সর্বনাশ কিসের। বাঁচিয়ে দিয়েছি তো আপনাকে। এখানে আপনাদের বাড়িতে তল্লাশী করলে বিস্তর সোনা দানা পেয়ে যেতো, এখান থেকে কায়দা করে হটিয়ে দিলাম কেমন। এখন মরুক না গিয়ে আসামের জঙ্গলে। অরণ্যে অরণ্যে রোদন করে বেড়াক।
এখানে আমাদের বাড়ি তল্লাশী করে কিছুই পেতো না সে। বড়ো জোর লাখ খানেক কি দেড়েক আমাদের দৈনন্দিন দরকার মিটিয়ে মাস খরচার জন্য লাগে যেটা। আমরা কি এখানে জমাই নাকি মশাই? চোর-ডাকাতের ভয় নেইকো? সেদিনের কারখানার সেই চুরিটা হয়ে যাবার পর থেকে আমরা সাবধান হয়েছি। আমাদের কারবারের লাভের টাকা আর বাড়তি যা কিছু, সব আমরা সোনার বাট বানিয়ে গৌহাটি নিয়ে যাই-বাড়ির কাছাকাছি একটা জঙ্গলে গিয়ে এক চেনা গাছের তলায় পুঁতে রেখে আসি।
চেনা গাছ। অবাক লাগে আমার গাছ কি আবার কখনো চেনা যায় নাকি? একটা গাছের থেকে আরেকটাকে, এক গোরর থেকে অন্য গোরু, এক চীনেম্যানের থেকে আরেক চীনেম্যান কি আলাদা করে চিনতে পারে কেউ? গাছ যদি হারিয়ে যায়?
ঐ একটা বস্তু যা কখনো হারায় না, টাকাকড়ি নিয়ে পালিয়ে যায় না কদাচ। হাত-পা নেই তো, একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে ঠায়…
এই জন্যেই তো শুদ্ধভাষায় ওদের পাদপ বলেছে, তাই না দাদা? গোবরার সঠিক ভাষ্য বনে আগুন লাগলে দপ করে জ্বলে ওঠে বটে কিন্তু সেখান থেকে মোটেই পালাতে পারে না।
আমি তো মশাই চিনতে পারিনে, শাখা-প্রশাখা ডাল-পালা নিয়ে সব গাছই তো আমার চোখে এক চেহারা মনে হয়। ফুল ধরলে কি ফল ফললে তখন যা একটু টের পাই তাদের জ্ঞাতগোত্রের কোনটা আম, কোনটা জাম-কিন্তু কোন গাছটা যে কে, কোনজনা, তা আমি চিনে রাখতে পারিনে।
আমরা পারি। একবার যাকে যে গাছটাকে দেখি তাকে আর এ জীবনে ভুলিনে….
যাক গে সে কথা…এখন আপনাদের গোয়েন্দা যদি আমাদের বাড়ি গিয়ে কাছাকাছি জঙ্গলের যতো গাছের গোড়ায় না খোঁড়াখুড়ি লাগিয়ে দেয় তাহলেই তো হয়েছে।
গোড়ার গলদ বেরিয়ে পড়বে আমাদের। গোবরা বলে।
একটা না একটার তলায় পেয়ে যাবে আমাদের ঐশ্বর্যের হদিস। অরণ্যেই আমাদের ঐশ্বর্য, যতই গালভরা হোক, কথাটা বলে আপনি ভাল করেননি। এভাবে হদিসটা দেওয়া ঠিক হয়নি আপনার।
তার চেয়ে আপনি কষে আমাদের গাল দিতে পারতেন বরং। কিছু আসতো যেতো না। গালে চড় মারতেও পারতেন। গাল বাড়িয়ে দেয় গোবরাকিন্তু আমাদের ভাঁড়ারের নাগাল দেওয়াটা উচিত হয়নি।
কী করা যায় এখন। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েন হর্ষবর্ধন। বসে তো ছিলেনই, মনে হয়, আরো যেন তিনি একটু বসে গেলেন।
চলো দাদা, আমরা গৌহাটি চলে যাই। গোবরা একটা পথ বাতলায়, ওই ট্রেনেই চলে যাই আজ। গোয়েন্দার উপর গোয়েন্দাগিরি করা যাক বরং। ডিটেকটিভ বই তো নেহাত কম পড়িনি ওদের হাড়-হদ্দ জানি সব। কিছুই আমার অজানা নয়।
ওর পড়াশোনার পরিধি কদুর জানার আমার কৌতূহল হয়। সে অকাতরে বলে–কম বই পড়েছি নাকি? লাইব্রেরি থেকে আনিয়ে আনিয়ে পড়তে কিছু আর বাকি রাখিনি। সেই সেকেলে দারোগার দপ্তর থেকে শুরু করে পাঁচকড়ি দে-আহা সেই মায়াবী মনোরমা বিষম বৈসূচন…কোনোটাই বাদ নেই আমার। আর সেই নীলবসনা সুন্দরী।
দাদার সমর্থন আসে–আহা, মরি মরি।
থেকে আরম্ভ করে সেদিনের নীহার গুপ্ত, গৌরাঙ্গ বোস অব্দি সব আমার পড়া। ব্লেক সিরিজ, মোহন সিরিজ বিলকুল। জয়কুমার থেকে ব্যোমকেশ পর্যন্ত কারো কীর্তিকলাপ আমার অজানা নয়। এতো পড়ে পড়ে আমি নিজেই এখন আস্ত একটা ডিটকিটিভ, তা জানেন?
বলো কি হে?
সেবারকার আমাদের কারখানার চুরিটা ধরলো কে শুনি? কেন গোয়েন্দা? এই-এই শর্মা তো। তেজপাতার টোপ ফেলে তৈজসপত্রের লোভ দেখিয়ে আমিই তো ধরলাম চোরটাকে। দাদার বেবাক টাকা উদ্ধার করে দিলাম। তাই না দাদা?
তোর ওই সব বই টই এক-আধটু আমিও যে পড়িনি তা নয়। ওর আনা বই-টই অবসরমতন আমিও ঘেঁটে দেখেছি বইকি। তবে পড়ে-উড়ে যা টের পেয়েছি তার মোদ্দা কথাটা হচ্ছে এই যে গোয়েন্দাদের মৃত্যু নেই। তারা আপনার ঐ আত্মার মতই অজর অমর অবিনশ্বর অকাট্য অবিধ্য…
অকাট্য? অবিধ্য?
হ্যাঁ, তরোয়াল কেটে ফেলা যায় না, গুলি দিয়ে বিদ্ধ করা যায় না মেরে ফেলা তো অসম্ভব। কানের পাশ দিয়ে চলে যাবে যতো গুলিগোলা। এই পরিচ্ছেদে দেখলেন আপনি সে হতভাগা খতম হলো, আবার পরের পরিচ্ছদই দেখুন ফের বেঁচে উঠেছে আবার। অকাট্য অবিধ্য অখাদ্য।
তাহলে চলো দাদা। আমরাও ওকে টের পেতে না দিয়ে ওই ট্রেনেই চলে যাই আজকে। গুলি করেও গুলিয়ে দেওয়া যাক ওকে আসল জায়গার থেকে ভুলিয়ে অন্য জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিয়ে আসবো দেখো তুমি।
এতক্ষণে দাদা যেন একটু আশ্বস্ত হলেন মনে হলো। হাসিমুখে বললেন–যাব তো, কিন্তু যাচ্ছি যে, ও যেন তা টের না পায়!…
গৌহাটি স্টেশনে নামতেই তাঁর নজরে পড়ে গেলেন কল্কেকাশির। কষ্কেকাশি তাদের দেখতে পেয়েছে সেটা তারা লক্ষ্য করলেন বটে, কিন্তু তারা যে লক্ষীভূত হয়েছেন সেটা তাকে টের পেতে দিলেন না একেবারেই। নজরই দিলেন না একদম তার দিকে। আপন মনে হেলে দুলে বাইরে গিয়ে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করলেন তাঁরা।
কল্কেকাশিও অলক্ষে পিছু পিছু আরেকটা ট্যাক্সিতে গিয়ে উঠলেন তারপর। ছুটলেন তাঁদের পিছনে পিছনে।