- বইয়ের নামঃ শিবরাম রচনা সমগ্র
- লেখকের নামঃ শিবরাম চক্রবর্তী
- বিভাগসমূহঃগল্পের বই
অঙ্ক সাহিত্যের যোগফল
আমার পাশের বাড়ির রাজীবরা খাসা লোক! ও, ওর দাদা, বাবা, ওরা সব্বাই। কিন্তু লোক ভালো হলে কি হবে, মনের ভাব ওরা ঠিক মতন প্রকাশ করতে পারে না। সেটা আমাদের ভাষার গোলমালে, কি ওদের মাথার গোলমালে, তা এখনো আমি ঠাওর করে উঠতে পারিনি। কিন্তু যখনই না আমি তাদের কিছু জিগগেস করছি, তার জবাব যা পেয়েছি তা থেকে দেখেছি মাথামুণ্ডু কোনো মানেই খুঁজে পাওয়া যায় না।
কেন, এই আজই তো! বেরুবার মুখেই রাজীবের দাদার সাথে দেখা। জিগগেস করলুম–কেমন আছো হে?
এই কেটে যাচ্ছে একরকম!
কেটেযাচ্ছে? শুনলে পিলে চমকায়! কিন্তু তখন ভারী তাড়া, ফুরসত নেই দাঁড়াবার। নইলে কী কাটছে, কেন কাটছে, কোথায় কাটছে, কিভাবে কাটছে, কবের থেকে কাটছে এসবের খবর নেবার চেষ্টা করতুম।
বাজারের পথে রাজীবের বাবাকে পাই–এই যে! কেমন আছেন মুখুয্যেমসাই?
আজ্ঞে যেমন রেখেছেন!
এত কি একটা জবাব হলো নাকি? এ থেকে ভদ্রলোকের দেহমনের বর্তমান অবস্থায় কতখানি আমি টের পাই? কে রেখেছেন, আর কেনই বা রেখেছেন–তারই বা কি কোন হদিশ পাওয়া যায়? তোমারই বলো।
ঝি সঙ্গে নিয়ে বাজারে চলেছেন, তখন আর তাকে জেরা করে জানা গেল না; অগত্যা ঝি–কেই প্রশ্ন করি–তুই কেমন গো বুড়ী?
এই আপনাদের ছিচরণের আশীর্বাদে। আপ্যায়িত হয়ে বুড়ী যেন গলে পড়ে।
ছিচরণকে আমি চিনি না, তার আশীর্বাদের এত বহর কেন, বাতিকই বা কিসের, তাও আমার জানা নেই, কিন্তু সঠিক উত্তর না পাওয়ার জন্যে–ও আর ছিচরণ দুজনের ওপরেই নিদারুণ চটে গেলাম।
এক বন্ধুর সঙ্গে মোলাকাত হঠাৎ। অনেকদিন পরে দেখা, কুশল প্রশ্ন করি–মহেন্দ্র যে! ভালো আছো তো?
এই একরকম।
এও কি একটা কথার মত কথা হল? ভাল থাকার আবার একরকম, দুরকম নানারকম আছে নাকি? বন্ধু বলে কিছু আর বলি না, মনে মনে ভারী বিরক্তি বোধ করি।
বিকেলে যখন আমি বাসামুখো, সেই সময় রাজীবও–খাসা ছেলে রাজীব! সেও দেখছি ফিরছে ইস্কুল থেকে!–এই যে রাজীবচন্দন! চলছে কি রকম?
চমৎকার!
না, এবার ক্ষেপেই যেতে হোলো। যখনই ওকে কোনো কথা–তা ওর স্বাস্থ্য, কি খেলাধুলা, কি পড়াশোনা যা কিছুর সম্পর্কেই জিগগেস করেছি, তখনই ওর ওই এক জবাব চমৎকার! এ ছাড়া যেন আর অন্য কথা ওর ভাঁড়ারে নেই আলাদা কোনো বুলি ও জানে না।
বাড়ি ফিরে ভারী খারাপ লাগে। এ কী? সবারই কি মাথা খারাপ নাকি? আবাল বৃদ্ধ বনিতা–সক্কলের? এবং একসঙ্গেই? আশ্চর্য।
দুনিয়া-সুদ্ধ সবারই ঘিলুর গোলমাল, না আমাদের ভাষায় ভেতরেই গলদ–তাই নিয়ে মাথা ঘামাই। এরকম হেঁয়ালীপনার খেয়ালী জবাবে কবিরাই খালি খুশি হতে পারেন, আমার যুক্তিবাদী বৈজ্ঞানিক মন কিন্তু ভীষন বিচলিত হয়। মাথা ঘামাতে হয় আমায়।
আচ্ছা, আমাদের ভাষাকে অঙ্কের নিয়মে বেঁধে দিলে কেমন হয়? বিশেষ করে বিশেষণ আর ক্রিয়াপদের? অঙ্কের নির্দেশের মধ্যে তো ভুল হবার কিছু নেই। ফিগারস ডু নট লাই–অঙ্কেরা মিথ্যবাদী হয় না,–মিথ্যা কথা বলতে জানে না–এই বলে একটা বয়েতে আছে না ইংরাজীতে সংখ্যার মধ্যে বাঁধা পড়লে শংকার কিছু থাকে না; আর, ভাসা-ভাসা ভাবটা কেটে যায় ভাষার। অঙ্কের নিরিখটাই সব চেয়ে ঠিক বলে মনে হয়।
১০০-কেই পুরো সংখ্যা ধরা যাক তাহলে। আমাদের দেহের, মনের, বিদ্যার, বুদ্ধির, রূপের, গুণের–এক কথায় সবকিছুর সম্পূর্ণতাজ্ঞাপক সংখ্যা হোলো গিয়ে ১০০; এবং ওই সংখ্যার অনুপাতের দ্বারাই অবস্থাভেদের তারতম্য বুঝতে হবে আমাদের। এর পর আর বোধগম্য হবার বাধা কি রইল?
উদাহরণ : নিয়মকানুন মেনে এর পর রাজীবের বাবাকে গিয়ে যদি আমি জিগগেস করি… কেমন আছেন মশাই? ভাল তো? এবং সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় সংখ্যা হয় ১০০-তাহলে ভেবেচিন্তে, অনেক হিসেব করে তাকে উত্তর দিতে হবেঃ–এই ভাল আছি এখন! পরশু পেটের অসুখে ১০ দাঁড়িয়েছিল, কাল দাঁতের ব্যাথায় ৭-এ ছিলাম, আজ যখন দাঁত তোলাই তো কাত, প্রায় নাই বললেই হয়। এই যাই আর কি! তারপর অনেকক্ষণ zero বার পর সামলে উঠলাম, সেই থেকেই ১ টু দুর্বল বোধ করছি নিজেকে-এখনই এই ৫৩!
অর্থাৎ যেদিন-যখন-যেমন তার শরীর-গতিক!
আমার বিস্ময়-প্রকাশে বরং আরো একটু তিনি যোগ করতে পারেনঃ–হ্যাঁ, বাহান্নই ছিলাম মশাই। কিন্তু আপনার সহানুভূতি প্রকাশের পর এখন একটু ভাল বোধ করছি আরো। তা, ওই যাহা বাহান্ন, তাহা তিপ্পান্ন!
সব সময়েই মানুষ কিছু একরকম থাকে না–সুতরাং সব সময়েই উত্তর একরকম হবে কেন? এমনি সব ব্যাপারেই। ভাব-প্রকাশের দিকে ভাষায় যে অসুবিধা আছে সংখ্যার যোগে তা দূর হবেই–যেমন করে কুয়াশা দূর হয়ে যায় সূর্যোদয়ের ধাক্কায়। সাহিত্যে আর অঙ্কের যোগাযোগে সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি তো হবেই নির্ঘাৎ-অঙ্কের সম্বন্ধে ও আমাদের আতঙ্ক কমে যাবে ঢের। সেইটাই । উপরন্ত। অর্থাৎ লাভের উপরি। ফাউয়ের ওপর পাউকো।
নাঃ, এ বিষয়ে রাজীবের বাবার সঙ্গে একটা বোঝাপড়া হওয়ার দরকার এখুনিই–এই দণ্ডেই। এবং রাজীবের সঙ্গেও।
তখুনি বেরিয়ে পড়ি ৬২ বেগে।
ওদের বাড়ি বরাবর গেছি, দেখি, শ্রীমান রাজীবলোচন সদর রাস্তায় দাঁড়িয়েই ঘুড়ি ওড়াচ্ছেন ৯৮ মনোযোগে।–খুব যে ঘুড়ি ওড়াচ্ছ দেখছি?