভিমুখে। তখন আবার মনসা এসে দাবি করলো পুজো। চাঁদ আগের মতো আবার তাকে অপমান করলো। তাই প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে পাগল হয়ে উঠলো মনসা, চাঁদের ওপরে প্রতিশোধ না নিলে তার জ্বালা জুড়োবে না। চাঁদের ডিঙ্গা আসছিলো সমুদ্রপথে, মনসার আদেশে হঠাৎ জেগে উঠলো সামুদ্রিক বাতাস, ক্ষেপে উঠলো বজ্রবিদ্যুৎ। চারদিকে উত্তাল ঝড়ের দোলা, বাতাসের তাণ্ডব। চাঁদের পণ্যভরা ডিঙ্গাগুলো একটির পর একটি ড়ুবে গেলো সমুদ্রের জলে। চাঁদ ভাসতে লাগলো সমুদ্রে। এগিয়ে এলো মনসা, চাঁদকে সে মারতে চায় না, চায় চাঁদের পুজো। মনসা একটি আশ্রয় করার মতো বস্তু ভাসিয়ে দিলো চাঁদের দিকে। চাঁদ প্রায় সেটিকে ধরতে যাচ্ছিলো, এমন সময় তার মনে হলো এটি মনসার দান। তাই সে ওই আশ্রয় গ্রহণ করলো না। ভীষণ বলিষ্ঠ আত্মবিশ্বাসী পুরুষ চাঁদসদাগর। যাকে সে ঘৃণা করে তার দয়ায় বাঁচার ইচ্ছা নেই তার। সমুদ্রের ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে এক সময় চাঁদসদাগর তীরে এসে পৌছোলো। নানা দুঃখে কেটে গেলো তার জীবনের বারোটি বছর। স্বদেশ স্বগৃহ থেকে দূরে কাটলো তার এ-সময়; তার ধন নেই, ডিঙ্গা নেই, গৃহ নেই। অভিজাত ধনী চাঁদসদাগর বারো বছর পরে ভিক্ষুকের মতো ফিরে এলো নিজ ঘরে। মনসার অত্যাচারের সে এক করুণ শিকার। তবু সে বিচলিত হওয়ার পাত্র নয়, কোনো অত্যাচারকে সে চরম বলে ভাবে না। সে ভেঙে পড়ে না। এমন অসাধারণ লোক চাঁদসদাগর।